ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১১ এপ্রিল ২০২৪, ২৭ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তফা জব্বার

একুশ শতক ॥ রোমান হরফের উচ্চারণভিত্তিক বাংলা কীবোর্ড

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ৮ মার্চ ২০১৫

একুশ শতক ॥ রোমান হরফের উচ্চারণভিত্তিক বাংলা কীবোর্ড

এক. বহু বছর ধরেই আমি প্রতি ঘণ্টায় একবার করে জিজ্ঞাসিত হই- আপনি কবে একটি ‘ফনেটিক’ কীবোর্ড তৈরি করবেন। অভিধান অনুসারে ‘ফনেটিক’ এর মানে হলো ধ্বনিতাত্ত্বিক। আমি একে উচ্চারণভিত্তিক বলি। কিন্তু যারা আমাকে ‘ফনেটিক’ কীবোর্ড বানানোর প্রস্তাব প্রদান করেন তাদের মনের কথা আলাদা। আমি এই প্রশ্নকর্তাদের অন্তরের কথা বুঝি। তারা আমাকে রোমান হরফে বাংলা লেখার পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা বলেন। বিষয়টি এমন যে, ওরা ইংরেজী হরফে বাংলা ভাষা লিখবে এবং সেই ইংরেজীতে লেখা বাংলা ভাষা বাংলা হরফে রূপান্তরিত হবে; এমনটাই ওরা চায়। কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তারা এই কাজটি করতে চায়। ওরা ভাবে এটা খুবই সহজ উপায়। এটি এখনকার তরুণ-তরুণীদের প্রিয় একটি পদ্ধতিও বটে। তরুণ-তরুণীদের বিষয় নিয়ে আমাদের শিক্ষা হলো; তাদের কোন বিষয়ে না বলাটা বিপজ্জনক। ফলে কাজটি ভাল না সেটি বলার চাইতে কাজটি আরও ভাল কেমন করে হতে পারে সেই কথাটি বলা ভাল। আমি নিজে মনে করি, রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখা বা একেবারেই বাংলা না লেখার চাইতে রোমান হরফে বাংলা লিখে সেটি বাংলা হরফে রূপান্তর করাটা হয়ত মন্দের ভাল একটি কাজ। যারা একদমই বাংলা লেখে না তারা যদি ভুল করেও বাংলা হরফে বাংলা লেখে তবে আমি তো খুশিই হবো। লিখতে শুরু করার পরপরই তাকে আবার বলব, একটু শুদ্ধ করে লেখ। বানানটা ভুল করবা না। তবে এতে আমার ভয়ও আছে। এভাবে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখার এই মানসিকতা একদিন পুরো বাঙালী জাতি, বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ও বাংলা হরফকে বিপন্ন করে ফেলতে পারে। ফলে ভাষা ও বর্ণমালা দুটিই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। এর বদলে বরং নিজের পছন্দমতো একটি কীবোর্ড বাছাই করে বাংলা হরফ দিয়েই বাংলা লেখা উচিত। এমনকি সেই কীবোর্ডটি রোমান হরফের উচ্চারণভিত্তিকও হতে পারে। প্রসঙ্গত এটি খুব স্পষ্ট করে বলা উচিত, আমি একদিকে নীতিগতভাবে রোমান হরফে বাংলা লেখার পর সেটিকে বাংলা হরফে রূপান্তর করাটা পছন্দ করি না, অন্যদিকে আমি মনে করি কোনভাবেই রোমান হরফ দিয়ে খুব সহজে বাংলা লেখা সম্ভব নয়। খুব সাধারণ একাডেমিক আলোচনাতেই আমরা দেখি যে, বহু বাংলা হরফের উচ্চারণগত সমিলতা রোমান ২৬টি বর্ণে নেই। এই পদ্ধতিতে মোবাইল ফোনে বাংলা লেখা