ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শক্ত অবস্থানে ব্যাংকিং খাত

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১২ মার্চ ২০১৫

শক্ত অবস্থানে ব্যাংকিং খাত

রহিম শেখ ॥ টানা অবরোধ ও হরতালের মধ্যেও শক্ত অবস্থানেই রয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। রেমিটেন্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি-রফতানি, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যসহ সব সূচক এখনও ইতিবাচক। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতাও কমে আসছে। খেলাপীঋণ কমার প্রভাবে এখন মূলধন ঘাটতিতে নেই ব্যাংক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের কারণেই অর্থনীতির সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে ব্যাংকিং খাতের মূলধন ভিত্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটা বড় অংশ মূলধনে স্থানান্তর, পুনঃমূলধনীকরণ ও প্রভিশন ঘাটতি কমার ফলে এমন হয়েছে। ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভিত্তি আরও শক্তিশালী হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর মূলধনভিত্তি শক্তিশালীকরণের প্রয়াসে আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম রীতি-পদ্ধতি অনুসরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলধন পর্যাপ্ততা সংক্রান্ত ব্যাসেল-২ নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চলতি বছর থেকে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ॥ চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই গত ফেব্রুয়ারি মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গিয়ে পৌঁছেছে ২৩ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণের এ রিজার্ভ বর্তমানে পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান সম্প্রতি জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থনীতির সার্বিক সূচকগুলো বর্তমানে ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। অর্থনীতির গতি শক্তিশালী হওয়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ বাড়ছে। তিনি বলেন, ৪০ বছরের ইতিহাসে এটা রেকর্ড রিজার্ভ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই রিজার্ভ খরচ করে ৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। অর্থনীতির এ ধারাবাহিক সাফল্যে আমাদের জন্য আনন্দের। রেমিটেন্স ॥ চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রায় ১ হাজার কোটি ডলারের রেমিটেন্স এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭০ কোটি ডলার বেশি। এ সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৮ শতাংশ, যা চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেমিটেন্স সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে, ১৪৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছিল ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে, ১৩২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সৌদি, কাতারসহ আরও দুই-একটি দেশের জনশক্তির দুয়ার খুলে গেলে এই প্রবাসী আয় আরও কয়েকগুণ বাড়বে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান। আমদানি-রফতানি ॥ রাজনৈতিক অচলবস্থার মাঝেও বাড়ছে আমদানি ব্যয়ও। ছয় মাসেই এই ব্যয় গিয়ে ঠেকেছে ২০ বিলিয়ন ডলার, যা গেল অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি। গত এক বছরে এলসি খোলা ও এলসি দায় মেটানো দুই-ই বেড়েছে। হরতাল-অবরোধের ধাক্কায় রফতানি আয় কমেনি, বরং বেড়েছে। গেল আট মাসে রফতানি আয় এসেছে ২০.৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২.৫৬ শতাংশ বেশি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো আরও গতিশীল হতে পারত। তারপরও হরতাল-অবরোধে বর্তমানে অস্থির সময়েও দেশের অর্থনীতি এখনও চাঙ্গা রয়েছে। তিনি বলেন, সক্ষম জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ॥ টানা অবরোধ-হরতালের মধ্যেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১৫ হাজার ৭৩৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বেশি। এ বছর নিট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এত বেশি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা থাকেনি। ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা ॥ আন্তর্জাতিক বিধিবিধান ব্যাসেল-২ নীতিমালা অনুযায়ী ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মূলধন পর্যাপ্ততার হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর আগে সেপ্টেম্বর শেষে যা ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ ছিল। ব্যাসেল-২ নীতিমালা মোতাবেক ব্যাংকগুলোকে তাদের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ৮ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর জন্য এ হার ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এসএম মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজমান সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের মূলধনভিত্তি ক্রমশ সুদৃঢ় হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে ব্যাংকিং খাতের মূলধন ভিত্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটা বড় অংশ মূলধনে স্থানান্তর, পুনঃমূলধনীকরণ ও প্রভিশন ঘাটতি কমার ফলে এমন হয়েছে। ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভিত্তি আরও শক্তিশালী হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। নেই তারল্য সঙ্কট ॥ ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর তারল্যের ক্ষেত্রেও কোন ঘাটতি নেই। অলস তারল্য প্রায় ৩,৩৬৪ কোটি টাকা মাত্র, যা ৫৬টি ব্যাংক বিবেচনায় অস্বাভাবিক নয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, কলমানি মার্কেটে সুদের হার দীর্ঘদিন ধরে ৭ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে অর্থাৎ কলমানি মার্কেট স্থিতিশীল রয়েছে। বাজারে পর্যাপ্ত তারল্য থাকায় আগের মতো কলমানি মার্কেটে সুদহারে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঝুঁকিহীন সরকারী সিকিউরিটিজ থাকায় ব্যাসেল-৩ অনুসারে আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ মানদ-ে লিক্যুইডিটি কাভারেজ রেশিও (এলসিআর) এবং নিট স্ট্যাবল ফান্ডিং রেশিও (এনএসএফআর) সংরক্ষণে ব্যাংকগুলো উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। খেলাপীঋণ ॥ গত বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকের তুলনায় শেষ প্রান্তিক অর্থাৎ ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর খেলাপীঋণ বেশ কমে এসেছে। সেপ্টেম্বরের তুলনায় ব্যাংকগুলোর খেলাপীঋণ ৭ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা কমে ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা হয়েছে। খেলাপীঋণ কমার প্রভাবে মূলধন ঘাটতিতে নেই ব্যাংক খাত। গত জুন ও সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সামগ্রিক ব্যাংক খাতে বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতি থাকলেও ডিসেম্বর শেষে চার হাজার ৬৯ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত হয়েছে। তবে ঘাটতি রয়েছে ৬টি ব্যাংকে। আগের প্রান্তিক শেষে ৮টি ব্যাংকের ঘাটতি ছিল। একই সঙ্গে সামগ্রিক ব্যাংক খাতে এক হাজার ৯৬ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি ছিল। সরকারের ব্যাংক ঋণ ॥ গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে খুব বেশি ধার করতে হয়নি। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৯ জানুয়ারি এ সাত মাসে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোন অর্থ ধার করেনি। উল্টো বিভিন্ন সময়ে নেয়া ঋণের ৯ হাজার ২২৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। একই সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার মাত্র ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ফলে সরকারের নিট ঋণ ঋণাত্মক ধারায় নেমে এসেছে, যার পরিমাণ ৬ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের একই সময় এ নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা।
×