ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোজাম্মেল খান

মর্মান্তিক উপহাস

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১০ মার্চ ২০১৫

মর্মান্তিক উপহাস

সব সমাজেই রাজনীতিকরা সে সমাজের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। যিনি যত বেশি মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটান তিনি তত বেশি সফল রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাই হয়ে ওঠে একজন সফল রাজনৈতিক এবং তাঁর দলের চালিকাশক্তি। “আপনি সব সময় কিছু মানুষকে, সব মানুষকে কিছু সময় বোকা বানাতে পারবেন; কিন্তু আপনি সব সময়ের জন্য সব মানুষকে বোকা বানাতে পারেবেন না- এক মহান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের এই বিখ্যাত উক্তি বার বার ভুল প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল দ্বারা। মিথ্যা, বিকৃতি এবং প্রতারণার মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপার্সন বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাত করে আবারও প্রমাণ করলেন ক্ষমতায় যেতে তিনি এখনও বহির্বিশ্বের দিকে তাকিয়ে আছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন অবশ্য সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে পেট্রোলবোমা হামলার দায়ভার ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের ওপর চাপিয়ে দিলেন। অবশ্য তাঁর এ দাবি তাঁর এবং তাঁর দলের পূর্বেকার অভিযোগ এবং দাবির সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ যেখানে তিনি মিথ্যা এবং বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছেন বার বার। যেটা সবচেয়ে দৃষ্টিকটু এবং সমগ্র জাতির বিবেকবান মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটা হলো হঠাৎ করে ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি ১৫ আগস্ট তাঁর কল্পিত জন্মদিন পালন শুরু করলেন, যে বছর ঐ মর্মান্তিক দিনটিকে জাতীয় শোকদিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলো। তাঁর হঠাৎ করে নিশ্চয়ই পুনর্জন্ম হয়নি এবং একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বিধবা পতœী হিসেবে তাঁর জন্মদিনের উল্লেখ পাসপোর্টসহ বহু দলিলপত্রে লিপিবদ্ধ ছিল, অবশ্য তিনি জনসমক্ষে সেটা কোনদিন পালন করেছেন সেটার কোন প্রমাণ নেই। কোন মানুষের এবং বিশেষ করে তিনি যদি পাবলিক ফিগার হন তাঁর জন্য এ তথাকথিত জন্মদিন পালন যে কতটা নৈতিক এবং মানসিক অবক্ষয়ের পরিচায়ক সেটা অনুধাবনের জন্য বিশেষ বুদ্ধির প্রয়োজন নেই। ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী যখন বিএনপি নেত্রীকে টেলিফোন করেছিলেন আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে তখন প্রধানমন্ত্রী যখন ২১ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের কথা উল্লেখ করেন তখন বিএনপি নেত্রীর রূঢ় জবাব ছিল এরকম : “২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা আপনারা করিয়েছেন। আপনাকে হত্যা করতে কেউ চায়নি। আপনি যত থাকবেন, তত আমাদের জন্য ভাল।” একই কথা তিনি ওই হত্যাযজ্ঞের পরমুহূর্ত থেকেই বলে আসছেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের ওপর গ্রেনেড মেরে গণআত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের পরম দুর্ভাগ্য, মাত্র ২২ জন নিহত হয়েছিলেন, কয়েক শ’ আহত এবং পঙ্গু হয়েছিলেন। একমাত্র মানসিক রোগী ছাড়া যদিও কেউ এটা বিশ্বাস করবে না, তবুও তদানীন্তন সরকারপ্রধান হিসেবে সব কিছু জেনেও কেন জজ মিয়ার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষকে এ হত্যাযজ্ঞের প্রধান জেনারেল বানানো হলো সে প্রশ্নের উত্তর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের কেউ কি সাধারণ জনগণকে জানাবেন? সাম্প্রতিককালে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের প্রধানের টেলিফোন কল এবং ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যানের বিবৃতি প্রতারণার ইতিহাসে আর