হয় এমন একটি সফটওয়্যারের ওয়েব পেজে বাংলা লেখার দৃষ্টান্ত এভাবে দেয়া ছিল। “আমার সোনার বাংলা (amar sOnar bangla), লক্ষ্নেী (lokkhNOU), কর্তৃত্ত্ব (korrtrrit), শিক্ষা (shikSha/shikkha), শ্বশ্বত (SwaSwoto/SwaSwt), ছাত্র (chatro), বৈষ্ণব (bOIShNb), সমুদ্র (somudro), রিদ্মিক (ridmik), ব্রহ্মপুত্র (brohmputro), হঠাৎ (hoToTH), চাঁদ (caqqd)।” এখানে শ্বাশ্বত, ব্রহ্মপুত্র বা হটাৎ লেখার জটিলতাতো কিছুটা বোঝা যায়, কিন্তু চাঁদ ও কর্তৃত্ত্ব, লেখার সাথে কোন ধরনের উচ্চারণ কাজ করে বলে তো মনেই হয় না। আমাদের তরুণ-তরুণীদের অনেকের কাছে এই পদ্ধতিটি সহজ মনে হয়। হতে পারে, এদের বেশিরভাগ হয়ত ভালভাবে বাংলা ভাষাই আয়ত্ত করতে পারেনি। তারা হয়ত বুঝতেই পারে না যে, বাংলা ভাষার লাখো শব্দকে এভাবে লিখতে হলে কীবোর্ড দিয়ে বাংলা লেখার চাইতে অনেক বেশি শিখতে হবে। বস্তুত রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখার জন্য একটি অভিধানই তৈরি করতে হবে। আমার ধারণা, বিজয় বা অন্য কোন কীবোর্ড দিয়ে বাংলা লেখার অভ্যাস করার চাইতে এই অভিধান আত্মস্থ করা হাজার গুণ কঠিন হবে। তবে এক্ষেত্রে যে সুবিধাটি রয়েছে সেটি হলো যে, এই পদ্ধতির ব্যবহারকারীরা খুব সহজ সরল সব সময়ে ব্যবহৃত কয়েকশ’ বাংলা শব্দ ব্যবহার করে মাত্র। লিখতে লিখতে সেইসব শব্দ তাদের আয়ত্ত হয়ে যায়। কিন্তু কেউ যদি পরীক্ষার খাতায় বাংলা লিখতে চায়, পত্রিকার পাতায় নিবন্ধ লেখে বা বইয়ের জন্য বাংলা লেখে তবে এই পদ্ধতি কতটা কার্যকর হবে সেটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে যায়। সম্ভবত এজন্যই কোন পত্রিকা অফিস বা প্রকাশনা সংস্থা বিজয় কীবোর্ড ছাড়া রোমান হরফে বাংলা লেখার কথা ভাবেই না। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে টাইপরাইটার বা কম্পিউটারের কীবোর্ড হচ্ছে অভ্যাসের বিষয়। ইংরেজীতে বোরাক নামের একটি কীবোর্ড অনেক দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও সেটি বহুল প্রচলিত হয়নি। কারও কাছেই কোয়ার্টি কীবোর্ড তার জনপ্রিয়তা হারায়নি। ওরা কোন ফনেটিক কীবোর্ডও চায়নি। মোবাইলের জন্য টি নাইন নামের পদ্ধতিও আছে। কিন্তু আমি ইংরেজী লেখার সময় সেটি অফ করে রাখি। তবে একটি কথা খুব ভালভাবে বলা দরকার যে, দুনিয়ার সকল মাতৃভাষার জন্য বড় আপদের নাম রোমান হরফ। দুনিয়া যত ছোট হচ্ছে এই বিপদ ততো বাড়ছে। এই হরফমালা ইতিমধ্যে বিশে^র বহু ভাষার বর্ণমালাকে গিলে খেয়েছে। এখনও দুনিয়ার বহু ভাষার বর্ণমালা রোমান হরফের ছুরির তলে আছে। বিশেষ করে ছোট ছোট ভাষাগুলো নানাভাবে এই দানবের হাতে বিপন্ন হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষার তেমন দুরবস্থা হয়েই গেছে। এটি কেবল যে ক্ষমতার দাপট সেটি