ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রুবেল বন্দনা

উৎসবপ্রিয় বাঙালী নাচে গানে মাতিয়ে দিল এ্যাডিলেড

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ১১ মার্চ ২০১৫

উৎসবপ্রিয় বাঙালী নাচে গানে মাতিয়ে দিল এ্যাডিলেড

ফজলুল বারী, এ্যাডিলেড ওভাল থেকে ॥ এ্যাডিলেডে যে এত বাংলাদেশী আছেন তা জানত না এ্যাডিলেডবাসী! বাংলাদেশীরা যে আনন্দমুখর উৎসবপ্রিয় হয়, তা তারা জানত না! সবচেয়ে অবাক এ্যাডিলেড ওভালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা! এখানে এর আগে কখনও বাংলাদেশ দলের খেলা হয়নি বলে বাংলাদেশের দর্শক, তাদের বর্ণিল সাজ-পোশাক, উৎসবপ্রিয় মানুষ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না! সোমবার তারা অবাক হয়ে ওভালজুড়ে দেখেছে লাল-সবুজ পতাকার নাচন! ওভালের কর্মকর্তা এ্যান্ড্রু বললেন, সোমবারের খেলায় যে প্রায় চৌদ্দ হাজার দর্শক এসেছেন তাদের সিংহভাগই ছিলেন বাংলাদেশী! তাদের ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ চিৎকারে গান-নাচ-বাদ্য বাদন সবকিছু এক কথায় ওসাম। এমন প্রাণবন্ত দর্শকদের কথা তাদের অনেক দিন মনে থাকবে। সোমবার রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময়টাতেও প্রবাসী বাংলাদেশীদের উৎসব চলছিল এ্যাডিলেড ওভালের বাইরে। হাজার হাজার মানুষ ঢোল-করতালসহ নানা বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচছিলেন আর বিজয়বন্দনা করছিলেন বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ দলের! কারণ দলে জিতেছে। সারাদিন ওভালের নানা অংশজুড়ে যেসব ব্রিটিশ সমর্থক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন, হঠাৎ যেন তাঁরা হাওয়া হয়ে যান! ওভালের সামনে উত্তাল নৃত্য চলছিল নানা বয়সী প্রবাসীর। তাদের মুখে ছিল ক্রিকেটারদের বন্দনা। বিশেষ করে রুবেল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আর মুশফিকের। মেলবোর্ন, সিডনি, ক্যানবেরাসহ অস্ট্রেলিয়ার নানা শহর থেকে আসা প্রবাসীরা এই উৎসবে যোগ দেন। তাঁদের বেশিরভাগ আট থেকে বারো ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে এই খেলা দেখতে এ্যাডিলেড এসেছিলেন! দীর্ঘ ভ্রমণজনিত ক্লান্তি ছিল চোখেমুখে! কিন্তু দল জয়ী হওয়াতে সব ভুলে তারা মেতে ওঠেন উৎসব-আনন্দে। তাঁদের অনেককে সুর করে গাইতে শোনা যায় ‘উসুলরে উসুল পয়সা উসুল’! ‘মাশরাফিরে মাশরাফি পয়সা উসুল’! রুবেলরে রুবেল পয়সা উসুল’! উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অস্ট্রে-লিয়ানকেও নেচেগেয়ে এই উৎসবে শামিল হতে দেখা যায়। উল্লেখ্য, সোমবারের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ান দর্শকরা বাংলাদেশকে সমর্থন করেন। ক্রিকেটে ইংল্যান্ড দল তাদের বহু