ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টাইগারদের ইংলিশ বধ উৎসবের জোয়ারে ভাসছে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১০ মার্চ ২০১৫

টাইগারদের ইংলিশ বধ উৎসবের জোয়ারে ভাসছে দেশ

জাহিদুল আলম জয়/মুহাম্মদ ইব্রাহীম সুজন ॥ ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডকে আবারও নাকানিচুবানি খাইয়ে চলমান বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনালে নোঙর ফেলেছে বাংলাদেশ। এক ম্যাচ হাতে রেখেই মাশরাফি, মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক, রুবেল, সাকিবদের এই অনবদ্য রেকর্ড গড়া সাফল্যে উৎসব, উচ্ছ্বাস আর আনন্দে ভাসছে গোটা দেশ। সোমবার বিকেলে ইংলিশদের পতনের পর পরই সারাদেশের আনাচে-কানাচে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সর্বত্র আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায় সবার মাঝে। তরুণ-তরুণী, ছেলে-বুড়ো, শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষই উৎসবে শামিল হন। ইংল্যান্ডকে মাটিতে নামানোর পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে উৎসব-আনন্দে মেতে ওঠে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব শ্রেণীপেশার মানুষ। ‘জয় বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জয়’, ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশই সেরা’ বিভিন্ন সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে টিএসসি প্রাঙ্গণ। এ সময় আনন্দের আতিশয্যে মিষ্টিমুখও করতে দেখা যায় অনেককে। সুখের স্রোতে ভেসে যাওয়া শিক্ষার্থীরা রঙের খেলায়ও মেতে ওঠেন। এছাড়াও টিএসসি এলাকায় চারদিক থেকে মানুষ ছুটে আসে আনন্দ ভাগাভাগি করতে। এ সময় পুরো এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবেল রানা বলেন, এ জয় গোটা জাতিকে আনন্দে ভাসিয়েছে। আমরা গর্বিত। প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই মাশরাফিদের। আশা করছি বাংলাদেশ এখন সেমিফাইনালে খেলবে। টিএসসির মূল ভবনের সামনে থেকে টিএসসির সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশাল একটি পতাকা নিয়ে মিছিল বের করে। একই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে মিছিল নিয়ে সবাই ছুটে আসতে থাকেন। কেউ কেউ গায়ের শার্ট, টি-শার্ট, গেঞ্জি খুলে আকাশে উড়িয়ে উল্লাস করে উদযাপন করেন। কেউ কেউ মুখে রঙ মেখে, প্রিয় মানুষদের জড়িয়ে ধরে, বাজনা বাজিয়ে উদযাপন করেন। কেউ আবার ঐতিহাসিক মুহূর্তকে সাক্ষী হিসেবে ধরে রাখতে ক্যামেরায় ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন। কেউ কেউ টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের ওপর, ডাসের পাশে থাকা মেহগনি গাছের মাথায় উঠে চিৎকার করে করে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়ে বিজয় উল্লাস করেন। টাইগারদের ইংলিশ শিকারের কিছুক্ষণ পরই টিএসসি থেকে অসংখ্য মোটরবাইক নিয়ে র‌্যালি বের করা হয়। কেউ কেউ মুখের ভেতরে কেরোসিন নিয়ে আগুনের ফুলকিতে আলোকিত করে তোলে চারদিক। এই আনন্দ উদযাপনে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। রিকশাচালক রিকশা তালা মেরে, অস্থায়ী-ভাসমান দোকানদাররা দোকানপাট বন্ধ করে সবাই আনন্দ মিছিলে যোগ দেন। রিকশাচালক রাকিব উজ রাজ উল্লাস করতে করতে বলেন, ‘আজ (সোমবার) আর রিকশা চালামু না। আজ আমাগো আনন্দের দিন।’ এর পরক্ষণেই তিনি হৈহৈ শব্দ করতে করতে মিছিলে যোগ দেন। এভাবে চলতে থাকে উদযাপন। টিএসসিতে থাকা ছাত্রলীগের সহসভাপতি জয়দেব নন্দী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘টাইগারদের এই বিজয়ে পুরো জাতি উল্লসিত। এ বিজয় আমাদের সবার। আমরা চাই বাংলাদেশ দল তাদের এই পারফর্মেন্স অব্যাহত রাখুক।’ সোমবার বিকেলে বাংলাদেশের ইংলিশ বধের সময় সংসদে চলছিল রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর নিষ্প্রাণ আলোচনা। কিন্তু নিষ্প্রাণ অধিবেশনে মুহূর্তেই যেন প্রাণ ফিরে পায় ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার এক ঘোষণায়। যখন ডেপুটি স্পীকার জানালেন বিশ্বকাপে টাইগারদের অবিস্মরণীয় বিজয়ের বার্তা, মুহূর্তেই উল্লাসে ফেটে পড়েন সংসদ সদস্যরা। টেবিল চাপড়িয়ে, একে অপরে কুলাকুলি করে বিজয়ের আনন্দ ভাগ করে নেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। সবার মধ্যে ছিল হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। পরে জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকেও বিজয়ী বাংলাদেশ দলের প্রতিটি খেলোয়াড়, কর্মকর্তাবৃন্দকে অভিনন্দন জানানো হয়। পাশাপাশি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ইতিহাস গড়া জয় পাওয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া পৃথকভাবে বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানান। ‘আহা কি আনন্দ গগনে সমীরণে....২০১১ বিশ্বকাপেরই পুনরাবৃত্তি....