এক নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন ঘটিয়েছে। বর্তমান সঙ্কটের প্রারম্ভে বিএনপি নেত্রীর গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক অধিকার খর্ব বা সঙ্কুচিত করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। সাংবিধানিক অধিকার কিভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে সেটা একটু পিছনের দিকে নজর দিলেই ধরা পড়বে। হেফাজতে ইসলামকে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল সেটা অনেকেই ভোলেননি। সাংবিধানিক অধিকারের নামে তারা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল সেটা পৃথিবীব্যাপী সংবাদ মাধ্যমের প্রধান সংবাদ হয়ে গেল। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ একটি সর্বনিম্ন রক্তপাতের মধ্য দিয়ে যখন তাদের রাজধানী থেকে ফেরত পাঠাল তখন বিএনপি ও তার সহায়ক মানবাধিকার (এটা এখন সাইলোতে আশ্রয় নিয়েছে!) গ্রুপ হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে দুনিয়াব্যাপী অপপ্রচার চালাল। এমনকি বিএনপি প্রধান তাঁর তথাকথিত গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যবহার করে হেফাজতীদের সমর্থনে ঢাকাবাসীকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানালেন। কিন্তু তাঁদের বিবেককে ধন্যবাদ, ঢাকাবাসী তাঁর এ অসৎ উদ্দেশ্যের সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসেননি। জানুয়ারির ৫ তারিখের পর থেকে বিএনপি জোটের ‘জনগণের স্বার্থরক্ষার তথাকথিত আন্দোলন শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত ১১৫ জন মানুষ এ আন্দোলনের যূপকাষ্ঠে প্রাণ দিয়েছেন, যার মধ্যে ৯০ জন নিরীহ সাধারণ মানুষ যাদের সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক ছিল না। তাঁরা তাঁদের জীবন হারিয়েছেন এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় ধ্বংস হয়েছে তাঁদের পরিবার। দেশের প্রায় সব হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ভরে উঠেছে নিপীড়িত দগ্ধ মানুষের হৃদয়বিদারক কষ্ট আর আর্তনাদে; মানুষের হাতে পেট্রোলবোমায় পুড়ে যাওয়া মানুষের আর্তচিৎকারে। গত বছর নির্বাচনে লাইনচ্যুত করার ব্যর্থ আন্দোলন ছাড়াও দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন দুঃখজনকভাবে এই প্রথমবারের মতো সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে নৃশংসভাবে জীবন দিতে হচ্ছে। এ দেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে সব সময়ই শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মীদের জীবন দিতে হয়েছে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সদস্যদের হাতে। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি জোটের আরোপিত অবরোধ এবং হরতালে জনজীবন যতটুকু প্রভাবিত হচ্ছে তার একমাত্র কারণ ভয়াবহ পেট্রোলবোমা আতঙ্ক। এর বাইরে হরতাল এবং অবরোধ মোটামুটিভাবে উপেক্ষিত। এটাই হলো তাঁর তথাকথিত আন্দোলনের একমাত্র ‘সাফল্য’। তাঁর অভিযোগ অনুযায়ী যদি ক্ষমতাসীন দলের লোক সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে পেট্রোলবোমা হামলা করছে তাহলে এ দাঁড়াচ্ছে যে, সরকারই তাদের তথাকথিত অবরোধ এবং হরতালের ‘সাফল্য’ এনে দিচ্ছে। অথচ অসংখ্য মিডিয়া রিপোর্ট এবং ভিডিও ফুটেজ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করছে তাঁর জোটের কর্মীদের এই অভূতপূর্ব জঘন্য নৃশংসতা আর অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ। আসলে তাঁর জোটের কর্মীরাই যে এ নৃশংস হত্যা আর পেট্রোলবোমা মারার রূপকার এবং বিএনপি নেত্রীর অভিযোগ যে কতটা হাস্যকর সেটা বোঝার জন্য হ্যারল্ড লাস্কীর মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো যুক্তিবাদী হওয়ার প্রয়োজন নেই। সোজা কথায় বিএনপি প্রধানের এ হাস্যকর অভিযোগ মানুষের জীবন ও মনুষ্যবিবেকের প্রতি এক চরম উপহাস। লেখক : কানাডার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক এবং সিনেটের ডেপুটি স্পীকার
×