ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিটি নির্বাচনে থাকছে সব দলই, প্রস্তুতি ॥ মাঠে ১৫ মেয়র প্রার্থী

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ১১ মার্চ ২০১৫

সিটি নির্বাচনে থাকছে সব দলই, প্রস্তুতি ॥ মাঠে ১৫ মেয়র প্রার্থী

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য চাই উপযুক্ত শহর’ পরিচ্ছন্ন মহানগরী গড়ে তোলার এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঝুলছে অসংখ্য বিলবোর্ড। আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকন এভাবেই প্রচার শুরু করেছেন। পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে প্রচারে মাঠে নেমেছেন ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজী মোঃ সেলিম। নির্বাচনের জন্য তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণাও দিয়েছেন। উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার প্রচারণায় মাঠে নেমেছেন। যদিও উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ব্যবসায়ী আনিসুল হক। সব মিলিয়ে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে রাজধানীজুড়ে। কমবেশি সরব সব দলের মেয়র প্রার্থীরা। বসে নেই সম্ভাব্য ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও। জনসংযোগে নেমেছেন অনেকে। এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে সম্ভাব্য প্রার্থী অন্তত ১৫ জন। বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রায় ১৩ বছর পর নির্বাচন ॥ সর্বশেষ ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছিল ২০০২ সালের ১৫ মে। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় সাদেক হোসেন খোকা তখন মেয়র নির্বাচিত হন। নানা কারণে নির্বাচন করতে না পারায় প্রায় দুই মেয়াদ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৭ সালের ১৪ মে এর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। ২০১১ সালের ২৯ নবেম্বর জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা হয়। উত্তরে ৩৬টি ওয়ার্ড ও দক্ষিণে ওয়ার্ডের সংখ্যা ৫৬টি। এরপর থেকেই প্রশাসক দিয়ে চালানো হচ্ছে মেয়রের দায়িত্ব। একজন প্রশাসক ৬ মাস দায়িত্ব পালন করছেন। ১৩ বছর পর সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নগরীতে ভিন্ন রকম আবহের সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। এর আগে ২০১২ সালে ২৯ এপ্রিল একবার তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এতে ২৪ মে নির্বাচনের দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু ভোটার তালিকা ও সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় নির্বাচনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। এরপর ২০১৩ সালের ১৩ মে আদালত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। আবার ওই বছরের অক্টোবর-নবেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দেয় কমিশন। কিন্তু ঢাকার সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন ঢাকা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় আবারও দেখা দেয় জটিলতা। এরপর নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়- দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ডিসিসি নির্বাচন দেয়া হবে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণার পরই নির্বাচনের আশা জাগ্রত হলো। জানতে চাইলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে গণফোরামের সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, দুই সিটি করপোরেশনে মেয়র প্রার্থী দেয়ার চিন্তা চলছে। নির্বাচনের পরিবেশ থাকলে চূড়ান্তভাবে অংশ নেবে ড. কামাল হোসেনের দল। তিনি জানান, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে প্রার্থী দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। উত্তরের প্রার্থী এখনও ঠিক হয়নি। দলের পক্ষ থেকে আগামী মাসেই আনুষ্ঠানিক প্রার্থী ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানান তিনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে ব্যাপক প্রচার অভিযানে নেমেছেন সাঈদ খোকন। ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের ছেলে এই সাঈদ খোকন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হয়েই লড়বেন নগরের দক্ষিণাংশের নির্বাচনী লড়াই। বলা হচ্ছে দলের সমর্থন তিনি পেয়েছেন। প্রস্তুতি প্রসঙ্গে সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন পরিচালনায় বাস্তব অভিজ্ঞতা এখনও নেই, তবে বাবার কর্মময় জীবন থেকে যতটুকু শিক্ষা নিতে পেরেছি তা দিয়েই চালাব। তিনি বলেন, ঢাকার পঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানে মেট্রোপলিটন গবর্নমেন্ট (নগর সরকার) একটি বাস্তবসম্মত ধারণা। কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করতে এটাই হবে সময়যোপযোগী ব্যবস্থা। একটি আধুনিক, পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত নগরী গড়ে তোলার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এই সরকার নগরের সব কাজের সমন্বয় করবে। এখন টেলিফোনের তারের জন্য একবার রাস্তা খোঁড়া হয়। আবার বিদ্যুত ও গ্যাসের লাইনের জন্য তাদের সময়মতো রাস্তা কাটছে। কেউ কারোটা জানে না, কিংবা সমন্বয় নেই। এতে একদিকে যেমন জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে অন্যদিকে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন কয়েকদিন আগে যে রাস্তা মেরামত করছে ডিসিসি সেই রাস্তায় পানির পাইপ বসানোর জন্য নতুন করে কাটা হচ্ছে। নগর সরকার ব্যবস্থা হলে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে একবারে এসব কাজ করা যাবে। এভাবে সবকাজই নগর সরকারের অধীনে সমন্বয় হবে। জানতে চাইলে হাজী সেলিম বলেন, আমি দুই বছর আগে থেকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। এরমধ্যে সংসদ নির্বাচন সামনে আসায় প্রার্থী হয়েছিলাম। তিনি বলেন, সিটি নির্বাচনের জন্য আমি নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। আশাকরি দলের পক্ষ থেকে সমর্থন পাব। না হলেও এককভাবে নির্বাচন করব। প্রচার প্রচারণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখনও নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা করেনি কমিশন। তাই প্রচারে সমস্যা নেই। তাছাড়া সাধারণ মানুষ প্রচার প্রচারণায় নেমেছে। তারাই ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড টানাচ্ছেন। তফসিল ঘোষণা হলে নির্বাচনী আচরণবিধি যেন কোন ভাবেই ভঙ্গ না হয় এ ব্যাপারে সচেতন থাকব। সরকার পতনের আন্দোলনে থাকলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। ইতোমধ্যে দলের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীরা কাজ শুরু করেছেন। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরে মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনিই এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে দলের পক্ষে সমর্থন পেতে যাচ্ছেন। দক্ষিণে মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন। এছাড়াও দক্ষিণে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মীর্জা আব্বাস ও মহানগর নেতা আব্দুস সালাম প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন। রাজনৈতিক কারণে ২০ দলের অন্যতম শরিক জামায়াত কিছুটা বেকায়দায়। এরপরও মেয়র প্রার্থী দেয়ার চিন্তা করছে দলটি। সর্বশেষ মেয়র না হলেও কাউন্সিলর প্রার্থী দেবে জামায়াত। এদিকে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে রবিবার প্রার্থী ঘোষণা করেছেন দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দক্ষিণে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন ও উত্তরে দলের যুগ্ম মহাসচিব বাহাউদ্দিন বাবুল। নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু জনকণ্ঠকে বলেন, দুই সিটি করপোরেশনে মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত। ইতোমধ্যে তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছেন। ওয়ার্ড পর্যায়ে কাউন্সিলর প্রার্থী দেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, জাপা সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সকল ওয়ার্ডে দলের সমর্থিত প্রার্থী থাকার কথা জানান তিনি। এদিকে বিকল্পধারার পক্ষ থেকেও নির্বাচনে অংশ গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। চলতি মাসেই আনুষ্ঠানিক প্রার্থী ঘোষণা আসতে পারে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহি বি চৌধুরী উত্তরের মেয়র প্রার্থী হতে পারেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পক্ষ থেকে মেয়র পদে প্রার্থী প্রায় চূড়ান্ত। দক্ষিণে কেন্দ্রীয় নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স ও উত্তরে দলের জাতীয় পারিষদ সদস্য কাফি রতনকে দলীয় সমর্থন দেয়া হবে। জানতে চাইলে রুহিন হোসেন প্রিন্স জনকণ্ঠকে বলেন, একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। গণতন্ত্রী পার্টির সহ-সভাপতি নূরুর রহমান সেলিম জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী দুই দিনের মধ্যে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি দলীয় বৈঠকে চূড়ান্ত হবে। অনেকেই মেয়র প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুারো সদস্য বিমল বিশ্বাস জনকণ্ঠকে বলেন, দলের পক্ষ থেকে মেয়র প্রার্থী দেয়ার বিষয়টি এখনও ঠিক হয়নি। কাউন্সিলর প্রার্থী দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি। প্রার্থী দেয়ার চিন্তা করছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদও। এর আগেও নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্বে জাসদ থেকে মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন শিরিন আখতার। বর্তমানে তিনি সাংসদ হলেও দলের পক্ষে প্রার্থী দেয়ার বিষয়ে একমত কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে। উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন প্রস্তুতির কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা ॥ ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচন খুব একটা উৎসবমুখর ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে তা বলা যাবে না। তাই সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানটি হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। মোটকথা হলো দলীয় ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, শুধু তফসিল ঘোষণা করলেই হবে না, সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সিডিউল ঘোষণার পর নির্বাচনের জন্য মানুষকে উৎসাহী করে তুলতে নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে হবে। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সিটি করপোরেশন নির্বাচন খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন তিনি। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, দীর্ঘদিন পরে সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। নির্বাচনকে ঘিরে পুরো নগরীতে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সব মানুষ নির্বাচনে অংশ নেবে। অর্থাৎ সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলেই সার্থক নির্বাচন হবে বলে মনে করেন তিনি।
×