ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:১০, ১০ মার্চ ২০১৫

ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ

* সেঞ্চুরিয়ান রিয়াদের অসাধারণ ব্যাটিং * রুবেলের দুর্দান্ত বোলিং * ইংল্যান্ডকে উড়িয়ে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মাশরাফিবাহিনী * ইংল্যান্ডের করুণ বিদায় * বাংলাদেশ ২৭৫/৭ (৫০ ওভার), ইংল্যান্ড ২৬০/১০ (৪৮.৩ ওভার) * টাইগাররা ১৫ রানে জয়ী মিথুন আশরাফ ॥ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৫ রানে ম্যাচটি জিততেই সবার মুখে মুখে কয়েকটি শব্দই শোনা যায়, ‘রুবেলের সব মাপ’, ‘রুবেল এখন ভীষণ হ্যাপি’। জিততে ১২ বলে ১৬ রান দরকার ছিল ইংল্যান্ডের। এমন উত্তেজনাকর, রোমাঞ্চকর মুহূর্তে রুবেল কী কাজটিই না করে দিলেন। ইংল্যান্ডের শেষ ২টি উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচই জিতিয়ে দিলেন। তাঁর এ দুর্দান্ত বোলিংয়ে ইতিহাসই গড়ে ফেলল বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেল মাশরাফিবাহিনী। সেই ইতিহাসের মধ্যে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদও একটি ইতিহাস গড়লেন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করলেন। ১৩৮ বলে ৭ চার ও ২ ছক্কায় ১০৩ রান করলেন। যে সেঞ্চুরিই মূলত বাংলাদেশকে জেতার ভিত গড়ে দিল। জিতেও গেল বাংলাদেশ। রিয়াদের শতকে ৭ উইকেটে ৫০ ওভারে ২৭৫ রান করে বাংলাদেশ। রুবেল হোসেনের (৪/৫৩) গতির সামনে শেষপর্যন্ত ৪৮.৩ ওভারে ২৬০ রান করতেই অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। কী উত্তেজনা ম্যাচে। কী রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়ে। একবার বাংলাদেশের দিকে ম্যাচ হেলে পড়ে। আরেকবার ইংল্যান্ডের দিকে। ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচই ছিল। যে জিতবে, সেই দলই ‘কোয়ার্টার ফাইনালে’ খেলবে, তা ধরেই নেয়া হয়েছিল। দুই দলের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটিই বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচকে ‘প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল’ বানিয়ে ফেলেছিল। শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ যে এ বিশ্বকাপের সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলবে। বাংলাদেশের শেষ ম্যাচে জেতা কঠিন। সেই তুলনায় ইংল্যান্ড খেলবে দুর্বল আফগানিস্তানের বিপক্ষে। ইংল্যান্ড তো জিতবেই। আর তাই যে দল সোমবার জিতবে, তারাই নক আউট পর্বে খেলবে, এমন ধারণাই করা হয়েছিল। এতসব হিসেবে যেতেই হয়নি বাংলাদেশকে। রোমাঞ্চ তৈরি হয়েছে। সেই রোমাঞ্চকর ম্যাচে জিতেই কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশই। এক ম্যাচ হাতে রেখেই কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা নিশ্চিত করে নিয়েছে বাংলাদেশ। আর ইংল্যান্ডেরও এক ম্যাচ থাকতেও বিদায় ঘটেছে। বিদায়টি করুণই হয়েছে ইংল্যান্ডের। এই ম্যাচ আবার ‘এ’ গ্রুপের হিসেবও শেষ করে দিয়েছে। এখন এই গ্রুপ থেকে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশই কোয়ার্টার ফাইনালে খেলবে। ইয়ান বেলের (৬৩) পর জস বাটলার (৬৫) খানিকটা কাঁপন ধরিয়েছিলেন। শেষে গিয়ে ক্রিস ওকসও (৪২*) ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কাঁপন শেষপর্যন্ত কম্পন ধরাতে পারেনি। ভয়ও রুবেলের বোলিংয়ের সামনে উড়ে যায়। রুবেল হোসেন ২৭তম ওভারে দুই উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরান। বেল ও মরগানের মতো ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরান। এরপর বাংলাদেশের হাতেই ম্যাচ চলে আসে। কিন্তু বাটলার ও ওকস মিলে যেন আবারও ইংল্যান্ডকে এগিয়ে নিয়ে চলতে থাকেন। শেষে