ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গুড লাক বাংলাদেশ, এগিয়ে যাও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১১ মার্চ ২০১৫

গুড লাক বাংলাদেশ, এগিয়ে যাও বাংলাদেশ

গত ৯ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার এ্যাডিলেড ওভালে ইংল্যান্ড-বাংলাদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেট ম্যাচটির দিকে ছিল বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের চোখ। খেলার শেষ পর্যায়ে যখন ম্যাচে চরম নাটকীয়তা ও উত্তেজনা তখন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিল। ইংল্যান্ডের শেষ ব্যাটসম্যান এ্যান্ডারসন রুবেলের বলে আউট হলে গর্জে ওঠে বাংলাদেশ, ক্রিকেট পরাশক্তি ইংল্যান্ডকে ১৫ রানে হারিয়ে বাংলাদেশের টাইগারদের এ্যাডিলেডের সবুজ ঘাসে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে বিজয়ের গান গেয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ। স্বাধীনতার মাসে বাঙালীর এ বিজয়, টাইগারদের এ বিজয় এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে পৌঁছে দিল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে। যাদের আত্মত্যাগে এ দেশ, সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধার উদ্দেশে উৎসর্গ করার মতো এর চেয়ে বড় উপলক্ষ হতেই পারে না। মাশরাফি তাই এ জয় দেশের শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করে দিলেন। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এর আগে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ মাত্র একবারই প্রথম পর্ব পেরিয়ে সুপার এইটে উঠেছিল, তখন কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল না। বাংলাদেশের অভূতপূর্ব এ বিজয়ের পর আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মতিহারে ও এর আশপাশে এবং রাজশাহী শহরে হাজার হাজার ছাত্র জনতার মিছিলের পর মিছিল, এক অনাবিল আনন্দ উচ্ছ্বাস আর বিজয়ের উত্তাপে বার বার কেঁপে উঠছিল মানুষের স্রোত। এ রকম আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা থেকে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র। গোটা দেশ ভাসছে আনন্দের জোয়ারে। কবির ভাষায়, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।’ এই লেখা যখন লিখছি, তখনও আনন্দ উৎসবে প্লাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ। এই উচ্ছ্বাস আর বিজয়ের জোয়ার থামবার নয়, চলবে আরও কয়েকদিন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাঙালীর এ বিজয়, এ আনন্দ বাঙালীর সংহতি ও ঐক্যকে সুদৃঢ় করবে নিঃসন্দেহে। এ বিজয় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও দেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে জাগ্রত করবে। যারা বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করতে চায়, তাদের জন্য এই বিজয় একটি মারাত্মক চপেটাঘাত, একটি মোক্ষম জবাব। আমি যখন এ লেখা লিখছি, গৌরবের উত্তেজনায় আমি নিজেই বার বার কাঁপছি। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ বাংলাদেশ ইংল্যান্ডের মতো পরাক্রমশালী একটি রাষ্ট্রকে হারিয়ে দিল, এ যে দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির। লাল-সবুজের পতাকার এ বিজয় বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক, বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার এক নতুন প্রেরণা, বাঙালীর জাগরণের এক নতুন গান। ৯ মার্চ সকাল থেকেই আমার ক্রিকেটপ্রেমী ২ মেয়ে প্রমিতি ও ঊষসী জেদ ধরেছে তারা আজ স্কুলে যাবে না। তারা এই ঐতিহাসিক ম্যাচটির সাক্ষী হয়ে থাকতে চায় এবং বাবার সঙ্গে খেলা উপভোগ করবে। আমি ওদের কথায় রাজি হয়ে যাই। বাংলাদেশের খেলা থাকলেই আমার পরিবারে নানা ধরনের কর্মসূচী পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। যেমন জিতলে কিভাবে পবষবনৎধঃব করা হবে, কোথায়, কিভাবে দেশের লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানো হবে, কী ধরনের খাবার রান্না হবে ইত্যাদি। আর এ ক্ষেত্রে আমার মেয়েদের নির্দেশনা আমরা অনুসরণ করি। