ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এবার স্টেমসেল প্রতিস্থাপনে যেতে চাইছে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইউনিট

বোনম্যারো প্রতিস্থাপনে শতভাগ সাফল্য বাংলাদেশের

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১২ মার্চ ২০১৫

বোনম্যারো প্রতিস্থাপনে শতভাগ সাফল্য বাংলাদেশের

নিখিল মানখিন ॥ বোনম্যারো প্রতিস্থাপনে সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে দেশের ব্লাড ক্যান্সার আক্রান্ত ১৩ রোগী। প্রতিষ্ঠার এক বছরে সাফল্য অর্জন করেছে ঢাকা মেডিক্যালে স্থাপিত বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিট। এক বছর আগেও এ রোগের চিকিৎসা নিতে বিদেশে যেতে হতো। বিভিন্ন দেশে এ রোগের চিকিৎসাব্যয় ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা। আর ঢাকা মেডিক্যালে বিদেশের তিন ভাগের এক ভাগ খরচ দিয়েই বোনম্যারো প্রতিস্থাপন সম্ভব হচ্ছে। ব্যয় আরও কমানোর চিন্তাভাবনা করছে সরকার। একটি উন্নয়নশীল দেশে এটি বিরল ঘটনা এবং গত এক বছরের প্রতিটি প্রতিস্থাপনই সফল হয়েছে বলে জানিয়েছেন অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক এমএ খান। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে বুধবার বাংলাদেশে এই অত্যাধুনিক চিকিৎসার বছরপূর্তি পালিত হয়েছে। দেশে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিটে গত এক বছরে শুধু ‘অটোলোগাস’ পদ্ধতিতে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে রোগীর নিজের সুস্থ বোনম্যারো তার নিজের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। কিন্তু ‘এ্যালোজেনিক’ পদ্ধতিতে, অর্থাৎ ভাই-বোন কিংবা দাতার কাছ থেকে নেয়া স্টেমসেল প্রতিস্থাপনে যেতে চায় ইউনিট। গত এক বছর আগেও বাংলাদেশে বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের বিষয়টি কেবল আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এর আগে রাজধানীর বারডেম ও ল্যাবএইড হাসপাতালে পরীক্ষামূলক বোনম্যারো প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালানো হয়। কিন্তু অত্যধিক উচ্চ ব্যয় মেটাতে না পেরে তা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা এবং বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে অবশেষে গত বছরের ১০ মার্চ তা বাস্তবে রূপ নেয়। ওই দিন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সফলভাবে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন) সম্পন্ন হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) অধ্যাপক এম এ খান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক বিমলাংশু দের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের একটি দল এ প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেন। ওই দিন ৫২ বছরের একজন ব্যাংক কর্মকর্তার শরীরে দেশের ইতিহাসে প্রথম অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়। গত বছরের এপ্রিলে সম্পন্ন হয় দ্বিতীয় রোগীর অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। এবার ৫১ বছর বয়সী এ রোগীর দেহে সফলভাবে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়। তিনি মাল্টিপল মায়োলোমা ক্যান্সারে ভুগছিলেন। অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দিয়েছেন হেমোটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ এমএ খান। ওই রোগীর শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভাল ছিল। প্রতিস্থাপন করানোর পর ২ সপ্তাহ ধরে রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। প্রায় দেড় মাস আগে দেশে প্রথমবারের মতো এক রোগীর বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছিল। এভাবে গত বছরের ১০ মার্চ সর্বপ্রথম রংপুরের ওমর আলীর (৫২) শরীরে সফল অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর ২৬ এপ্রিল সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট আলমগীর হোসেনের (৫০), ৮ জুন দিনাজপুরের ব্যবসায়ী আজগর আলীর (৪৫), ২৬ আগস্ট বিজিবির হাবিলদার রফিকুল ইসলামের (৪৯), ১ অক্টোবর গৃহবধূ ফরিদা ইয়াসমিনের (৪৫) ও কলেজ ছাত্র ফাহাদের (২০) ও ২ অক্টোবর স্কুলছাত্র হিমেলের দেহে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়। তারা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। এর পর সম্পন্ন হয় বাকি ৬ জনের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। চিকিৎসকরা জানান, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পর থেকে তিন মাস নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয় রোগীকে। এরপর ১-২ মাস পর পর রোগীকে পরীক্ষা করে যেতে হয় বলে জানান ঢামেক বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা। দেশে সফলভাবে এই ইউনিট অব্যাহত রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সরকারীভাবে দেশে প্রথম একটি অত্যাধুনিক মানের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ইউনিট চালু করায় দেশের সাধারণ রোগীরা বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছেন। জনগণের দোরগোড়ায় অত্যাধুনিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার সরকারী উদ্যোগের বহির্প্রকাশ এটি। তিনি বলেন, রক্ত ক্যান্সার ও থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের রোগীকে বিদেশে যেতে হতো, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু সরকারিভাবে এই চিকিৎসা সেবা চালু হওয়ায় অনেক কম খরচে জনগণ তা গ্রহণ করতে পারছেন। এই উদ্যোগ দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্লাড ক্যান্সার রোগীদের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে অনেক ধাপ এগোলো বাংলাদেশ। এই চিকিৎসার জন্য রোগীকে ৫ লাখ করে ফি দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বলা যায়, তারপরেও এটি ফ্রি চিকিৎসা। একজন রোগীর শরীরে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অন্যান্য খাতেই ব্যয় হয়ে যায় ৫ লাখ টাকার মতো। তবে এ চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারণে আর্থিক বরাদ্দ ও প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই বলে জানান পরিচালক। ঢাকা মেডিক্যালের বোনম্যারো প্রতিস্থাপন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশে এতদিন কোন অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন সেন্টার ছিল না, অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আছে ২৮টি। এখানে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন সেন্টার না থাকায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা শুধু কেমো ও রেডিও থেরাপিনির্ভর ছিল। সিঙ্গাপুরে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে ব্যয় হয় ১ কোটি টাকার ওপরে, আর ভারতে প্রয়োজন হয় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। আর দেশে প্রতিস্থাপন চালু হওয়ায় ৫ লাখ টাকায় অটোলোগাস ও ১০ লাখ টাকায় এ্যালোজেনিক বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব হবে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক এমএ খান বলেন, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ইউনিট চালু হওয়ায় দরিদ্র ও অসহায় রোগীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন। বিত্তবানরা বিদেশে না গিয়ে এদেশে স্বল্পমূল্যে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের সুযোগ পাবেন। আর্থিক সাশ্রয় ছাড়াও তাদের হয়রানি অনেকগুণ কমে যাবে। অত্যাধুনিক এই চিকিৎসাসেবা যাতে আরও বেশি মানুষ পেতে পারে সেজন্য এ বিভাগকে আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। বাড়াতে হবে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট। এছাড়া চিকিৎসক ও নার্সদের প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ প্রদান ও আর্থিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে ডোনারদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, অস্থিমজ্জা হচ্ছে হাড়ের মধ্যে থাকা একধরনের নরম টিস্যু। আর স্টেমসেল হচ্ছে অস্থিমজ্জায় থাকা অপরিণত কোষ, যা শরীরে প্রয়োজনীয় রক্তকণিকা বাড়াতে কাজ করে। ট্রান্সপ্লান্ট প্রক্রিয়ায় ক্যান্সার রোগীর আক্রান্ত বোনম্যারো কেমোথেরাপির মাধ্যমে নষ্ট করে দাতার শরীর থেকে নেয়া স্টেমসেল রক্তে প্রবেশের মতো করেই শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না। দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে স্টেমসেলগুলো থেকে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হতে শুরু করে। থ্যালাসেমিয়া, এ্যাপ্লাস্টিক এ্যানিমিয়ার মতো রোগে আক্রান্তদের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়।
×