ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াত-শিবিরের নাশকতা ॥ বিপজ্জনক জেলা চাঁপাই ও জয়পুরহাট

শিবগঞ্জ-পাঁচবিবি ॥ সন্ধ্যা নামলেই ভয়ঙ্কর জনপদ

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১০ মার্চ ২০১৫

শিবগঞ্জ-পাঁচবিবি ॥ সন্ধ্যা নামলেই ভয়ঙ্কর জনপদ

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ বিএনপি-জামায়াত জোটের নাশকতা কর্মকা- এখন বেশি সংঘটিত হচ্ছে উত্তরের সীমান্তবর্তী দুই জেলায়। রাজশাহী সীমান্তের চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ আর জয়পুরহাট জেলায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে জামায়াত-শিবির। সীমান্ত এলাকাসংলগ্ন উত্তরের দুই জেলার মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত। জনরোষে রাজশাহী বিভাগের অন্যান্য জেলায় তুলনামূলক নাশকতা ও সহিংসতার মাত্রা কিছুটা কমলেও সন্ধ্যা লাগলেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও জয়পুরহাট হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর জনপদে। গত দুই সপ্তাহ ধরে এ দুই জেলায় সবচেয়ে বেশি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যে স্থানীয় জনগণ এ দুই জেলায় প্রতিরোধ গড়ে তুলে নাশকতাকারীদের গণধোলাই দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিলেও অজানা ভীতি কাজ করছে এ দুই জেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে। অবস্থানগত কারণেই সীমান্তঘেঁষা এ দুই জেলায় সবচেয়ে সক্রিয় অবস্থানে থেকে জামায়াত-শিবির একের পর এক নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে কিংবা খুব ভোরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়িয়ে চালাচ্ছে একের পর এক সহিংসতা। এ প্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে। এ দুই জেলায় গত দুই মাসে চলমান কর্মসূচীতে জামায়াত-শিবির চক্র নাশকতার ঘটনা ঘটিয়েছে অন্তত দেড় শতাধিক। তাদের নাশকতার আগুনে দগ্ধ হয়েছে অন্তত ৩০ জন। আর প্রাণ হারিয়েছে ৭ জন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে ভীতিকর জোন হিসেবে পরিণত হয়েছে সীমান্তঘেঁষা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আমবাগানবেষ্টিত জেলার সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ ও ডেঞ্জার পয়েন্ট হলো শিবগঞ্জ। সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে সূর্য মিলিয়ে অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে উপজেলার গ্রামাঞ্চলের মানুষ এক ভীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাই জরুরী প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বাইরে বের হচ্ছে না। এ উপজেলায় আওয়ামী লীগকর্মীরা বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার ভয়ে অনেকে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। প্রশাসন মাঠে থাকলেও তাদের (জামায়াত-শিবির) রুখতে ব্যর্থ হচ্ছে অনেকাংশে। গত ২ মাসে শুধু শিবগঞ্জ উপজেলায় জামায়াতি তা-বে প্রাণ হারিয়েছেন ৪ জন সাধারণ মানুষ। এছাড়া ট্রাকে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ১৭টিতে। শতাধিক ট্রাকে ভাংচুর চালিয়েছে অবরোধ ও হরতাল সমর্থকরা। তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি শিবগঞ্জ মেডিক্যাল মোড়ে ককটেল হামলায় মানিরুল ইসলাম নামের একজন আহত হন। ২০ ফেব্রুয়ারি শাহবাজপুর এলাকায় আওয়ামী লীগকর্মী আব্দুর রহমানকে প্রকাশ্যেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৩ মার্চ রাতে একই সঙ্গে কানসাট ও শিবগঞ্জ একাডেমি মোড়ে ৩ ট্রাকে, ভোরে কানসাটের কলাবাড়িতে একটি কার্গোতে এবং দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের শান্তিমোড় ও হরিপুরে ৩টি ট্রাক জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ৪ মার্চ গোমস্তাপুরে একটি আলুবোঝাই ট্রাকে এবং সর্বশেষ ৫ মার্চ দিবাগত রাতে একটি কাভার্ডভ্যানে ও সোনামসজিদ কয়লাবাড়ি ট্রাক টার্মিনালে পার্ক করে রাখা খালি ও পণ্যবোঝাই ৯টি ট্রাকে অগ্নিসংযোগ করে জামায়াত-শিবির। একই সময় শিবগঞ্জ পৌর এলাকার একরামুল হক নামের আওয়ামী লীগকর্মী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাদের কুপিয়ে আহত করা হয়। এ সব ট্রাকে হামলার ঘটনায় কানসাটে ও গোমস্তাপুরে ২ জন দগ্ধ হয়ে নিহত এবং মৃত্যুর সঙ্গে রামেক হাসপাতালে লড়ছেন আরও ৩ জন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে একের পর এক মামলা হয়েছে। চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চিরুনি অভিযান। তারপরও থেমে নেই নাশকতা। শিবগঞ্জের কানসাট এলাকার ব্যবসায়ী আজিজুর রহামান বলেন, দিনের বেলা সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও রাতের পরিস্থিতি রীতিমতো যুদ্ধাবস্থার মতো। সন্ধ্যা লাগার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষ ঘরবন্দী থাকলেও নাশকতাকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সকাল হলেই তারা খবর পাচ্ছেÑ হয় ট্রাক পুড়েছে, নয়ত বাড়ি লুটপাট হয়েছে, অথবা পেট্রোলবোমায় মানুষ মরেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার বশির আহম্মদ পিপিএম বলেন, আম বাগানবেষ্টিত উপজেলা ও বিচ্ছিন্ন এলাকা হওয়ায় এখানে সহিসংতার মাত্রা তুলনামূলক বেশি। তবে পুলিশ শক্তহাতে তাদের দমনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ইরতিজা আহসান বলেন, প্রশাসনের সহায়তায় প্রতিদিন গড়ে ৫শ’ পণ্যবাহী ট্রাক দেশের অভ্যন্তরে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। এদিকে জয়পুরহাটেও নাশকতার মাত্রা কম নয়। যদিও জেলা পুলিশ সুপার আবু কালাম সিদ্দিকের দাবি, এখানে নাশকতার ঘটনা কম। তারপরও গত দুই সপ্তাহে জেলার সীমান্তঘেঁষা পাঁচবিবি ও ক্ষেতলালে নাশকতার মাত্রা বেড়েছে হঠাৎ করে। স্থানীয়রা জানান, বিগত সময়ে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ‘চাঁদে দেখা’ গুজবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল এ দুই উপজেলা। তারপর থেকে স্থানীয় অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ভয়ে বসবাস করেন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়। এই সুযোগে চলমান পরিস্থিতিতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে জেলার দুই উপজেলা। গত দুই মাসে এ উপজেলায় নাশকতার ঘটনায় তিনজন প্রাণ হারিয়েছে। সর্বশেষ রবিরার একজনের মৃত্যু হয় নাশকতায়। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, জেলা সদরের আমদই, পাঁচবিবির কুসুম্বা, সালাইপুর ও ধরঞ্জি ইউনিয়ন বেশি ভয়ঙ্কর। রাতের বেলা এ সব ইউনিয়নে পুলিশও অভিযানে যেতে ভয় পায়। তবে সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন স্থানে জনগণ নাশকতাকারীদের রুখে দিতে সক্রিয় হয়েছে। সর্বশেষ রবিবার নাশকতাকারী ৬ শিবিরকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দিয়েছে। তারপরও জেলা সদর ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলায় রাতের আঁধারে একের পর নাশকতা চালাচ্ছে জামায়াত-শিবির। জয়পুরহাট জেলা পুলিশ সুপার আবু কালাম সিদ্দিক দাবি করেন, এ জেলায় তুলনামূলকভাবে সহিংসতা কম। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, এখন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আনসার ও কমিউনিটি পুলিশকে নাশকতার বিরুদ্ধে সজাগ করতে পুলিশ কাজ করছে। এদিকে রাজশাহীর ভয়ঙ্কর জোন হিসেবে এখন নতুন জনপদে পরিণত হয়েছে জেলার চারঘাট ও বাঘা উপজেলা। এ দুই উপজেলায় প্রায় রাতের আঁধারে ঘটছে নাশকতার ঘটনা। বিশেষ করে সরকারী স্থাপনাকে নাশকার টার্গেট করে রাতের আঁধারে নামছে জামায়াত-শিবির। এ দুই উপজেলায় গত দুই সপ্তাহে ভূমি অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিস ও সর্বশেষ টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার আলমগীর কবির জানান, নাশকতাকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর ভূমিকা পালন করছে। আগের চেয়ে রাত্রিকালীন টহল জোরদার করা হয়েছে। নাশকতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন কার্যক্রম করছে পুলিশ।
×