পুরনো জানি দুশমন! ভারতীয়-পাকিস্তানী দর্শকরা আবার ইংল্যান্ড দলকে সমর্থন করেন! খেলায় বাংলাদেশ দল জয়ী হওয়ার পর এ্যাডিলেড ওভালের বাইরে প্রবাসীরা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরছিলেন আর ঈদের খুশির মতো কোলাকুলি করছিলেন! প্রবাসী বাংলাদেশী এসএ রহমান অরূপ বলেন, এ্যাডিলেড ওভালে এই প্রথম বাংলাদেশ খেলেছে এবং জিতেছে, এই খুশির বিষয়টি আমাদের সারাজীবন মনে থাকবে। কারণ দেশের দল খেলেনি বলে এ্যাডিলেড প্রবাসী বাংলাদেশীদের খুব সংখ্যক এর আগে এ্যাডিলেড ওভালে ঢুকেছেন! ওভালের প্রথম বাংলাদেশী নারী সদস্য নাজিয়া জেরিন হাসান বুলেন, রবিবার রাতে এক অনুষ্ঠানে মাশরাফিদের দেখা হয়েছিল। মাশরাফি তাঁকে তাঁদের জন্য দোয়া করতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জায়নামাজ নিয়ে যাবেন খেলার মাঠে। নাজিয়া বলেন, এভাবে আমরা কতভাবে যে দলের জয় চেয়েছিলাম তা বলে বোঝাবার নয়। দল জিতেছে। আমাদের সবকিছু সার্থক। মেলবোর্ন থেকে আসা ইমদাদুল হক সোমবার ওভালে বাঘ সেজে এসেছিলেন। তাঁর দুই শিশুসন্তানকেও পরানো বাঘের সাজ-পোশাক। দেখে মনে হবে এক বাঘ তার দুই বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! দল জয়ী হওয়ার পর সামনে যাকে পাচ্ছিলেন তাঁকে জড়িয়ে ধরছিলেন ইমদাদুক হক। আর বলছিলেন, আমাদের সব কষ্ট সার্থক। জয় বাংলা। মেলবোর্ন থেকে আসা একেএম ইমরান বলেন, বাংলাদেশ দল এই প্রথম এ্যাডিলেড ওভালের মতো বড় কোন ভেন্যুতে জিতল। এর সাক্ষী থাকতে পারলাম বলে ভাল লাগছে। দল জয়ী হওয়াতে এমন সব পাওয়ার আনন্দ ছিল সব প্রবাসীর আনন্দ উচ্চারণে। রুবেল বন্দনা ॥ সোমবারের স্মরণীয় জয়ের পর এ্যাডিলেড প্রবাসী বাংলাদেশীরা এখন উৎসবমুখর। নানাজনের বাসায় চলছে দাওয়াত আর খানাপিনার পার্টি! বিজয় বন্দনার আসরগুলোতে বেশি চলছে রুবেল বন্দনা। সবার মুখে এক কথা ওই ক্লোজড ম্যাচটিতে আমরা হেরে যেতেও পারতাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দুর্দান্ত বোলিংয়ের মাধ্যমে ম্যাচ বাঁচিয়ে জয় এনে দিয়েছেন রুবেল। এখন কেউ এটিকে বলছেন রুবেল ম্যাজিক। রুবেলের বোলিংয়ে মুগ্ধ এক নারী দর্শক বলেন, রুবেলের সব অপরাধ মাফ। অনেকে রুবেলের ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে খেলোয়াড় জীবনকে গুলিয়ে না ফেলতে অনুরোধ করেছেন। প্রবাসী আসিফ কামাল বলেন, এই ম্যাচকে ঘিরে আমরা অনেক দিনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমরা সবাই দলের কাছে চাইছিলাম একটা উপভোগ্য ম্যাচ এবং জয়। কারণ আমাদের দলটা অনেক বদলেছে, পরিণত হয়েছে বলে এর কাছে আমাদের প্রত্যাশার পারদটা অনেক উঁচুতে চড়েছিল। আমরা ভাগ্যবান যে আমাদের চাওয়ার ষোলো আনাই পেয়েছি সোমবারের ম্যাচে। দলটা এখন আমাদের এমন আস্থার সৃষ্টি করেছে