ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সবাই বলে ‘ভ্যাকসিন আপা’

সংসার ভাঙ্গা সংগ্রামী সুফিয়া- জীবনযুদ্ধে জয়ী

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৮ মার্চ ২০১৫

সংসার ভাঙ্গা সংগ্রামী সুফিয়া- জীবনযুদ্ধে জয়ী

তাহমিন হক ববি ॥ সুফিয়া বেগম। এক সন্তানের জননী। যৌতুকের কারণে সংসার ভাঙ্গা এক সংগ্রামী নারী।‘ভ্যাকসিন আপা’ বললে এলাকার সবাই তাঁকে চেনে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর বাবার ভিটেয় ফিরে এলে প্রতিটি দিন কাটে তার নিদারুণ কষ্টে। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পড়ে যান অকূল পাথারে। চার দেয়ালের আলো-আঁধারিতে কাটতে থাকে তার কঠিন দুঃসময়। তিস্তার করাল গ্রাস বসতভিটাও কেড়ে নেয়। তবু দমে যায়নি সুফিয়া। শুরু করে জীবনের সঙ্গে কঠিন সংগ্রাম। ক্রমে তার হাতের নাগালে ধরা দেয় সাফল্য। তাই আজ জীবনযুদ্ধে জয়ী সুফিয়া। শূন্য হাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে এগোনো শুরু করেন সংগ্রামী এই নারী। সুফিয়ার জীবনযুদ্ধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় আরও কয়েক নারী। এভাবে সুফিয়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দুর্গম তিস্তাপারের গ্রামগুলো পরিবর্তিত হয়ে আজ যেন গবাদিপশুর চারণভূমি। পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি- এ কথাটির জ্বলন্ত প্রমাণ তিস্তাচরের সংগ্রামী মুখগুলো। কারণ তারা তিস্তায় তাদের সমস্ত সহায়-সম্পদ হারালেও হারাননি মনোবল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অভাবের সঙ্গে নিত্য লড়াই করে বেঁচে থাকা এই মানুষগুলো প্রমাণ করেছেন যে, বেকার নারীর হাতকেও কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করা সম্ভব। আর নারীরাও যে প্রয়োজনে সব করতে পারে তাও সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তারা, আর তাদের পুরোভাগে কা-ারি এই সাহসী নারী সুফিয়া। আজ সুফিয়া বেগমের সামাজিক উপাধি ‘ভ্যাকসিন আপা’। নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের তিস্তা নদীর কিসামত ছাতনাই চরের বাসিন্দা সুফিয়া। দুর্গম চরের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভ্যাকসিনের কাজ করে আজ স্বাবলম্বী নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। ১৯৯৪ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় একই ইউনিয়নের দক্ষিণ খড়িবাড়ি গ্রামের আব্দুস সামাদের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। এ কারণে আর লেখাপড়া এগোয়নি। বিয়ের প্রথম বছরেই কন্যা সন্তানের মা হন সুফিয়া। কিন্তু যৌতুক নামক দানবের নির্যাতনে দুই বছরের মাথায় স্বামীর সঙ্গে সংসার ভাঙ্গে তার। বাধ্য হয়ে মেয়ে শারমিন বেগমকে কোলে নিয়ে ফিরে আসেন অভাবী বাবা-মার সংসারে। এখানে ফিরে ১৯৯৭ সালে বাবাকে হারান সুফিয়া। ২০০১ সালে মা সকিনা বেগমও চিরতরে বিদায় নেন। আরও অন্ধকারে পড়ে যান তিনি। অসহায় থেকে চরম অসহায়ত্ব কুরেকুরে খেতে থাকে তাকে। এক পর্যায়ে তিস্তার বুকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চিন্তাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সেই অসৎ সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে নিজেই স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন সুফিয়া বেগম। প্রথমে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষেত-খামারে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। কোনওমতে দিন কাটতে থাকে তার। এরপর ভাগ্য পরিবর্তনের সিঁড়ির দেখা পেয়ে যান সুফিয়া। বেছে নেন নারী ও শিশুদের টিকা দেয়ার কাজ। এক সময় দেখা মেলে সরকারের সহায়তায় তিস্তাপারের হতদরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে অক্সফামের পল্লীশ্রী রিকল প্রকল্পের। সুফিয়া বেগম প্রকল্প কর্মকর্তাদের কাছে গরু-ছাগল ও মুরগি লালন-পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সুফিয়ার চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রথমে তাকে প্রাণী সম্পদের ভ্যাকসিনেশন ও চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর গবাদি পশু লালন-পালনে প্রশিক্ষিত হন তিনি। সুফিয়া বেগমের ভাষায়, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় একদা তিস্তাচরের বাসিন্দারা গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি পুষতে চাইতো না। কিন্তু প্রশিক্ষণ নেয়ার পর পল্লীশ্রীর স্থানীয় সেবাদানকারী হিসেবে প্রাণী সম্পদ রক্ষার উপকরণ হাতে পান তিনি। পরে চরবাসীর কাছে গবাদি পশু লালন-পালনে উৎসাহ যোগাতে থাকেন। তার চেষ্টায় গবাদি পশু পালনে উৎসাহ পায় চরবাসী। এরপর বড় পরিসরে শুরু হয় গবাদি-পশু পালন। বর্তমানে সুফিয়া তিস্তারচরের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগির ভ্যাকসিনেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের ওষুধ সরবরাহ করে থাকেন। নিজে হতদরিদ্র থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ পেয়ে চরবাসীদেরও উদ্বুদ্ধ করেন। মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন সুফিয়া। স্বামীর ঘরে মেয়ে সুখেই আছে। সুফিয়া জানান, ২০০৫ সাল থেকে আমি একটি ছেলেকে লালন-পালন করছি। ছেলেটির নাম সিয়াম হোসেন। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। সুফিয়ার স্বপ্ন সিয়ামকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চান তিনি। সুফিয়া বলেন, কষ্টের পরই যে সুখ আসে, এখন তা বুঝতে পারছি। বর্তমানে সুফিয়ার মাসিক আয় ৬ হাজার টাকার ওপরে।
×