ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবার সাড়ে ২৭ কেজি স্বর্ণসহ ধরা পড়লেন কোরিয়ান কূটনীতিক

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৭ মার্চ ২০১৫

এবার সাড়ে ২৭ কেজি স্বর্ণসহ ধরা পড়লেন কোরিয়ান কূটনীতিক

আজাদ সুলায়মান ॥ এতদিন ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিছু বলা যেত না। লাগেজ চেক করা দূরের কথা, কোন প্রশ্নও করা যেত না। বুক ফুলিয়ে চলে যেতেন গ্রীন চ্যানেল দিয়ে। কারণ তিনি যে কূটনীতিক। তাকে প্রটোকল করার জন্য বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতো তিন-চারজন অফিসার। তারাই লাগেজ নিয়ে শিরোন্নত করে কাস্টমসের সামনে দিয়ে চলে যেতেন। কিন্তু বিপত্তি ঘটে শুক্রবার রাতে। এ রাতে কাস্টমস ছাই দিয়ে মাছ ধরার মতো কৌশলী হন। তাতেই মিলে যায় সফলতা। তারপর যা বের হয়ে এলো তা রীতিমতো চমকপ্রদ। তার লাগেজ যখন অনেকটা জোর করেই খোলা হলো তখন সবার চোখ ছানাবড়া। কেঁচো খুড়তে সাপ বের হওয়ার মতো অবস্থা। অবিশ্বাস্য পরিমাণ সোনার চালানের সন্ধান মিলে তাতে। এক দু’কেজি নয়। সাড়ে ২৭ কেজি। এই গুণধর কূটনীতিক হচ্ছেনÑ সং ইয়াং ন্যাম, ঢাকার উত্তর কোরিয়া দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি (ইকোনমিক এ্যাফেয়ার্স)। রাতেই তাকে আটক করা হয় বিমানবন্দরে। তাতে হৈচৈ পড়ে যায় রাতের বিমানবন্দরে। তোলপাড় চলে একটানা বার ঘণ্টা। শাহজালালে দেখা দেয় দু’দেশের কূটনীতিক, গোয়েন্দা ও পদস্থ কর্মকর্তাদের ভিড়। তাদের সঙ্গে ছিলেন জনকণ্ঠের এ প্রতিনিধিও। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার সূত্রপাত বৃহস্পতিবার রাতের হলেও যবনিকাপাত ঘটে শুক্রবার বেলা এগারটায়। এতে দেখা যায়, চোরাচালানের এত সোনাসহ হাতে-নাতে ধরা পড়লেও তাকে আটক রাখা যায়নি। ছেড়ে দিতে হয়েছে সসম্মানে। কেন? ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি অব চীফ প্রটোকল নাজমুল হাসান বললেন, “আটকের কোন বিধান নেই। ভিয়েনা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী কোন দেশে বিদেশী কোন কূটনীতিক যতো অপরাধই সংঘটিত করুক, তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। ব্যবস্থা নিবে তার নিজ দেশের আইন-কানুন ও প্রথা অনুযায়ী। এ শর্তেই ধৃত সংকে উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কাছে সোপর্দ করা হলো। এখন তারা তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয় সেটাই দেখার বিষয়।” সংকে বাংলাদেশের কোন আইনে আটক করা না গেলেও তার লাগেজ থেকে উদ্বারকৃত সোনা সবই জব্দ করা হয়েছে। কাস্টমস বিধিতে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। পরে এ মাল বাজেয়াফত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা রাখা হবে। কী ঘটেছিল বৃহস্পতিবার? কাস্টমস আগেই সোর্স থেকে জানতে পারেন ঢাকার উত্তর কোরিয়ার সেই কূটনীতিক রাত সাড়ে দশটার সিঙ্গাপুর ফ্লাইটে বিপুল পরিমাণ সোনাসহ আসছেন। এ তথ্য হাতে নিয়ে কাস্টমস অপেক্ষায়। রাত সাড়ে দশটায় ফ্লাইট ল্যান্ড করার পর কাস্টমস সব যাত্রীকে পাসপোর্ট হাতে রেখে নিজ নিজ মালামাল সম্পর্কে ঘোষণা দেয়। কিন্তু কেউ দেয়নি। তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা কোরিয়ার ওই নাগরিক সংকে দেখেই চমকে ওঠেন। তারা তার পিছু নেন। ইমিগ্রেশন পেরিয়ে কাস্টমস হলে যখন এগিয়ে আসেন তখন তাঁর হাতে হ্যান্ড ক্যারিজ। এ সময় তাঁকে রিসিভ করার জন্য এগিয়ে যান আরও তিনজন প্রটোকল অফিসার। গেটের কাছেই