ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মৌলবাদ উপেক্ষা করেই এগিয়ে চলেছে নারী

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৮ মার্চ ২০১৫

মৌলবাদ উপেক্ষা করেই  এগিয়ে চলেছে নারী

এমদাদুল হক তুহিন ॥ কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পচ্ছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬৮ লাখ। এর মধ্যে পোশাক শিল্পে কাজ করেন এমন নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩২ লাখ। আর্থিক মানদ-ে বিবেচনা করা হয় না এমন কাজেই নারী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সিপিডির এক গবেষণার তথ্য মতে নারীরা ঘরে কাজ করেন এমন কাজের আর্থিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কাজের বড় অংশটিই জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্তির বাইরে থেকে গেলেও নানা প্রতিকূল পরিবেশকে তুড়ি মেরে উন্নয়নের অর্ধাঙ্গীরা স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছেন। নারীরা এখন আর শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও কাজ করছেন। অভিবাসী নারীরা বিদেশে কাজ করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। তবে এত কিছুর পরও তারা কর্মক্ষেত্রে অবহেলিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য ছাড়াও মানসিক ও যৌন হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন প্রায়শই। মানুষে মানুষে সমতা এই নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে একদল নারী নিজের সাধ্যাতীত পরিশ্রম করছেন। মৌলবাদী অপশক্তির রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এগিয়ে চলেছেন এ দেশের নারী সমাজ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০১৩ সালের প্রকাশিতব্য শ্রমশক্তি জরিপ সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত আছেন। বিবিএস পরিচালিত ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায় দেশে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত ছিলেন। আর ২০০৬ সালে ওই সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে প্রায় ৪৯ লাখ নারী শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, যা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কর্মক্ষেত্রে ক্রমশ নারীর উপস্থিতি বেড়ে চলেছে। অবদান বাড়লেও এখনও কর্মক্ষেত্র নরাীদের অধিকার তেমনভাবে সুরক্ষিত হয়নি, নানা কারণে প্রায়শই বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। সুস্পষ্টভাবে আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। মজুরি দেয়া হয় না বা স্বীকৃতি নেই গৃহস্থালির এমন কাজে নারীদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। রান্না, বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পরিবারের সদস্যদের পরিচর্চা ও সন্তান লালনসহ নানা কাজে নারীর অবদান আর্থিক মানদ-ে বিবেচনা করা হয় না। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, নারী ঘরে কাজ করেন এমন কাজের আর্থিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি মূল্যে টাকার অঙ্কে যা ছিল ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। স্থায়ী মূল্যে তা ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ। ‘অর্থনীতিতে নারীর অবদান নিরূপণ : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক ওই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয় গত বছরের ২৬ অক্টোবর। ওই গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠে পুরুষের তুলনায় কোন কোন ক্ষেত্রে নারী অধিক কাজ করে গেলেও তাদের ও সব কর্মের অবদান জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত হয় না, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে কৃষিক্ষেত্রে নারীর অপরিসীম অবদান থাকা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রেও তারা অবহেলিত। কিষানী হিসাবেই এখনও তেমনভাবে স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী কৃষিতে নারীর অবদান গড়ে ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ। বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জায়গা নারীর হাতের আলতো স্পর্শেই শাকসবজি, সিম, কুমড়ো, লাউ, শসা ইত্যাদির ফলন হয়ে থাকে। যা ওই পরিবারের শাকসবজির প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করে, এমনকি অনেক সময় বাড়তি অংশটুকু বিক্রি করে বাড়তি আয় করাও সম্ভব হয়ে থাকে। এছাড়াও দেশের অনেক এলাকায় নারীরা বপন, রোপণ, নিড়ানিসহ ফসল পরিচর্চার কাজে সরাসরি নিয়োজিত আছেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে নারীকে প্রথমবারের মতো নারী যে কৃষক তার স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে এত বছর পরও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) তাদের অবদান অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। কিষানীদের নিয়ে আলাদা কোন পরিসংখ্যান নেই। কৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত নারীর শ্রমমূল্য পুরুষের অর্ধেক! আবার একই সময়ে নারীর প্রদত্ত শ্রম ঘণ্টার পরিমাণও বেশি হয়ে থাকে। অর্থাৎ তারা উভয় ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার। এ প্রসঙ্গে মজিরন নামের এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘ধানের খোলায় নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করি। পুরুষকে আট থেকে দশ হাজার টাকা দেয়া হলেও আমাদের দেয়া হয় মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা।’ দেশের পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, একই সঙ্গে এই খাতেই অবহেলা ও বঞ্চনাও বেশি। সরকারী বেসরকারী হিসাবে পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকে সংখ্যা প্রায় ৩২ লাখের ওপর। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারী ও রফতানিকারকদের সংগঠনের (বিজিএমইএ) তথ্য মতে, এ খাতে মোট ৪০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। যার ৮০ শতাংশই নারী। ১৯৭৮ সালে এদেশে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকেই এখাতে নারীর অবদান বাড়তে থাকে। বদলে যেতে লাগে তাদের জীবনধারণের বৈশিষ্ট্য। পোশাক শিল্পের কারণেই দেশ থেকে ‘কাজের মেয়ে’ প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে, একই সঙ্গে সমাজের অর্থনৈতিক পট পরিবর্তনেরও সূচনা শুরু হয়। দাবি করা হয়ে থাকে, পোশাক শিল্পের বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনের প্রায় সবটাই নারীদের হাত ধরে। তবে ওই খাতেই নারীরা সবচেয়ে অবহেলিত। গত কয়েক বছরে গার্মেন্টস সেক্টরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের আশানুরূপ পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও এখনও নানাভাবে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটে চলছেই! অর্থনৈতিক বঞ্চনার সঙ্গে সঙ্গে যৌন নিপীড়নের ঘটনা তো আছেই। বনানীতে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন সখিনা। তিনি প্রতিষ্ঠানের নাম জানাতে অস্বীকার করে বলেন, ফ্লোর ইনচার্জ নানাভাবে গালাগালি করে। কাজ ঠিকভাবে করলেও তাদের মন রক্ষা করে চলতে হয়। বিশ্রিভাষায় নানা অঙ্গভঙ্গি করে। তবে আগের চেয়ে এই প্রবণতা কমে এসেছে। নারী শ্রমিকরা কর্মসংস্থানের খোঁজে শুধু দেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিচরণ করছেন। তারা বিভিন্ন দেশে নানা কাজে নিয়োজিত হয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিবমেইটি) এক তথ্য মতে ১৯৯১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২ লাখ ৬ হাজার ৫২৫ নারীকর্মী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভিবাসী নারীরা অবদান রেখে চললেও কাজ করার ওই সময়টি হচ্ছেন নানাভাবে প্রতারিত। বিদেশ গমনের সময় কিংবা পরবর্তী সময়েও তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ছিনিয়ে নেয় আদম ব্যবসায়ীরা। কম মজুরি, গৃহকর্মের নামে যৌনদাসত্ব, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েও বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত আছেন তারা। হাইকমিশন ও দেশের পক্ষ থেকে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা সময়ের দাবি। সরকারী-বেসরকারী ও স্বায়ত্তশাষিত প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীর উপস্থিতি চোখে পড়ে না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ নানা রকম কুটির ও বণিক শিল্পে সমান দক্ষতা রেখে চলেছে। নারী শিল্প উদ্যোক্তার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিকূল পরিবেশেও নারীরা তাদের সক্ষমতার ছাপ রেখে চলেছে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে। মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিডিপিতে নারীর অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীরা পরিশ্রম করে আয় করলেও নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা ব্যয় করতে পারছেন না। পারিবারিকভাবে কখনও বাবা ও বড় ভাই দ্বারা প্রভাবিত হতে হয়। বিয়ের পর স্ত্রীরা তার অর্জিত অর্থ স্বাধীনভাবে ব্যয় করতে পারেন না। তবে সব ক্ষেত্রেই এমনটি নয়, উপার্জন করে নিজের মতে ব্যয় করতে না পারলে কিসের স্বাধীনতা! কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষে বৈষম্য প্রসঙ্গে এই নেত্রী বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। একই কাজে পুরুষকে ১০০ টাকা দেয়া হলে নারীকে দেয়া হয় ৬০ টাকা। পারিশ্রমিক বৈষম্য ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে নারীদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে মানবিকবোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন, নারী-পুরুষে কোন ভেদাভেদ হতে পারে না।
×