যে, চাইলে আমরা যে কাউকে হারাতে পারি। ম্যাচ উইনিং প্রবণতা যে দলের মধ্যে গড়ে উঠেছে তা সোমবারের খেলায় আরও স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক, সৌম্যসহ অনেকেই ভাল খেলেছেন সোমবারের ম্যাচে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ম্যাচ জিতিয়েছেন রুবেল। আসিফ সবাইকে অনুরোধ করে বলেন, কারও ব্যক্তিগত জীবন আর প্রফেশনাল ক্যারিয়ার যাতে গুলিয়ে ফেলা না হয়। অস্ট্রেলিয়ায় একজনের একাধিক গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে। কিন্তু সবাই তাকে দেখে- তার কাজ দেখে। গার্লফ্রেন্ড দেখে নয়। তায়ীব অনন্ত বলেন, রুবেল প্রমাণ করেছেন তিনি এখন বাংলাদেশ দলের অনেক পরিণত, নির্ভরযোগ্য একজন বোলার। ডেথ ওভারে এখন মাশরাফির মতো রুবেল নির্ভরযোগ্য। কিন্তু সোমবারের ম্যাচে যেখানে ১৬৩ রানে ৬ উইকেট পড়ে গিয়েছিল সেখানে ইংল্যান্ড দল কী করে রান এতদূর নিয়ে যেতে পারল, কেন মাশরাফি আগেই দশ ওভার বল করে ফেললেন, কেন ডেথ ওভারে তাসকিনের মতো একজন অনভিজ্ঞ নতুনের হাতে বল তুলে দেয়া হলো, সামনের ম্যাচকে সামনে রেখে এসব খতিয়ে দেখা দরকার। চন্দ্রবিন্দু ইমরান বলেন, রুবেলের শেষ ওভারে দুর্দান্ত দুই উইকেট আর স্বপ্নের কোয়ার্টার ফাইন্যালে চলে গেলাম আমরা! পুরো বিষয়টি এখনও আমার কাছে স্বপ্নের মনে হয়। চোখ বুঝলেই রুবেলের বল দুটি দেখি যেন ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিচ্ছে ক্রিকেটের উদ্ভাবক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কফিনে! সারাজীবন এ দৃশ্যটি ভুলব না। আজমাল হুদা বলেন, রুবেলের বল দুটিকে মনে হয়েছে যেন ম্যাজিক! আসলে রুবেল ম্যাজিক আমাদের নিয়ে গেছে স্বপ্নের কোয়ার্টার ফাইনালে। পুরো ম্যাচে তামিম ছাড়া সবাই ভাল খেলেছেন। খেলার শ্বাসরুদ্ধকর সময়টায় তামিম ক্যাচটা ফেলে দেয়ায় ভাবছিলাম এই বুঝি আমাদের ম্যাচ মিস! উত্তেজনায় যেন প্রাণ বেরিয়ে যাবে এমন অবস্থা! ওই সময়ে আমাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন রুবেল। তাঁর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এরপর থেকেই মনে হচ্ছে, ইশ রুবেলের জন্য যদি কিছু করতে পারতাম! নীনা রাজ্জাক বলেন, খেলা দেখতে আমরা মেলবোর্ন থেকে এ্যাডিলেড এসেছি। দীর্ঘ ভ্রমণে খুব ক্লান্ত ছিলাম। কিন্তু আমাদের সব ক্লান্তি দূর করে দিয়েছে প্রিয়দলের জয়। আর এই জয় এনে দিয়েছেন রুবেল। তাঁর জন্য প্রাণভরে দোয়া করেছি। আসমা হুদা বলেন, আমি কোনদিন কোন খেলা নিয়ে এতটা উত্তেজনা বোধ করিনি। রুবেল আমাদের জন্য যা করেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়। দেশে তাঁকে নিয়ে যা হয়েছে তা নিয়ে আমাদের আর কোন ক্ষোভ নেই। তাঁর সব অপরাধ মাফ। কারণ রুবেল দেশের জন্য জান দিয়ে খেলেছেন।
×