আবারও ক্রিকেটের কুলীনদের কুপোকাত করে তাদের চেহারা মলিন করে দিল মাশরাফিবাহিনী’Ñসামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে আবেগঘন এই মন্তব্য করেন কুষ্টিয়ার তরুণ শিহাব শাহরিয়ার টোটুস। দুর্দান্ত এই জয়ে আরেকবার বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, ছেলেখেলার পাত্র নন তারা! বিভিন্ন সময় তথাকথিত অনেক ক্রিকেট প-িত বাংলাদেশকে নিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলেন। বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে ইফতেখার আহমেদ স্বচ্ছ নামের একজন স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘কারও করুণা নিয়ে আমাদের দেশ ক্রিকেট খেলে না। নিজেদের যোগ্যতাবলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা দল। অনেকেই তো সুযোগ পেলে বাংলাদেশকে নিয়ে কটাক্ষ করেন। এখন তারা কি বলবেন??? ইংল্যান্ড ক্রিকেটের জনক। তাদের টানা দুই বিশ্বকাপে হারালাম আমরা। জনকদের কি লজ্জা হয়েছে? জানতে বড্ড ইচ্ছে করছে।’ বাংলাদেশের দেয়া ২৭৬ রানের টার্গেট তাড়া করতে যেয়ে কোনসময়ই বুক চেতিয়ে লড়তে পারেনি ইংল্যান্ড। টাইগারদের থাবায় সব সময়ই ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে মরগান, মঈন, বেল, বাটলার, ব্রডদের। ইংলিশদের উইকেট পতনের মিছিল দেখে দেশটির সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন টুইট করেন, ‘বিশ্বাস করতে পারছি না ওরা (ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা) এমন খেলছে। ওরা তো ভাল খেলোয়াড়।’ ম্যাচ চলাকালীন ভন এই মন্তব্য করেছিলেন। ম্যাচ শেষে যে তাঁর কি অবস্থা হয়েছে সেটা জানতে পারলে মন্দ হতো না! এ্যাডিলেডে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে ১৫ রানে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর টিভি ক্যামেরা বার বার খুঁজে ফিরছিল ইংলিশ সাজঘর। কিন্তু সেটা তো তখন সাজঘর নয়, যেন ‘শবঘরে’ পরিণত হয়। আর বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে তখন বইছে আনন্দের অশ্রুধারা। এক ম্যাচ হাতে রেখে শেষ আট নিশ্চিত হওয়ায় বাংলাদেশের ভক্ত-সমর্থকদের প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেছে। সারাদেশে আনন্দ মিছিলে ক্রিকেটারদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ সেমিফাইনালে খেলবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। অবিস্মরণীয় বিজয়ের পর সারা দেশের মতো রাজধানীর রামপুরা এলাকাতেও আনন্দ মিছিল হয়। সেখানে রঙের খেলায় মেতে ওঠেন ভক্ত-সমর্থকরা। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সরকরী কর্মকর্তা টি তারিকুল ইসলাম তারিক বলেন, ‘বিশ্বকাপের আগে অনেকেই অনেক কথা বলেছে। কিন্তু বিশ্বকাপে যেয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, তারা যে কোন দেশকে হারানোর ক্ষমতা রাখে। আমি তো মনে করি, এ ধারা ধরে রাখতে পারলে বিশ্বকাপ জেতাও সম্ভব!’ অবিস্মরণীয় সাফল্যের পর সবার স্বপ্নের পরিধি এভাবেই বেড়ে গেছে। ইতিহাস গড়া সাফল্যের পর দেশের পাড়া-মহল্লা, গ্রাম থেকে শহর, আনাচে-কানাচে বিজয় মিছিল বের করেন খেলাপ্রেমী ভক্ত-সমর্থকরা। চট্টগ্রাম থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, বন্দরনগরীতে বাংলাদেশের জয়ে আনন্দ মিছিল বের করা হয়। ক্রীড়াপ্রেমীদের আনন্দ মিছিলে শরিক হন সাবেক সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ অনেকে। রাজশাহী থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, নগরীর প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট, নিউমার্কেট, গৌরহাঙ্গা রেলগেট, তালাইমারী, অক্ট্রোয়মোড়, লক্ষীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে তাৎক্ষণিকভাবে বিজয় মিছিল করা হয়। বাংলাদেশের বিজয়ের পর পাবনা শহর মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পাবনা সংবাদদাতা জানান, বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে সব বয়সী মানুষ বিজয়ের আনন্দে মিছিল বের করেন। মিছিলে মিছিলে শহরে উৎসবের আবহ সৃষ্টি হয়। একে অপরকে মিষ্টিমুখ করিয়ে বিজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করা হয়। টাইগারদের জয়ে কলাপাড়ায় মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করা হয়। ম্যাচে বল হাতে দারুণ সাফল্য পাওয়া পেসার রুবেল হোসেনের শহর বাগেরহাটও পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। বাগেরহাট সংবাদদাতা জানান, মিষ্টির দোকানিরা তাদের সব মিষ্টি মিছিলকারীদের মাঝে বিলিয়ে দেন। ম্যাচসেরা মাহমুদুল্লাহর জেলা ময়মনসিংহে যেন ছিল বাড়তি উচ্ছ্বাস। বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে সেঞ্চুরি করার গৌরবগাথা রচনা করায় মাহমুদ্ল্লুাহর পরিবারের সদ্যসরাও ভীষণ খুশি বলে জানান ময়মনসিংহ সংবাদদাতা। এছাড়া খুলনা, মুন্সীগঞ্জ, মাগুরা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, ঝালকাঠি, মির্জাপুর, রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ সারাদেশেই আনন্দ মিছিল হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনকণ্ঠের সংবাদদাতারা। বাংলাদেশের জয়ে প্রবাসী দর্শকরাও ভীষণ উচ্ছ্বসিত। ভিয়েনা থেকে এম নজরুল ইসলাম জানান, মাশরাফিদের গৌরবময় বিজয়ে আনন্দ-উল্লাসে ভেসেছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা প্রবাসী বাঙালীরা।
×