ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীবাদের কাঁধে ভর করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৮ মার্চ ২০১৫

জঙ্গীবাদের কাঁধে ভর করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গণতন্ত্রের হাতিয়ার কখনও পেট্রোলবোমা হতে পারে না। পেট্রোলবোমা হাতে করে সংলাপের কথাও বলা যায় না। জঙ্গীবাদের কাঁধে ভর করে দেশে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা। আর এ জাতীয় আন্দোলনকে সাধারণ মানুষ প্রতিহত করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন দেশের শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য শ্রেণী-পেশার বিশিষ্টজনরা। তারা বলেন, গত দুই মাস ধরে ২০ দলীয় জোট যা করছে তা শুধুই সন্ত্রাস। নিকৃষ্ট সন্ত্রাসবাদ, মানবতার বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধ। যাকে কোন রাজনীতি বা গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে ডাকার সুযোগ নেই। বিএনপির ২০ দলীয় জোট সঙ্গী জামায়াত ও ধর্মান্ধ ইসলামী দল আর জঙ্গী সংগঠনগুলো একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। দেশী-বিদেশী গণতন্ত্রকামী এবং গবেষণা সংস্থাসমূহের এ বিষয়ে বিন্দমাত্র সন্দেহ নেই। শনিবার রাজধানীর গুলশানে সহিংসতা, জঙ্গীবাদ, সংলাপ ও বাস্তবতা শীর্ষক আয়োজিত এক সেমিনারে তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। গুলশান-২ এ অবস্থিত লেকশোর হোটেলে রিজিওনাল এন্টি টেরোরিজম রিসার্চ ইনস্টিটিউট এ আলোচন সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব)। অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, দেশে বর্তমান আদর্শিক দ্বন্দ্ব চলছে। এর এক পক্ষে রয়েছে আলোর দিশারী। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছে। অন্য পক্ষে যারা রয়েছে তারা দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে যে কোনভাবে ক্ষমতা দখল করতে চায়। এই অন্ধকারের শক্তিকে শনাক্ত করেই কাক্সিক্ষত লক্ষে পৌঁছাতে হবে। তিনি বলেন, যারা হরতাল অবরোধের নামে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চায়, পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করছে তাদের সঙ্গে কখনও সংলাপ হতে পারে না। জঙ্গীবাদের পিঠে ভর করে কখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এদের একটাই লক্ষ্য দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ব্যাহত করে রায় কার্যকরে বাধা প্রদান করা। তিনি বলেন, যারা আন্দোলনের নামে গণতন্ত্রের কথা বলেন, তারাই সন্ত্রাসকে আশ্রয় দিচ্ছেন। দেশে কারও মিছিল মিটিং করতে বাধা দেয়া হলেও জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আশ্রয় নেয়া অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। যারা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে কোনক্রমেই সংলাপ হতে পারে না বলে উল্লেখ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আআমস আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সন্ত্রাসের সঙ্গে সমঝোতা করে সংলাপ করা যাবে না। এতে কোন ফলও পাওয়া যাবে না। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আজ কার স্বার্থে ধ্বংস করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের লক্ষ্যে কোন আন্দোলন পরিচালিত হলে মানুষ সে আন্দোলন প্রতিহত করবে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান বলেন, সন্ত্রাস নির্মূল করেই সংলাপ সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। কখনও সন্ত্রাস জঙ্গীবাদের কাছে মাথানত করা যাবে না। তিনি দেশের চলমান পরিস্থিতিকে আদর্শের দ্বন্দ্ব হিসেবে উল্লেখ করেন। বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল তৈরি করে সঙ্কটের সমাধান করা জরুরী। যারা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারে আওতায় আনতে আইনী কাঠামো প্রয়োজন। আইনগত কাঠমো ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদের বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ শান্তি চায়। চলমান সন্ত্রাস বন্ধ হলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে শান্তি ফিরে আসবে না। এর জন্য প্রয়োজন ন্যায় বিচার। রাজনৈতিক দাবি থেকেই দেশে আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলন শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়। এটাকে সন্ত্রাস হিসেবে দেখে অস্ত্রের মাধ্যমে দমন করা সম্ভব নয়। আগে ক্ষোভের কারণ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু আলাপ আলোচনা ছাড়া সৃষ্ট ক্ষোভ বন্ধ করা যাবে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বর্তমানে দেশে কোন রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে না। অবৈধভাবে ক্ষমতায় যেতে সহিংসতার মতো অবৈধপন্থা বেছে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা যদি সঠিকভাবে শিক্ষিত হতে না পারেন তা হবে বড় ধরনের ক্ষতি। এটি যে কত বড় ক্ষতি তা বুঝতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। অথচ কোকোর ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার জন্য ঠিকই মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছে। তাদের পরীক্ষার জন্য দাদী হিসেবে খালেদা জিয়া ঠিকই তার দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু হরতাল অবরোধের কারণে দেশে ও-লেভেল, এ লেবেল পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তারা এক বছর পিছিয়ে গেছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঠিক না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো পরিচালিত হবে না। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০১৩ সালের চিত্র আর বর্তমানের চিত্র এক নয়। সেদিন দেশের প্রয়োজনে সংলাপের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আজ প্রয়োজন না হলেও সাধরণ মানুষকে মেরে সংলাপের চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমান সহিংস আন্দোলনের কারণে বাজেটে অর্ধেক পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এতে কোন কষ্ট পাবে না। এতে কষ্ট পাবে ব্যবসায়ীরা। আর যারা পেট্রোলবোমা মারে তারা উৎসাহী হবে। বিএনপির সাবেক এমপি শহীদুল হক জামাল বলেন, দেশের বর্তমান অবক্ষয়ের জন্য রাজনীতিবিদরাই দায়ী। বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবং জনগণের কল্যাণে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের হাতিয়ার কখনও পেট্রোলবোমা হতে পারে না। অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ২০ দলীয় জোটের বর্তমান আন্দোলন দেশে সহিংস ও জঙ্গীবাদী রূপ বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। সাবেক মন্ত্রী কর্নেল অব জাফর ইমাম বলেন, দেশে এখনও পুরোপুরি জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠা হয়নি। যা হচ্ছে তা জঙ্গীবাদের প্রাথমিক স্তর। এটা এখনই বন্ধ করা না গেলে ভবিষ্যতে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, সহিংসতা হচ্ছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সহিংসতা বন্ধ করা। বিদেশী ইন্ধনে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না, ক্ষমতায় কেউ থাকতেও পারবে না। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধরণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, দুই ধরনের সন্ত্রাসীর হাতে বিএনপি বন্দী হয়েছে। তার একদিকে রয়েছে পিকিংপন্থী সন্ত্রাসীরা। অন্যদিকে রয়েছে ইসলামী জঙ্গীবাদী সন্ত্রাসীরা। আন্দোলনের মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের কথা বলা হলেও অতীতের ফল বিবেচনায় এর ফলাফল শূন্য। আগেও একাধিকার সংলাপ হয়েছে। কিন্তু কোন সমাধান হয়নি। এখন কার সঙ্গে সংলাপ হবে। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস বন্ধ করতে হলে আগে অর্থের উৎস বন্ধ করতে হবে উল্লেখ করেন। বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশী ক্রেতারা আস্থা রাখতে পারছে না। কোন বিদেশীরাও আসছে না। রাজনীতিবিদরা দেশকে নিয়ে ভাবছে না। ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রাজনীতি চলে না। দেশের জন্য প্রয়োজন গঠনমূলক রাজনীতি। তিনি বলেন, যারা বোমা মারছে তারা রাজাকার।
×