ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিঃশব্দতার চাপাতি ও জীবন বাঁচাতে জীবন

প্রকাশিত: ০৪:২২, ১২ মার্চ ২০১৫

নিঃশব্দতার চাপাতি ও জীবন বাঁচাতে জীবন

ব্লগার, মুক্তমনা লেখক অভিজিত রায়ের মৃত্যুতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ শোকাভিভূত। ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে সন্দেহভাজন ফারাবীকে। সন্দেহের তালিকায় অনেকে আছে। এ হত্যাকা- নিয়ে সরকার তদন্ত করছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকেও এফবিআই এসেছে অধিকতর তদন্তের জন্য। দেখা যাক সামনের দিনে এ তদন্ত কোন্্ দিকে যায়। (১১ মার্চের পর) সে দেখেছে একেবারে কাছে দাঁড়ানো পুলিশ বা পথচারী কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। এর মধ্যে পড়ে থাকা নারী উঠে বসেছেন। “আমি তাঁর হাত ধরে বলি, চলেন। তিনি আমার দিকে তাকান। এমন ভয়ঙ্কর দৃষ্টি আমি কখনও দেখিনি। তাঁর মাথা থেকে রক্ত পড়ছিল।” ‘কড়ির মতন সাদা মুখ তার, দুইখানি হাত তার হিম; চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে।’ জীবনের কথা শুনে জীবনানন্দ দাশের কবিতার চরণ মনে পড়ল। জীবন জানায়, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে নারী উঠে দাঁড়ালেন। যেন এক ঘোরের মধ্যে আছেন তিনি। “কি হয়েছে, কে পড়ে আছে?” সম্মোহিতের মতো কথা বলছিলেন রক্তে ভেজা সেই নারী। ‘কাপাইছে’ - কেউ একজন বলে। ‘অভিজিত উঠো।’ উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মানুষটির শরীর একটু কেঁপে ওঠে। বেঁচে আছেন অভিজিত। তাঁকে ওঠাতে চেষ্টা করেন নারী। ‘আপনারা একটু আসেন, ধরেন।’ নারীর এই আর্ত আবেদনে কেউ সাড়া দেয় না। কাছে দাঁড়ানো পুলিশও এগিয়ে আসে না। জীবন তার প্রশিক্ষণের কঠোর অনুশাসন বিস্মৃত হয়। সিদ্ধান্ত নেয় সে। দ্রুত ছবি তোলা দরকার। পড়ে থাকা মানুষটিকে হাসপাতালে নেয়া দরকার। “স্যার, মুহূর্তে তিনটা ক্লিক করি। তার দুটোতে ছবি ওঠে। একটি আউট অফ ফোকাস হয়ে যায়।” জীবন কাজে নেমে পড়ে। পুলিশ বা কেউ এগিয়ে আসে না। “আপু, একটা হাত ধরেন।” আরেক হাত ধরে জীবন তাকে ওঠাতে চেষ্টা করে। এবার কয়েক পথচারী এগিয়ে আসেন। একটা সিএনজি বড় দরকার। বহু মানুষ জড়ো হয়েছে। কেউ সিএনজি ডাকে না। অভিজিতকে ছেড়ে জীবন ছুটে যায় রাস্তায়। প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসা সিএনজির সামনে দাঁড়ায় দু’হাত প্রসারিত করে। এক অনুরোধেই দু’জন আরোহী নেমে যান। এবার নানা মতামত আসতে থাকে। সিএনজিতে এমন দীর্ঘদেহী মানুষকে ওঠানো যাবে না। এসব গবেষণায় মূল্যবান কিছু সময় নষ্ট হয়। জীবন ভাবে রাস্তা থেকে সিএনজিতে করেই তো আহতদের হাসপাতালে নেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তাই হয়। অভিজিতের পা দুটো অবশ্য বাইরেই থাকে। “মাঝখানে বসা আপু তাঁকে দু’হাতে ধরে রাখেন। কিন্তু তাঁর মাথা আমার কাঁধে এসে পড়ে। কাটা খুলির ধারালো প্রান্ত আমার কাঁধে খোঁচা দিচ্ছিল। রক্ত ও মগজে আমার টিশার্ট মাখামাখি। এক হাতের তালু দিয়া আমি খুলির খোলা জায়গাটা চাপ দিয়ে রাখছিলাম যাতে ঘিলু আর না বেরোয়।” এরপর এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলে জীবন। “সিএনজি ভুল কইরা বাংলা একাডেমির রাস্তায় ঢুইকা পড়ে। ‘কে আপনি, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’ আপু চিৎকার কইরা বলেন। যতই বলি ঢাকা মেডিক্যালে, আমার কোন কথা বিশ্বাস করেন না। ড্রাইভারকে বলেন থামাতে। সিএনজির বন্ধ গ্রিলে হাত দিয়া বাড়ি দিতে থাকেন আপু। পাগলের মতো আমাকে বলতে থাকেন, ‘প্লিজ আমাকে মারবেন না। ছেড়ে দেন।’ রাস্তায় তখন অনেক মানুষ। আপুর চিৎকার শুনে পাবলিক সিএনজি থামাইতে পারত। আমি কিডন্যাপ কইরা নিয়া যাইতেছি, এইটা মনে করতে পারত। গণপিটুনির কবলে পড়তে পারতাম আমি। ভাগ্য ভাল, মোটরবাইকে পিছনে আসছিল পুলিশ। দোয়েল চত্বরের আগের গেটে দাঁড়ানো পুলিশ আমাদের থামায়। সব শুনে আমাদের যাইতে দেয়। স্যার, মেডিক্যালের ইমারজেন্সিতে কম ঝামেলা হয় নাই। আমারেই সন্দেহ করে অনেকে। এইসব কারণেই হয়ত অফিস আমাদের ঝক্কি-ঝামেলায় জড়াইতে না করে।” তারপরও ঝক্কি-ঝামেলায় জীবন জড়িয়েছিল। তার কথা এ লেখার শেষে আবার একটু বলব। বসার ঘরে স্যারের অপেক্ষায় বসে থাকার সময় জীবনের কথাগুলো মনে পড়ে গিয়েছিল। পাশের ঘর থেকে স্যার এলেন। বললেন, ‘একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ তাঁর চেহারা শান্ত, সমাহিত। যেমনটা সব সময় দেখে এসেছি। উজ্জ্বল ফর্সা মায়াময় মুখে মৃদু হাসিটি এখনও আছে। ভাবলাম, কেমন করে তা সম্ভব! “প্রধানমন্ত্রী পরদিন ফোন করেছিলেন বাবাকে। অনেকক্ষণ কথা বলেছেন।” অভিজিতের ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর মুখে এ কথা শুনে ভাল লাগে। মনে