তাঁর গতিপথ রুখে দাঁড়ান কাস্টমসের যুগ্ম-কমিশনার কাজী জিয়াউদ্দিন। তিনি তাঁর পাসপোর্ট দেখতে চান। তাতে চরম বিরক্তি প্রকাশ করেন সং। বলেন, ডু ইউ নো আই এম এ ডিপ্লোম্যাট? তাতে কাজী জিয়াউদ্দিন অত্যন্ত বিনীত সংযত ও সতর্কতায় তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন লাগেজে সোনা আছে। তিনি তার লাগেজ চেক করতে চাইলে সং তাতে চেঁচামেচি শুরু করেন। তাতে বাধা দেন। রাত তখন সোয়া এগারোটা। এ প্রতিনিধি কাজী জিয়াউদ্দিনকে প্রশ্ন করেনÑ কিছু পেলেন কী? তিনি উত্তর দেনÑ এখন যান খোঁজা হচ্ছে, পরে পাবেন। জানা যায়, সং-এর লাগেজ চেক করা না করার দেন দরবারেই কেটে যায় চার ঘণ্টা। রাত তখন সাড়ে তিনটা। ততক্ষণে কাস্টমস হলে হুলস্থ’ুল কা-। সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে বিমানবন্দর কাস্টমস, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দফায় দফায় বৈঠক করেন। আর্মড পুলিশের এএসপি (মিডিয়া) তানজীনা আখতার ইভা বলেনÑ এ নিয়ে রাতে কাস্টমস হলে চলে চরম নাটকীয়তা। ইমিগ্রেশন শেষ করে গ্রিন চ্যানেল পার হওয়ার সময় কাস্টমস কর্মকর্তারা তার ট্রলি ব্যাগটি স্ক্যান করতে চান। এ সময় তিনি নিজের পরিচয় না দিয়ে লাগেজটি স্ক্যানে বাধা দেন। লাগেজ স্ক্যানে বাধা দেয়ার বিষয়টি সন্দেহ হলে কাস্টমস কর্মকর্তারা তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। এ সময় তিনি নিজের পরিচয় না দিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এবং বলেন, এটি কূটনৈতিক লাগেজ, তাই স্ক্যান করা যাবে না। এক পর্যায়ে তিনি দ্রুত গ্রিন চ্যানেল পার হয়ে আসেন। পরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা তাকে আটক করে এপিবিএন অফিসে নিয়ে যান। এ সময় তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকা বাংলাদেশে নিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার হাইকমিশনার মুন সং হো, ফার্স্ট সেক্রেটারি কো চো মিন, থার্ড সেক্রেটারি রি চোল সান, ডেপুটি চীফ অব মিশন কেং কিং এপিবিএন অফিসে যান। কিন্তু তারা নিজেদের পরিচয় না দিয়ে ন্যামকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাস্টমস কর্মকতাদের বারবার চাপ দিতে থাকেন। তানজীনা জানান, এক পর্যায়ে তারা একটি কূটনৈতিক পেপারস দেখিয়ে সেটি স্ক্যান না করার জন্য বলতে থাকেন। এ অবস্থায় খবর পেয়ে এপিবিএনের কমান্ডিং অফিসার (সিও) রাশেদুল হাসান, কাস্টমস কমিশনার হোসেন আহমেদ, যুগ্ম-কমিশনার কাজী মুহাম্মদ জিয়াউদ্দীনসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে ছুটে আসেন। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে এ অবস্থা চলতে চলতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে যায়। এক পর্যায়ে এপিবিএন কর্মকর্তারা ওই পাঁচ কূটনীতিককে লাগেজ রেখে চলে যেতে বলেন। এতেও তারা রাজি হননি। প্রত্যক্ষদর্শী একজন এপিবিএন কমর্কতা জনকণ্ঠকে বলেন, দেন-দরবারের এক পর্যায়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেন, ১ থেকে ২০ পর্যন্ত গণনা হবে, এ সময়ের মধ্যে যদি তিনি লাগেজ স্ক্যান করতে না দেন, তাহলে বল প্রয়োগ করা হবে। কাউন্টডাউনের ৮ এ এলে সং ইয়ং ন্যাম লাগেজটি হাত থেকে ফ্লোরে রেখে দেন। এরপর এপিবিএন সদস্যরা কৌশলে লাগেজটি স্ক্যান করতে নিয়ে যান। লাগেজটি স্ক্যানে দেয়া মাত্রই স্বর্ণের অস্তিত্ব মেলে। এরপর সেটি খুলে ১৭০ পিস বার (ওজন ১৯ কেজি) ও ৮ কেজি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া যায়।
×