ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাদ-প্রতিবাদে মুখর ভারতীয় মিডিয়া

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ১৩ মার্চ ২০১৫

বাদ-প্রতিবাদে মুখর ভারতীয় মিডিয়া

একটি প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে এখন তুলকালাম গোটা ভারতে। বিশ্ব নারী দিবসকে সামনে রেখে বিবিসি ‘ইন্ডিয়া’স ডটার’ নামে এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করে। ৮ মার্চ নারী দিবসে বিবিসি ও এনডিটিভিতে সম্প্রচারের কথা ছিল এটি। কিন্তু বিতর্ক ওঠায় ৪ দিন আগেই বিবিসি এটি সম্প্রচার করে। যদিও ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে এনডিটিভি প্রামাণ্যচিত্রটি সম্প্রচার করতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক হইচই পড়ে গেছে। ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিবিসির বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার। বিবিসিতে নোটিস গেছে তিহার জেল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও। কী আছে এই প্রামাণ্যচিত্রে? কেন এত বিতর্ক? নানাবিধ প্রশ্ন তুলেছে ‘ইন্ডিয়া’স ডটার’। তোপের মুখে বিবিসির প্রামাণ্যচিত্র দিল্লীতে ২০১২ সালে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের ঘটনায় ভারতব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। নারীদের নিরাপত্তার দাবিতে ভারতে এমন প্রতিবাদ এর আগে কখনও দেখা যায়নি। ওই গণধর্ষণের ঘটনার ওপর বিবিসির নির্মিত এক প্রামাণ্যচিত্র আবারও ভারতে তীব্র আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। গত সপ্তাহে ভারতের সরকার, দিল্লী পুলিশ ও কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা প্রামাণ্যচিত্রটিকে নারীবিরোধী ও ভারতবিরোধী বলে মন্তব্য করে এর সম্প্রচার আটকে দেয়। ভারতের গণমাধ্যমগুলোর একটি অংশও এতে তীব্র আপত্তি জানায়। আবার অনেকেই প্রামাণ্যচিত্রটি সম্প্রচারের পক্ষে মত দেয়। প্রামাণ্যচিত্রটি ২০১২ সালে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া ধর্ষণকারী মুকেশ সিংয়ের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে নির্মাণ করেন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা লেসলি উডউইন। প্রামাণ্যচিত্রটির নাম ‘ইন্ডিয়া’স ডটার’। এতে দেখা যায়, মুকেশ ওই ঘটনার জন্য কোন অনুশোচনা তো দেখায়ইনি, বরং ধর্ষণে বাধা দেয়ার জন্য ধর্ষিত তরুণীকেই দোষ দিয়েছে। মুকেশ সিং তার সাক্ষাতকারে কোনরকম অনুতাপ না দেখিয়ে বলে, ‘বাধা না দিলে ধর্ষিতাকে হয়ত মরতে হতো না। ওই ঘটনায় এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।’ মুকেশ সিং ছিলেন ঘটনায় জড়িত চারজনের একজন এবং ঘটনায় তাঁর সংশ্লিষ্টতার দায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ৪ মার্চ ভারতের পার্লামেন্টে প্রামাণ্যচিত্রটির সমালোচনা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ভারতে এটি দেখানোর অনুমতি দেয়া হবে না। একই সঙ্গে কিভাবে নির্মাতারা জেলের ভেতরে থাকা এক আসামির সাক্ষাতকার নিয়েছেন সে বিষয়েও তদন্ত হবে। রাজনাথ সিং বলেন, ‘দিল্লী গণধর্ষণের ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে কেউ বাণিজ্যিক মুনাফা করবে, সরকার তা হতে দেবে না।’ তাঁর মতে, দোষী সাব্যস্ত ধর্ষণকারীর সাক্ষাতকার নিয়ে বিবিসির এ রকম বিতর্কিত প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে আরও পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়মকানুন ভঙ্গ করা হয়েছে কিনা তাও তদন্ত করে দেখা হবে। দিল্লীর একটি আদালত এ বিষয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি এবং এটি সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তাই ভারতের কোন চ্যানেলেই এটি দেখানো যাবে না। এই ঘটনার পর তিহার জেলের মহাপরিচালক বিবিসিকে একটি লিগ্যাল নোটিস পাঠান। তাতে প্রামাণ্যচিত্রটি প্রদর্শন এমনকি ব্রিটেনেও সম্প্রচার না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই নোটিসের জবাব দিয়েছেন বিবিসি টেলিভিশনের পরিচালক ড্যানি কোহেন। তিনি বলেছেন, আমরা মনে করি, প্রামাণ্যচিত্রটি নারীর জন্য অবমাননাকর বা অসম্মানের নয়। বরং এটি ভারতে নারীরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা উঠে এসেছে। তবে ভারতে এটি সম্প্রচারের কোন পরিকল্পনা এখন আমরা করছি না। প্রত্যেকেরই দেখা উচিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া’স ডটার’ ভারতে সম্প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দেশটির সরকার। সেই নিষেধাজ্ঞার ওপরই পরোক্ষ চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন নির্ভয়ার (ধর্ষিতা মেডিক্যাল ছাত্রীর ছদ্মনাম) বাবা। তাঁর ভাষায়, এ প্রামাণ্যচিত্র সমাজের প্রকৃত মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। প্রত্যেকের অবশ্যই ‘ইন্ডিয়া’স ডটার’ দেখা উচিত। একবার ভেবে দেখুন, যে ব্যক্তি জেলের চার দেয়ালের মধ্যে থেকেও এ ধরনের মন্তব্য করতে পারে, সে একবার ছাড়া পেলে আরও কী করতে পারে? নির্ভয়ার বাবা আরও বলেন, ভারতে কি চলছে তা প্রকাশ হয়েছে এ প্রামাণ্যচিত্রে। কিভাবে অপরাধীরা এখনও বেঁচে আছে? কেন এখনও ওদের ফাঁসি হলো না? মেয়েদের কি পরা উচিত, কি নয় সেটা নির্ধারণ করার ওরা কে? যদি আমাদের মেয়েরা বেঁচেই না থাকে, তাহলে বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও-এর মতো সরকারী প্রচারের অর্থটা কী?’ বিভক্ত গণমাধ্যমও ওই সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর থেকেই তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। এ রকম সাক্ষাতকার নেয়া আদৌ উচিত হয়েছে কি না, তা নিয়ে কার্যত বিভক্ত হয়ে যায় ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। ‘টাইমস নাও’ নামে একটি জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেল প্রামাণ্যচিত্রটি সম্প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বিবিসি ও এনডিটিভির বিরুদ্ধে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছে। দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা লিখেছে, বহু মানুষই ধর্ষণকারীর ওই অবমাননাকর মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আর সে কারণেই সরকার প্রামাণ্যচিত্রটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। ভারতীয় টিভি সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীর দাবি, এই তথ্যচিত্র নির্মাণ খুবই অনৈতিক কাজ। বিতর্কিত এ প্রামাণ্যচিত্রের প্রচার নিষিদ্ধ করায় ভারতের সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি রবিবার তাদের সম্প্রচার এক ঘণ্টা বন্ধ রেখেছিল। ওই দিন বিশ্ব নারী দিবসে রাত নয়টায় প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচারের কথা ছিল। তবে এর আগেই ‘বিতর্কিত বিষয়’ থাকার অভিযোগ এনে ভারতীয় আদালত প্রামাণ্যচিত্রটির প্রচার নিষেধ করে। উল্লেখ্য, রবিবার রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এনডিটিভি অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ রাখে। এ সময় কালো পর্দার ওপর প্রামাণ্যচিত্রের নাম সাদা ও লাল রঙে লেখা ছিল। পর্দার নিচের স্ট্রাপলাইনে প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে খ্যাতনামা ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়। এ সময় কোন শব্দ ছিল না। কেবল ‘প্রতি ২০ মিনিটে একটি ধর্ষণ’ লেখাটি স্ট্রাপলাইনে আসার সময় চাপা শব্দ শোনা যায়। প্রামাণ্যচিত্রটি নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠতম প্রতিবাদ এসেছে প্রভাবশালী দি হিন্দু পত্রিকার সাবেক সম্পাদক ও পত্রিকাটির মূল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এন রামের লেখায়। তিনি নিষেধাজ্ঞার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অপ্রিয় সত্য ইন্ডিয়া’স ডটার এক অপ্রিয় কিন্তু বাস্তব সত্যকে তুলে এনেছে চোখের সামনে। শুধু তুলেই আনেনি, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এক অন্ধকার দিক। যে অন্ধকার দিকটায় আমরা আলোকপাত করতে চাই না, স্বীকার করা তো দূরঅস্ত! এই অন্ধকার দিকটা ভারতীয় পুরুষের মন তথা গোটা উপমহাদেশের পুরুষের মন! পুরুষশাসিত রাষ্ট্র ও সমাজে নারীর প্রতি অধিকাংশ পুরুষের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গিটা কি, তার স্বরূপ নগ্নভাবে উন্মোচিত হলো এই প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে। পুরুষের তরফ থেকে মুখে মুখে