ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইউনূসেরও আইন মানা উচিত

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১২ মার্চ ২০১৫

ড. ইউনূসেরও আইন মানা উচিত

আইনের উর্ধে কেউই নন। এবং এ বিষয়টি সকলের অনুধাবন করা উচিত। প্রায়শ দেখা যায়, জাতীয় ব্যক্তিত্বরা প্রচলিত আইন অমান্য করে দায় মোচন কিংবা ছাড়ের সুযোগ খোঁজেন। আইন মেনে চলার মধ্যেই যে তাদের মহত্ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, সে ব্যাপারটি উপলব্ধি করতে তারা ব্যর্থ হন। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকজন ভারতীয় কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পদচ্যুত হন, যা দেশে সংঘটিত নানা ঘটনায় লক্ষ্য করা যায়। ধর্ষণের ঘটনায় দ-প্রাপ্ত তেহেলকা ম্যাগাজিনের সম্পাদক তরুণ তেজপাল ও জলবায়ু বিষয়ক চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র পাচুরি কিংবা অন্যের লেখা নকল করার স্ব-স্বীকারোক্তি দেয়া ফরিদ জাকারিয়া এমন কেলেঙ্কারির অন্যতম উদাহরণ। তবে কিছু কিছু কেলেঙ্কারি হতাশার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাও মানুষকে দেয়। উদাহরণ হিসেবে প্রফেসর ইউনূস কিংবা অমর্ত্য সেনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। এ দু’জনের কেলেঙ্কারি ভারতের জন্য একটি গভীর শিক্ষা এবং তা অনেক কিছুই নির্দেশ করে। যদিও প্রফেসর ইউনূস একজন বাংলাদেশী তবুও একথা বলা অপেক্ষা রাখে না যে তিনি ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতি ধারণ করেন। ড. ইউনূসের কথাই ধরুন, গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের জন্য তাঁকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। যদিও বিষয়টি সবার জানা। ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কিংবা মাইক্রোফিন্যান্স তত্ত্বের বছর দুয়েক আগে ইলা বাট তা উদ্ভাবন করেন। ইলা বাট একজন গান্ধীবাদী নেত্রী। ড. ইউনূস বাংলাদেশের প্রচলিত অবসর বয়সসীমা অতিক্রম করার পর গ্রামীণ ব্যাংকের শীর্ষপদ থেকে সরে যেতে অনীহা দেখান। অবশেষে বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের এক রায়ে তিনি বাধ্য হন গ্রামীণ ব্যাংকের পদ ছাড়তে। যদিও দেশের বাইরের বন্ধুরা এ বিষয়ে তার পাশে ছিলেন। বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাসীন নারী হিলারী ক্লিনটন তাঁর পদত্যাগ ঠেকাতে তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশী সাহায্য বাতিলের হুমকিও দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা পিতার ভাবমূর্তি কাজে না লাগিয়েই অবাধ ও সুষ্ঠু একটি নির্বাচনে জিতেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের এমন সংস্কৃতি সবাইকে অবাক করে। অবসর যাপনের আইনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা ড. ইউনূসের পদে থাকা শোভন ছিল না। ড. ইউনূসের উচিত ছিল, সম্মানের সঙ্গেই পদত্যাগ করা। কিন্তু তিনি তা স্বেচ্ছায় করেননি। ভারতীয় অভিজাতদের মতোই ড. ইউনূস ধারণা করতেন তিনি প্রচলিত আইনের উর্ধে। এখানে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গটিও প্রাসঙ্গিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের অনুপস্থিতি কোন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে বেরিয়ে আসেনি। অর্থনীতিতে তাঁর নোবেলে পুরস্কার জয় এমন ব্যতিক্রমী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এমন প্রতিভাবান কিংবা ব্যতিক্রমী ভারতীয় হওয়ার মানে এই নয় যে, তিনি আইনের উর্ধে। অন্য ভারতীয়দের মতোই প্রচলিত আইন তাঁর ওপরও প্রযোজ্য। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশেষ অধিকারবলে কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় অনিয়মের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ তাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে প্রদান করে। ইউনুসের মতো তিনিও বয়সসীমা অতিক্রম করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের এই যোগ্যতার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নিয়োগ যথার্থ হয়নি বরং তা এক একটি বিরাট কেলেঙ্কারি। অমর্ত্য সেনের সঙ্গে আমার বেশকিছু পাবলিক পলিসি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, যা নিয়ে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সামনে একটি বিতর্ক আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্ত অমর্ত্য সেন সে বিতর্কে অংশ নিতে অনীহা দেখান। যে কারণে প্রশ্ন উঠেছে বিতর্কে অংশগ্রহণ করলে কি তাঁর ভাবমূর্তির ক্ষতি হতো? একজন নোবেল বিজয়ী ভারতীয় কি মনে করেন, তিনি ভিন্ন মতামত বরদাশত করবেন না। এছাড়া নীতি আয়ংয়ের ভাইস চেয়ারম্যান অরবিন্দ প্যানাগেরিয়ার সঙ্গে একটি টিভি শোতে অমর্ত্য সেনের বিরক্তি প্রকাশ পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। যখন অমর্ত্য সেন অরবিন্দ প্যানাগেরিয়ারকে তীব্র ভর্ৎসনা করে বলেন, নিউইয়র্কে থাকার কারণে তিনি চিঠিটির সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। বিষয়টি হিতে বিপরীত হয় যখন ড. প্যানাগেরিয়া জানান, অর্মত্য সেন ক্যামব্রিজ থাকেন এবং প্যানাগেরিয়ার চেয়ে কম সময় ভারতে অবস্থান করেন। এ ধরনের আচরণ এখন ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র যা আমাকে ভীত করে। আপনি যদি বিমানবন্দরে যান, দেখবেন কিছু মানুষ নিরাপত্তা তল্লাশির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে। এ তালিকায় আছেন রবার্ট ভদ্র। কেবল নেহরু-গান্ধী পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে অন্য ভারতীয়দের থেকে রবার্ট ভদ্রকে আলাদা করে দেখা হয়। আমি নিজের আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৬২ সালে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে ভারতের পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করার সময় একজন অর্থনীতিবিদের স্ত্রী আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সত্যিকার অর্থে এ ধরনের প্রবণতা আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির অংশ। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত বেশ প্রশংসনীয়। তিনি আশা করেন, সকলেই প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখবেন এবং নিজেকে ব্যতিক্রম ভাবার চিন্তা বাদ দেবেন। লর্ড এ্যাক্টনের একটি বহুল প্রশংসিত উদ্ধৃতি আছে- অসীম ক্ষমতার ফলাফল হলো চরম দুর্নীতি। আমি এ উদ্ধৃতির সঙ্গে আরও যুক্ত করতে চাই- অসীম ক্ষমতাহীনতাও চরম দুর্নীতি তৈরি করে। বর্তমানে আমাদের প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বদের প্রচলিত আইন হতে অব্যাহতি পাওয়ার মানসিকতা পরিত্যাগ করা উচিত। অসীম ক্ষমতা ব্যবহারের যে প্রবণতা তা পরিহার বরং সমতাবাদী মানসিকতা পোষণ। দেশের সাধারণ নাগরিকদের মতোই তাদের প্রচলিত আইন মেনে চলা উচিত। লেখক : ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক
×