প্রশ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নিহত ব্লগার রাজীবের বাড়িতে গিয়ে পিতামাতাকে সান্ত¡¡না দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, রাজীব দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ। কিন্তু অভিজিতের মৃত্যুর পর তেমন কোন সংবাদ দেখিনি। প্রধানমন্ত্রীর ফোনের কথা শুনে বলি, “কই, গণমাধ্যমে তো এ খবর আসেনি।” আমার এ কথা শুনে একটু ক্ষুব্ধ হন তাঁরা। “সে জানাবার দায়িত্ব তো আমাদের নয়।” সত্যিই তো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতর আছে, প্রেস সচিব ও উপদেষ্টারা আছেন। তাঁদেরই তো জানাবার কথা। আরও অবাক হই একথা শুনে যে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বাসায় এসে সমবেদনা জানিয়ে গেছেন। গণমাধ্যমে তা প্রচারিত হয়নি। “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার ছাত্রীসম। তাঁর কাছে আকুল আবেদন, লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশে ঘাতক জঙ্গীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন, এদের হাত থেকে আমাদের বাঁচান।” ঘাতক জঙ্গীদের প্রচারণা এবং শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে অভিজিতের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষকসম অধ্যাপক অজয় রায়কে প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বিস্ময়ের এবং আতঙ্কের কথা, সে সংবাদটি পর্যন্ত জনগণকে জানানো হলো না। চারজন আলোকিত মন্ত্রী তাঁর বাসায় এলেন, কিন্তু সে সংবাদ গোপন রাখা হলো। কি ভেবেছেন তাঁরা? এতে তাঁরা বেঁচে যাবেন ওই জামায়াতী ঘাতকদের হাত থেকে? নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের ভোট কমে যাবে? ‘নিঃশব্দতার চাপাতি’ - হিমশীতল এই কথাটি কেন মনে এলো? কি বার্তা দিতে চান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর আলোকিত মন্ত্রীরা? তাঁরা কি বিস্মৃত হয়েছেন দূর এবং নিকট অতীতের কথা? বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কথা? ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের কথা বলছেন বঙ্গবন্ধু। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান। বহু অর্থের মালিক তিনি। বঙ্গবন্ধু বলছেন, “বেশি টাকা খরচ করার সামর্থ্য আমার ছিল না।” নিতান্ত গরিব জনসাধারণ ও ছাত্র এবং যুবক কর্মীরা নিজেদের টাকা খরচ করে বঙ্গবন্ধুর জন্য কাজ শুরু করে। “কয়েকটি সভায় বক্তৃতা করে বুঝতে পারলাম, ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করবেন। ...জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভাল না, তখন এক দাবার ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। ... ‘আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।’ শরশিনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায় তা দিতে কৃপণতা করলেন না।” বঙ্গবন্ধু আরও জানান কিভাবে সরকারী প্রশাসন ও পুলিশ খোলাখুলি মুসলিম লীগ প্রার্থীর জন্য কাজ করেছিল। তারপরও ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু জয়ী হয়েছিলেন। নির্বাচনে পুরো পূর্ব পাকিস্তানের চিত্র ছিল একই। এ থেকে বঙ্গবন্ধু যে গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষাটি পেয়েছিলেন তা তিনি বিবৃত করেছেন এভাবে, “এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে ‘ইসলাম ও মুসলমানের নামে’ সেøাগান দিয়ে ধোঁকা দেয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালী মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না- এ ধারণা অনেকের হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা : ২৫৫-২৫৮) ৫৪ সালের এই অভিজ্ঞতার আরও উজ্জ্বল নিদর্শন ৭০-এর নির্বাচন ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলমানের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের সেইসব গৌরবময় অতীতকে কি নির্দ্বিধায় আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতারা ভুলে বসেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কি ভুলে গেছেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইসলামের নামে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দালালদের গণহত্যার বিরুদ্ধে জাতির পিতার আহ্বানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিল; বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে তাঁর নামটি জপ করেই জীবন দিয়েছিল অকাতরে এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। ‘আমরা সবাই এদেশের সন্তান’- এই বিশ্বাসে একত্র হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান-আদিবাসীরা। তারই ফসল আমাদের সংবিধান যাতে চার মৌলনীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতা। (বাকী অংশ আগামীকাল)
×