প্রতি ওভারেই দেখা গেছে ১০ রানেরও বেশি করে উঠতে থাকে। একটা সময় গিয়ে ম্যাচটি ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণেই চলে আসে। ৪৬ ওভারের সময় ২৩৮ রানে চলে যায় ইংল্যান্ড। এমন সময়েই আবার ম্যাচে ফেরে বাংলাদেশ। তাসকিন আহমেদ আসল কাজটি করে দেন। বাটলারকে আউট করেন। একই ওভারে জর্ডানও রান আউট হলে বাংলাদেশের হাতেই খেলা চলে যায়। এরপরও বিপত্তি ঘটতে যাচ্ছিল। ওকস ও ব্রড মিলে যেন খেলা একেবারে জয়ের দিকেই নিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৫ বলে ২০ রান প্রয়োজন পড়ে। এমন সময় তাসকিনের বলে ওকস লং অন দিয়ে বাউন্ডারি মারার চেষ্টা করেন। বলটি শূন্যে উঠে যায়। তামিমের হাতেও পড়ে। কিন্তু তামিম সেই ক্যাচটি ধরতে পারেননি। তখন মনে হচ্ছিল, হেরেই নাকি যাবে বাংলাদেশ। তামিমের ওপর সবার রাগ যেন ফুঁসে উঠছিল। শুধু ম্যাচই নয়, তামিমকেও যেন বাঁচিয়ে দেন রুবেল। দুই ওভারে জিততে যখন ১৬ রান দরকার, প্রথম বলেই ব্রডকে আউট করে দেন রুবেল। বোল্ড করেন। দ্বিতীয় বলটি এ্যান্ডারসন কোনরকমে ঠেকিয়ে দেন। তৃতীয় বলে এ্যান্ডারসনকে বোল্ড করে দেন রুবেল। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে যায়। দ্বিতীয়বারের মতো গ্রুপ পর্বের গ-ি অতিক্রমও করে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে প্রথমবার প্রথম পর্বের গ-ি অতিক্রম করেছিল বাংলাদেশ। এবার দ্বিতীয়বারের মতো সেই পথেই হাটে বাংলাদেশ। তবে এবার যেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্যই পেয়ে গেল বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে যে বাংলাদেশ গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করে এরপর ‘সুপার এইটে’ খেলে। তখন দ্বিতীয় পর্বে কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল না। এবার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশ। ২০১১ সালেও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার আশা জাগিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সমান ৬ পয়েন্ট থাকার পরও রানরেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেছনে থাকায় নক আউট পর্বে খেলা হয়নি। এবার আবারও ইংল্যান্ডকে হারাল বাংলাদেশ, তবে এবার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা নিশ্চিত করে নিল। এমন জয়ের মূল কারিগর আসলে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদই। ৮ রানেই তামিম (২), ইমরুলকে (২) হারানোর পরই বিপদে পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে সৌম্য সরকার এসে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে ৪০ রান করেন। ৯৪ রানে তাঁর আউটের পর ৯৯ রানে সাকিবও (২) আউট হয়ে যান। ৪ উইকেট হারিয়ে দল ধুঁকতে থাকে। এমন কঠিন মুহূর্তে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান মাহমুদুল্লাহ। তাঁকে সঙ্গ দেন নিয়মিত ধারাবাহিকতা বজায় রাখা মুশফিকুর রহীম। দুইজন মিলে পঞ্চম উইকেট জুটিতে ১৪১ রান যুক্ত করেন। যা কিনা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড। মুশফিক একটা সময়ে গিয়ে ৮৯ রান করে আউট হন। ততক্ষণে দল ২৬১ রানে পৌঁছে যায়। মুশফিক আউট হওয়ার আগেই সাজঘরে ফেরেন মাহমুদুল্লাহ। শেষে সাব্বির ১৪, মাশরাফি ও আরাফাত সানি যথাক্রমে অপরাজিত ৬ ও ৩ রান করে দলকে ২৭৫ রানে নিয়ে যান। তবে মাহমুদুল্লাহ ফেরার আগে যে ইতিহাস গড়ে যান, তাই সবার মুখে মুখে থাকে। ম্যাচ সেরাও হন মাহমুদুল্লাহই। বাংলাদেশের হয়ে যে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে শতক করেন। তাঁর ইতিহাসের দিনে বাংলাদেশও জয় পায়। ইতিহাসও গড়ে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশ।
×