যতই নারী স্বাধীনতা ও তার সমানাধিকারের কথা উঠুক না কেন, পুরুষের ধর্ষকামী মনোভাব ও নারীকে ঘরের চৌকাঠে বন্দী ও দাসী করে রাখার মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার প্রকৃত চেহারাটা যেন নখদন্তসহ বের হয়ে এলো। সেই চেহারাটা যে কত বীভৎস ও পাশবিক তা বোঝা যায় মৃত্যুদ-ের সাজাপ্রাপ্ত আসামি ধর্ষক মুকেশের জবানবন্দীতে। এই প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে স্পষ্টত এনডিএ তথা জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটশাসিত বিজেপি সরকারের কপালে ভাঁজ পড়েছে। কিভাবে কারাগারের মধ্যে শূট হলো, অনুমতিই বা কোত্থেকে পেল, তা নিয়ে ভারতের রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত। ইতোমধ্যে, ‘ভারতের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গদের ষড়যন্ত্রে’র গন্ধ পেয়েছে সেদেশের সরকার। বিশ্ব দরবারে ভারতের মাথা হেঁট করার জন্যই নাকি এমন তথ্যচিত্র নির্মাণ- এই যুক্তির ধুয়া তুলে এর সম্প্রচারও বন্ধ করা হয়েছে ভারতে। বিবিসিকেও সম্প্রচার না করার অনুরোধ করেছে, কিন্তু বিবিসি তা আমলে নেয়নি। উল্টো নারী দিবসের চারদিন আগেই সম্প্রচারের পর তা ইউটিউবে আপলোড করে দেয়। ‘জাতীয় সংবেদনশীল বিষয়’ দাবি করে তা তুলে নেয়ার অনুরোধ করা হলে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ অবশ্য প্রামাণ্যচিত্রটি প্রত্যাহার করে নেয়। ভারতে মুকেশের মতো পুরুষ তো আর একজন নয়। সে একজন প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যক্তি মাত্র। এ রকম কত মুকেশ রয়েছে সে দেশে? জরিপ করে সঠিক সংখ্যাটা বের করে আনলে সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সে দেশে কোন নারী স্বাভাবিক জীবনযাপনে নিজেদের নিরাপদ বোধ করবেন না। কোন রোগের চিকিৎসার প্রাথমিক ও পূর্বশর্ত রোগকে স্বীকার করে নেয়া। ভারতে নিষিদ্ধ হওয়া প্রামাণ্যচিত্রটি একটি আয়না বলা চলে। যে আয়না বলে দেয়, সেদেশে পুরুষের নারীসম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষতন্ত্রের ক্ষত সে দেশের সমাজকে কতটা ব্যাধিগ্রস্ত করেছে, তাও নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ল। সে দেশের সরকার এই প্রামাণ্যচিত্র সম্প্রচার বন্ধ করে প্রকারান্তরে সমাজ-শরীরের এই ভয়াবহ গভীর ক্ষতকেই অস্বীকার করল। সেক্ষেত্রে ক্ষত নিরাময় হবে কিভাবে? রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা যতই ‘ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে’র জিগির তুলে তথ্যচিত্রটির ওপর নিষিদ্ধের খ—গ চালান না কেন, সে দেশের মানুষ ও গোটা বিশ্ব যা দেখার ঠিক দেখে নেবে এবং যা বলার রাখ-ঢাক না রেখেই বলবে। এতে ভারতের লজ্জার কিছু নেই। বরং লজ্জা পাবে ভারতের পুরুষতন্ত্র। এতে সে দেশেরই মঙ্গল। অশিক্ষিত ও বিকৃত মস্তিষ্ক ধর্ষক মুকেশ যে ভাষায় কথা বলেছে, তা মূলত সে দেশের পুরুষতন্ত্রেরই নির্লজ্জ কণ্ঠস্বর। কেবল সে দেশের পঞ্চায়েতের ফতোয়াবাজরাই নয়, কেবল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকই নয়, দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশ নেতাও বহুবার প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন। ‘মুকেশ তো একা নয়। বহু পুরুষ মানুষ, বহু শিক্ষিত পুরুষ মানুষের মুখের কথাটাই ও বলে দিয়েছে’- নির্ভয়ার বাবা বদ্রীনাথ সিংহের এ কথায় মিথ্যার তিলাগ্রও নেই। পরিচালক লেসলি উডউইন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি আর্জি জানিয়েছেন, ‘প্রথমে প্রামাণ্যচিত্রটি দেখুন। তারপরে নিষেধজ্ঞার কথা ভাবুন।’ নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের মতো অপরাধের পেছনে কী ধরনের মানসিকতা কাজ করে, তা উডউইন ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। এই প্রামাণ্যচিত্রের বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধর্ষকের মন জানার তাগিদ ক্রমশ বাড়বে, অনেক তর্কবিতর্ক হবে। মূলকথা, ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসা অপরাধের অন্ধকার অলিগলিতে আলো পড়বে। ক্ষতগুলি আরও স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হবে। তাহলে নিরাময় করাও সম্ভব হবে। তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট
×