ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিদ্যুতে ২ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে আগ্রহী চীন

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৮ মার্চ ২০১৫

বিদ্যুতে ২ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে আগ্রহী চীন

রশিদ মামুন ॥ দেশের বিদ্যুত খাতে প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার বা দুই লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে চীনা এক্সিম ব্যাংক। বিদ্যুত বিভাগের ১০ কোম্পানির ৬৫ প্রকল্পে এই অর্থ ব্যয় করা হবে। একবারে না দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধাপে ধাপে অর্থায়ন করা হবে। বিদ্যুত জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এরমধ্যে চীনা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। সরকারের দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুত উন্নয়ন পরিকল্পনায় ৪৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। সরকার বিদেশী দাতা সংস্থা এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেছে। এরমধ্যে চীনা এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশে ৩৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। ইতোমধ্যে চীনা এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে বিনিয়োগ প্রস্তাব এবং প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে। ওই আলোচনায় তারা বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগে বাংলাদেশের প্রস্তাবে সাড়া দেয়। বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বিনিয়োগ করতে চাইলেও এর সুদের হারসহ অন্যান্য শর্ত নিয়ে এখনও আলোচনা হয়নি। এর মধ্যে চীনের দুটি কোম্পানি বাংলাদেশে দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্র করার জন্য সরকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। প্রতিটি এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়নও করবে চীনা এক্সিম ব্যাংক। বিদ্যুত বিভাগ বলছে, বিদ্যুত উৎপাদনের সঙ্গে সঞ্চালন ব্যবস্থা উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করার চিন্তা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থা গ্রাহক ঘনিষ্ঠ করে তোলার জন্য প্রি-পেমেন্ট মিটারিং ব্যবস্থার প্রকল্পও রয়েছে। বিগত কয়েক বছরে এককভাবে বিদ্যুত উৎপাদনের দিকে মনযোগী হলেও বিতরণ এবং সঞ্চালনে সীমাবদ্ধতা ছিল। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সীমাবদ্ধতা কেটে যাবে। সরকারের পরিকল্পনায় দেখা যায় দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুত ব্যবস্থার উন্নয়নে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হবে। এরমধ্যে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে আসবে তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এছাড়াও কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন হবে ১৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, গ্যাস থেকে ৮ হাজার ৯৫৬ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েল থেকে ৫ হাজার ২১৭ মেগাওয়াট, ডিজেল থেকে ৫০০ এবং পানি থেকে আরও ১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত আসবে। সরকার মনে করছে বিদ্যুতের এইসব প্রকল্পে ৪০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। এছাড়া একই সময়ে সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নে আরও সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। চীনা এক্সিম ব্যাংকের কাছে দেয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির চার প্রকল্পে প্রয়োজন হবে এক হাজার ৭০০ মিলিয়ন ডলার, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের তিন প্রকল্পে নয় হাজার ২৬৫ মিলিয়ন ডলার, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির একটি প্রকল্পে এক হাজার ৯৯৯ মিলিয়ন ডলার, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) ২২ প্রকল্পে তিন হাজার ৮৬৯ মিলিয়ন ডলার, ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানির (ইজিসিবি) চার প্রকল্পে সাত হাজার ৯৪ মিলিয়ন ডলার, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) একটি প্রকল্পে ১৩০ মিলিয়ন ডলার, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর ১৪ প্রকল্পে তিন হাজার ৬৫ মিলিয়ন ডলার, ঢাকা ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) আট প্রকল্পে ২১৯ মিলিয়ন ডলার, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির (এপিএসসিএল) চার প্রকল্পে চার হাজার ৭০ মিলিয়ন ডলার এবং রুরাল পাওয়ার কোম্পানির (আরপিসিএল) চার প্রকল্পে এক হাজার ৩১০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। এর আগে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) পটুয়াখালির পায়রা বন্দরের কাছে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে বিদ্যুত কেন্দ্রটি বাস্তবায়ন হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি আমদানি করা কয়লা দিয়ে চালানো হবে। আনুমানিক দেড় বিলিয়ন ডলারের বিদ্যুত প্রকল্পটিতে বাংলাদেশ এবং চীন যৌথভাবে বিনিয়োগ করবে। কলাপাড়ায় মধুপুর এবং দেবপুর মৌজায় সরকারী খাসজমি রয়েছে। স্বল্পসংখ্যক মানুষকে পুর্নবাসন করলেই বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করা সম্ভব হবে। আন্ধারমানিক এবং রামনাবাদ নদীর মোহনায় বিদ্যুত কেন্দ্রটি স্থাপন করা হবে। এখানে গ্রীষ্ম মৌসুমে ছয় মিটার এবং বর্ষায় ১৩ মিটার ড্রাফট (পানির গভীরতা) পাওয়া যাবে। গভীর সমুদ্র থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরত্বে বার্জে কয়লা পরিবহন করা হবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রটির জন্য জমি অধিগ্রহণ এবং অন্যান্য কাজ শুরু হয়েছে। কোম্পানির ৩০ ভাগ অর্থ চীন এবং বাংলাদেশ সমানভাবে বিনিয়োগ করবে। বাকি ৭০ ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে সমান ক্ষমতার ৬৬০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট থাকবে। বর্তমান সরকারের মেয়াদে প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে। এছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে চীনের হুদিয়ান হংকং এর সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। চায়না হুদিয়ান হংকং চীনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি। এই কোম্পানির ৯০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। যার মধ্যে ৭০ ভাগই কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র বলছে, চায়না থার্মাল পাওয়ার স্টেশন এবং চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড বাংলাদেশের বিদ্যুত খাতে বড় বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, চায়না এক্সিম ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন প্রকল্প এবং প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ জানিয়ে সরকার একটি প্রস্তাব দেয়। ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশের বিদ্যুত খাতে সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। যাতে বলা হয়েছিল দ্রুত বাংলাদেশের অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুত এবং জ্বালানির প্রয়োজন। সরকার বিদ্যুত খাত সম্প্রসারণে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছে। দেশের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে। এছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব মানুষকে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আনা হবে। এর প্রেক্ষিতে এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধিরা ঢাকায় আসেন। তাঁরা দেশে বিপুল এই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখান। তবে এতে সুদের হার কি হবে তা এখনও নির্ধারণ হয়নি। যেহেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধাপে ধাপে অর্থের প্রয়োজন হবে তাই একবারে এই অর্থ দেয়া হবে না। অর্থ দেয়া হবে ধাপে ধাপে। ওই বৈঠকে সংস্থাপ্রধানরা প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরেন। জানতে চাইলে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের প্রকল্পে ঋণের বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে। চীনা এক্সিম ব্যাংকই কনসেশন লোন (সহজশর্তে ঋণ) হিসেবে বাংলাদেশ অংশের ৫০ ভাগ অর্থ দেবে। আর সিএমসি তাদের ৫০ ভাগ অর্থ বাণিজ্যিক ঋণ নেবে তাদের দেশ থেকে। অন্য প্রকল্পর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা বাকিগুলোতেও ঋণ দিতে চেয়েছে। তবে সব টাকা এক সঙ্গে দেয়া হবে না ধাপে ধাপে দেয়া হবে। এক সঙ্গে নিয়ে আমরা খরচও করতে পারব না। এই ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার শতকরা দুই ভাগের নিচে থাকবে বলে জানান তিনি।
×