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মতো আমরাও সকালে আন্দাজ করেছিলাম এ ম্যাচটি একটি দুর্দান্ত ক্রিকেট ম্যাচে পরিণত হবে। বাংলাদেশকে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সরাসরি খেলার সুযাগ দেয়া ঠিক হবে না বলে দেশগুলো বক্তব্য দিয়েছিল, তাদের জবাব দিয়ে আবারও বাংলাদেশ দেখিয়ে দেবে। শুরুতে পরপর ২টি উইকেট পড়ে গেলে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ভেঙ্গে যায়, বাঙালী আশাহত হয়, আমার ২ মেয়েসহ আমিও ভীষণ মুষড়ে পড়ি, দুঃস্বপ্ন ঘিরে ফেলে আনন্দের শিহরণ। কিন্তু এরপরই ঘুরে দাঁড়াবার সংগ্রাম, জেগে উঠবার উদ্দীপনা, জয়ের পথ নির্মাণে এগিয়ে যাওয়া। ঝলসে ওঠে মাহমুদুল্লাহ্ রিয়াদ ও সৌম্য সরকার। তাঁদের ৯৬ রানের পার্টনারশিপ আশার আলো যখন দেখাতে শুরু করেছে তখনই আউট হয়ে যান সৌম্য। এরপর সাকিব মাঠে নামলে বাংলাদেশ আবার আশায় বুক বাঁধে, সাকিব ত্রাণকর্তা হয়ে বাংলাদেশকে আলোর পথ দেখাবে। কিন্তু মাত্র কয়েকটি বল ফেস করে সে আউট হলে, গোটা গ্যালারিতে বাঙালী দর্শকদের মুখে বিষাদের ছায়া, সে ছায়া ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মাঝে। কিন্তু এরপর মাহমুদুল্লাহ্ ও মুশফিক এই দুই ভায়রা যা করলেন এটা রীতিমতো একটা ইতিহাস, তাঁদের ১৪১ রানের কাব্যিক ইনিংস বাংলাদেশকে নিয়ে গেল অনেক উচ্চতায়। সেই সঙ্গে বিশ্বকাপের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে মাহমুদুল্লাহ সেঞ্চুরি করে ইতিহাসে নাম লেখালেন। রানের পাহাড় না হলেও ২৭৫ রান বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই একটি সম্মানজনক ফাইটিং স্কোর। প্রথম দিকে বাংলাদেশের বোলিং এ্যাটাক ইংল্যান্ডের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও শেষের দিকে ম্যাচটি তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে পরিণত হয়। ম্যাচের ৪৮তম ওভারে তামিম ইকবাল ক্রিসওয়াকসের সহজ ক্যাচ ফেলে দিলে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয় অষ্টম উইকেট থেকে, হতাশার চাদরে ঢেকে যায় বাংলাদেশ। অনেকেই বলতে থাকে ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিস। কিন্তু মাশরাফি আর রুবেলের দুর্দান্ত বোলিং শেষ পর্যন্ত তা হতে দেয়নি। ইংল্যান্ডের শেষ উইকেটটি রুবেল নিলে বাংলাদেশ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, কোটি জনতা মেতে ওঠে বিজয়োল্লাসে, জেগে ওঠে বাংলাদেশ আর ম্যাচের নায়ক রুবেলকে নিয়ে টাইগাররা আনন্দে মাঠে লুটিয়ে পড়লেন। ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং- এই তিনটি ক্ষেত্রেই অসাধারণ লড়াই করেছে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা। ’৭১-এ উত্তাল মার্চে স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াকু বাঙালীরা যেমন বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে, তেমনি এই মার্চ মাসেই আমাদের সোনার ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের লাল-সবুজ পতাকার বিজয় নিশান বিশ্ব দরবারে উঁচিয়ে ধরতে। বাংলাদেশ সফল হয়েছে। ২ মাসেরও বেশি সময় ধরে ২০ দলের অযৌক্তিক অবরোধ, হরতাল আর মানুষ পোড়ানোর সহিংস রাজনীতিতে সমগ্র দেশ যখন অস্বস্তিতে আর শঙ্কায়, ঠিক তখনই বাংলাদেশের এ বিজয় কোটি কোটি মানুষকে করেছে উদ্বেলিত, বাঁধভাঙ্গা আনন্দের জোয়ারে প্লাবিত। কতদিন বাংলাদেশ এ রকম করে হেসে ওঠেনি। বীরের জাতি বাঙালীর এই ক্রিকেট বিজয় আবারও প্রমাণ করল, জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব ক্রিকেটেও। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ মার্চ ২০১৫ তারিখ মঙ্গলবার বাংলাদেশের মানুষকে বিজয় মিছিল করার যে আহ্বান জানিয়েছেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বাঙালীরা সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে মেতে উঠেছে আনন্দে আর উৎসবে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে অভিনন্দন, দোয়া আর শুভকামনা। আমরা আশা করি, শুধু কোয়ার্টার ফাইনালই শেষ নয়, বাংলার টাইগাররা পরবর্তীতে অসাধারণ লড়াইয়ের অবতারণা করে বিশ্বকাপ ছিনিয়ে আনবে, সৃষ্টি করবে জাগরণের এক কাব্যিক ইতিহাস। জয়তু বাংলাদেশ, চিরজীবী হোক বাংলাদেশ। লেখক : শিক্ষক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। Email: [email protected]
×