ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখছিল ॥ বিবিসিকে বন্যা

এফবিআইর কাছে অভিজিত হত্যার আলামত হস্তান্তর

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১২ মার্চ ২০১৫

এফবিআইর কাছে অভিজিত হত্যার আলামত হস্তান্তর

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আদালতের অনুমতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই প্রতিনিধিদের কাছে লেখক অভিজিত রায় হত্যাকা-ের আলামত হস্তান্তর করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুুলিশ (ডিবি)। ‘যখন অভিজিত ও আমার ওপর নৃশংসভাবে হামলা হচ্ছিল তখন পুলিশ কাছেই ছিল এবং তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি’- বুধবার ফেসবুকে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে এ কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অভিজিত রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বন্যা বলেছেন, এত ভিড়ে এমন হামলা কল্পনার বাইরে, তবে চুপ করে বসে থাকবেন না বলে জানিয়েছেন তিনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, অভিজিত রায় হত্যাকা-ের তদন্তের দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা পুলিশ বুধবার দুপুরে এফবিআই সদস্যদের কাছে ১২ থেকে ১৩টি আলামত হস্তান্তর করেছে। এসব আলামতের মধ্যে রয়েছে হামলাস্থল থেকে পাওয়া দুটো চাপাতি, ব্যাগ ও রক্তের নমুনা। এফবিআই সদস্যরা পরীক্ষার জন্য আলামতগুলো যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাবেন। তারা ঢাকায় থাকছেন। গোয়েন্দা পুলিশের আবেদনে মঙ্গলবার এফবিআইয়ের ল্যাবরেটরিতে অভিজিত হত্যাকা-ের আলামত পরীক্ষার অনুমতি দেয় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। অভিজিত হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করতে এফবিআইয়ের সঙ্গে তথ্য ও মতবিনিময় করছে গোয়েন্দা পুলিশ। পরীক্ষার ফল অপরাধী শনাক্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করেন ডিএমপির মুখপাত্র। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে সঙ্গে নিয়ে একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ের কাছে জঙ্গী কায়দায় হামলায় নিহত হন অভিজিত। এ সময় তার সঙ্গে থাকা স্ত্রী বন্যার একটি আঙুল চাপাতির আঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওই হামলার পর পুলিশ টিএসসির ৫০ গজ উত্তরে ঘটনাস্থল থেকে দুটি চাপাতি ও একটি ব্যাগ আলামত হিসেবে সংগ্রহ করে। ল্যাপটপের ওই ব্যাগে কয়েকটি পত্রিকা ভাঁজ করা ছিল, যা চাপাতিগুলো মোড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা। এছাড়া ব্যাগের ভেতরে একটি জিন্স প্যান্ট ও কয়েকটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেটও পাওয়া যায়। অভিজিত ও তার স্ত্রী বন্যা দুজনেই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্র তার এ হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব দিলে তাতে সাড়া দেয় বাংলাদেশ সরকার। এরপর এফবিআইয়ের একটি দল ঢাকায় এসে তদন্ত শুরু করে। এ দলের চার সদস্য গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং ছবি সংগ্রহ করে। অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়ের সঙ্গেও কথা বলেছেন এফবিআই সদস্যরা। বিজ্ঞানমনস্ক লেখক, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিতকে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর নেতা শাফিউর রহমান ফারাবী নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ইন্টারনেটে লেখালেখির জন্য অভিজিতকে হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে ফারাবীর বিরুদ্ধে। দাঁড়িয়ে দেখছিল পুলিশ ॥ অভিজিত রায়কে কুপিয়ে হত্যার সময় কাছাকাছি স্থানে ছিল পুলিশ। তারা হামলার দৃশ্য দেখলেও হামলাকারীদের ঠেকাতে এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। বুধবার ফেসবুকে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, যখন অভিজিত ও আমার ওপর নৃশংসভাবে হামলা হচ্ছিল তখন পুলিশ কাছেই ছিল এবং তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি। খুনীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সামর্থ্য অনুযায়ী সব কিছু করার দাবি জানাচ্ছি আমরা। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্য ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হুমকি পেতে হয়েছিল তাকে। অভিজিত বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকে লিখে ধর্মীয় মৌলাবাদীদের সমালোচনা করতেন বলেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বন্যা। ফেসবুকে বন্যা লিখেছেন, ঐতিহাসিকভাবে প্রগতিশীল আন্দোলনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিচিতি রয়েছে। এখানেই অভিজিত বেড়ে উঠেছে। হত্যার হুমকি সত্ত্বেও আমরা কখনও ভাবিনি যে, এ ধরনের একটি জায়গায় এমন জঘন্য অপরাধ ঘটতে পারে। এটা এমন অপরাধ যা শুধু একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বাক স্বাধীনতা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। শুধু হত্যাকারীদের ধরেই সরকারের কাজ শেষ হবে বলে মনে করেন না রাফিদা আহমেদ বন্যা। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি হামলাকারীদের পার পাওয়ার সংস্কৃতি, যেখানে লেখকরা খুন হলেও খুনীদের বিচার হয় না, বন্ধ করতে আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি- লিখেছেন তিনি। হামলাকারীরা অন্তত ৫ জন ॥ খুনীদের দেখলে বন্যা চিনতে পারবেন বলে বন্যার সঙ্গে সর্বশেষ কথার ভিত্তিতে জানিয়েছেন তার শ্বশুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়। বন্যাকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা অন্তত পাঁচজন ছিল, তাদের বয়স ছিল ২৫-২৬ বছর। তাদের প্রত্যেকের পরনে জিন্সের প্যান্ট ও গেঞ্জি ছিল। তাদের মুখে কোন দাড়ি ছিল না বলে পুত্রবধূ বন্যার উদ্ধৃতি দিয়ে জানান অজয় রায়। অভিজিত হত্যাকা-ে তার বাবা অজয় রায় মামলা করেছেন, যার তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এখন পর্যন্ত ইন্টারনেটের মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রচারক ফারাবী শফিউর রহমানকে গ্রেফতার করেছে, যিনি ফেসবুকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন অভিজিতকে। বিবিসির সঙ্গে হামলার স্মৃতিচারণ সাক্ষাতকার ॥ এই প্রথম কোন সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাতকার দিয়ে সেদিনের হামলার স্মৃতিচারণ করেছেন দুবর্ৃৃত্তদের হামলায় নিহত লেখক অভিজিত রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। বিবিসির সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুর্বৃত্তরা অভিজিতকে ও তাকে (বন্যা) ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করার পর একজন আলোকচিত্রী যখন তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বার বারই জ্ঞান হারাচ্ছিলেন তিনি। হাসপাতালে প্রথম জ্ঞান ফিরে এলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার সারা গায়ের রক্ত এবং একটি বুড়ো আঙ্গুল হারিয়েছেন। হাসপাতালে নেবার পর অভিজিতকে মৃত ঘোষণা করা হয়। হামলার আগে অভিজিত রায়কে বিভিন্ন সময়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল বলে জানান বন্যা। এসব হুমকিকে তারা কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে দেখতেন এমন প্রশ্নে তার স্ত্রী বন্যা বলছিলেন, হত্যার হুমকি মূলত ছিল ফারাবী নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে। নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে ব্লগ করার কথাও জানান বন্যা। তিনি বলেন, এ ধরনের হুমকি অনেক বুদ্ধিজীবী ও লেখককেই দেয়া হয়েছে, যার দু’একটিই এ পর্যন্ত কার্যকর হয়েছে। হত্যার হুমকি নিয়ে বাংলাদেশে এসে নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভেবেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন নিহত অভিজিতের স্ত্রী। কিন্তু বইমেলা থেকে টিএসসির মোড় পর্যন্ত এইটুকু পথে এত মানুষের মধ্যে এরকম একটি হামলা হতে পারে বলে এটি তাদের কল্পনার বাইরে ছিল বলেই জানালেন রাফিদা আহমেদ বন্যা ।
×