নয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি ধর্মীয় অজুহাতে রোমান হরফ ক্ষুদ্র ভাষাগুলোর হরফকে গিলে খায়। আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে রোমান হরফে বাইবেল পড়তে দিয়ে রোমান হরফ গেলানো হচ্ছে। আমাদের দেশের তরুণ সমাজকে অর্থনৈতিক উন্নতির নামে রোমান হরফ গেলানো হচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্রেরই ধারণা হয়েছে যে, ইংরেজী হরফ না জানলে দুনিয়াতে টিকে থাকা যাবে না। লোকজনের ধারণা বাংলা ভাষাও ইংরেজীর দাস। পুরো বিষয়টি নিয়ে সেই ৮৮ সাল থেকেই লিখছি। আমি কেন বিজয় কীবোর্ড তৈরি করেছি সেটি এতবার বলেছি যে, কেউ যদি সব লেখা পড়ে থাকেন তবে বিরক্ত হয়ে যাবার কথা। কিন্তু যারা আমাকে ফনেটিক কীবোর্ড বানাতে বলেন, তারা আমার সেইসব লেখা পড়েননি। আজকে যারা চিৎকার করে তখন তো অনেকের জন্মও হয়নি। অনেকেই যন্ত্রে বাংলা ভাষার ইতিহাস জানেন না বলে টাইপরাইটার, টাইপসেটার বা কম্পিউটারের বাংলা কীবোর্ড সম্পর্কেও জানেন না। তারা কেবল রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লিখতেই শিখেছেন। আমি এদের বহুজনকে দেখেছি কোন কোন ব্যঞ্জনবর্ণে কোন যুক্তাক্ষর হয় সেটিও জানে না। তারা এটি বোঝে না যে, রোমান হরফের কম্বিনেশনে বাংলা যুক্তাক্ষর হয় না। ঐতিহাসিকভাবে সত্য হচ্ছে, বিদেশীরা বানিয়েছেন বলে বাংলাসহ দুনিয়ার বহু ভাষার কীবোর্ড বরাবরই রোমান হরফকে অনুসরণ করে তৈরি করা হয়ে আসছিল। লাইনো-মনো টাইপকাস্টিং মেশিনের কীবোর্ড, রেমিংটন বাংলা টাইপরাইটার, গুডরেজ বাংলা টাইপরাইটার বা ফটো টাইপসেটারের বাংলা কীবোর্ড রোমান টাইপরাইটার কীবোর্ডকে অনুসরণ করেছে। এসব ব্যবসা ওরাই নিয়ন্ত্রণ করত এবং ওদেরই প্রযুক্তি ছিল বলে সেখানে আমাদের কিছু করার ছিল না। এমনকি বিজয় ছাড়া কম্পিউটারের অন্য বাংলা কীবোর্ডগুলোও রোমান কীবোর্ডকে অস্বীকার করেনি। এই প্রবণতাকে প্রথম যিনি পাশ কাটিয়ে যান তিনি শহীদ মুনির চৌধুরী। তিনি বাংলা বর্ণানুক্রম অনুসরণ করে টাইপরাইটারের বাংলা কীবোর্ড তৈরি করেন, রোমান হরফের কথা একেবারেই ভুলে যান। এমনকি সাইফুদ্দাহার শহীদসহ কম্পিউটারের জন্য প্রথম কীবোর্ড নির্মাতাগণ তাদের কীবোর্ডগুলোকে রোমান কীবোর্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেই তৈরি করেন। শহীদ সাহেব এ বিষয়ে স্পষ্টতই বলেছেন যে, সেটাই নাকি যুক্তিসঙ্গত। তিনি বাংলা শব্দ ব্যবহারের ফ্রিকুয়েন্সি জরিপ করেন। কিন্তু কীবোর্ডে যখন বাংলা অক্ষর বসান তখন রোমান হরফের উচ্চারণকে অনুসরণ করেন। তবে তিনিও রোমান হরফের সঙ্গে বহু বাংলা বর্ণকে মেলাতে পারেননি। কখনও কখনও মনে হয় তিনি নিজেই মেলানো থেকে সরে গেছেন। তার কীবোর্ডটি ছিল ৪ স্তরের। তাতে তিনি ফলা, অর্ধবর্ণ ইত্যাদিও বসান। কোথাও কোথাও অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণ পদ্ধতি প্রয়োগ করলেও কোন কোন ক্ষেত্রে এমনকি রোমান হরফের উচ্চারণকেও অনুসরণ করেননি। আমি অনেক ভারতীয় বাংলা কীবোর্ড দেখেছি তাতে কোথাও কোথাও রোমান হরফকে অনুসরণ করা হলেও জনপ্রিয় কীবোর্ডগুলো রোমান হরফকে অনুসরণ করেননি। বর্তমানের অবস্থাটি অবশ্য ভিন্নরূপের। এখন ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করলে দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাসমূহের রোমানাইজড কীবোর্ড পাওয়া যায়। হিন্দী, নেপালী, চীনা, রুশ, তামিল এমন অনেক ভাষাতেই এই ধরনের কীবোর্ড তৈরি হয়েছে। আমি ভারতীয় ভাষা পরিবারের ভাষাগুলোর জন্য প্রণীত রোমানাইজড কীবোর্ডগুলোর বিশ্লেষণ করে সেই সমস্যাগুলোই পেয়েছি যা আমাদের বাংলা ভাষার জন্যও প্রযোজ্য। এর কারণটাও সহজ। বঙ্গলিপি ব্রাহ্মীলিপি থেকে জন্ম নিয়েছে। ফলে এর বৈশিষ্ট্য কেবল উপমহাদেশ নয়, সুদূর থাইল্যান্ড বা কোরিয়া অবধি বিস্তৃত। বর্ণমালার সমস্যার ধরনও তাই একই প্রকারের। আমি একটি নেপালী কীবোর্ড দেখে এটি বলতে পারি যে, কারও পক্ষেই রোমান কীবোর্ড দিয়ে আমাদের বর্ণমালার সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। রোমান হরফকে অনুসরণ করে বাংলা কীবোর্ড তৈরি করার প্রথম প্রয়াস হিসেবে শহীদলিপির কথাও বলতে হবে। আমি শহীদ সাহেবের পরে বাংলা কীবোর্ড তৈরি করি। শুরুতেই আমি মনে করেছি, চার স্তরের নয় বাংলাকে ইংরেজী কীবোর্ডের স্বাভাবিক ও শিফট বোতামের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে যে দুনিয়ার কেউ আমার ভাষার জন্য আলাদা কীবোর্ড তৈরি করবে না। দুনিয়াজোড়া রোমান হরফের যে কীবোর্ড আছে তাকেই আমাদের ভাষার জন্যও কাজে লাগাতে হবে। বিজয় কীবোর্ড বানানোর সময় আমি সেটি সবার আগে বিবেচনা করেছি। সেজন্যই আমি বাংলা হরফের হিসাবটাও ৫২-এর কাছাকাছি করতে সক্ষম হই। সেজন্য দুটি স্বরবর্ণ, ৯টি স্বরচিহ্ন, ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ, ১টি লিঙ্ক ও ১টি যতি চিহ্ন ও ৩টি ফলা মিলিয়ে মোট ৫৫টিতে সামাল দিতে সক্ষম হই। আমার কাছে মনে হয়েছে, কীবোর্ড ২/১ লাইন বাংলা লেখার জন্য নয়, পেশাদারিত্বের জন্য। দুয়েক লাইন তো আমরা কোন বিজ্ঞানসম্মত নয় এমন কীবোর্ড ছাড়াও লিখতে পারি। মোবাইলে যেখানে ২৬টি হরফের বোতাম নেই, কোন কোন বোতামে ৩টি অক্ষর রয়েছে। সেটি দিয়েও তো ইংরেজী বা বাংলা লিখতে পারি। আমরা এমন মোবাইল ফোনের জন্যও বাংলা কীবোর্ড প্রমিত করেছি। কিন্তু আমাকে যদি অনেক লেখা বেশ দ্রুত গতিতে লিখতে হয়, তবে টাইপের গতিটা খুবই জরুরী। টাইপের এই গতিটা আসতে পারে বোতামে অক্ষরের সংখ্যা কম হলে, মনে রাখা সহজ হলে এবং যেসব অক্ষরের ব্যবহার বেশি সেগুলো হোম কীতে থাকলে। (চলবে) ঢাকা, ০৭ মার্চ ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×