ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

৭ মার্চ কেন ক্যান্টনমেন্ট দখল হলো না

প্রকাশিত: ০৫:০১, ৭ মার্চ ২০১৫

৭ মার্চ কেন ক্যান্টনমেন্ট দখল হলো না

একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় লাঠিসোটা নিয়ে এসেছিলেন যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে বেঁধে, মহানায়কের ঘোষণা শোনার জন্য, তাঁরা জানতেন, কঠিন লড়াই ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না। ঘুণাক্ষরে বিষয়টি কারও মাথায় আসেনি, জনসভা শেষে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানী সেনাদের ওপর সমাগত জনগণকে নিয়ে হামলা করলেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের পর পরই কথাটা ক্ষীণ হলেও কিছু কিছুু ভিন্নমতের মানুষেরা প্রশ্ন তুলতেন, তাঁদের লেখাতেও। যে, কেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় উপস্থিত ১৪/১৫ লাখ জনতাকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে পাকিস্তানী সেনাদের পর্যুদস্ত করলেন না। তাহলে ক্ষয়ক্ষতিসহ প্রাণহানি কম হতো। দেশও স্বাধীন হতো। এই ভাবনাটা ক্রমান্বয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যে সংক্রমিত হতে দেখা যায় তাঁদের গ্রন্থে। তাঁদের ভাবনাটা সেই সময়ের জনসভায় আসা জনের কাছে সরলীকরণই মনে হওয়া স্বাভাবিক। ভূ-বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শুধু নয়, এতদঞ্চলের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে স্বাধীনতার অনেক পরেও এমন প্রচারণাটা ব্যাপকতা পায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একজন বিদেশী সাংবাদিক কল্পনার মিশেল দেয়া বাংলাদেশ বিষয়ক গ্রন্থে এই তত্ত্বটি প্রচার করেন যে, সেদিন জনসভার লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করলেই পাকিস্তানী সেনারা পরাজিত হতোÑ আর দেশ স্বাধীন হতো। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সেক্টর কমান্ডার থেকে কমান্ডারসহ বাঙালী সামরিক কর্তারাও এই তত্ত্বে আক্রান্ত হয়েছেন। বিষয়টিকে তাঁরা তাঁদের গ্রন্থে বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদেরও আশা ছিল, যাঁরা নিজেরাই তখন পাকিস্তানী বিভিন্ন সেনাছাউনিতে কর্মরত, নিজেরা বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসার মতো সাহস ছিল না, ৭ মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে রেসকোর্স ময়দান থেকে। আশা করেছিলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’ বলবেন বঙ্গবন্ধু। তারপর জনতা লাঠিসোটা নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবে। আর তাতেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। এই ভাবনা যাঁদের, তাঁরা যে সার্বিক বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছিলেন, তা স্পষ্ট। এদের ধারণায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার ঘটনা আসে না। একটি দেশের বিজয়ী নেতা, যাঁকে দেশের মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে; যিনি দেশ পরিচালনা করবেন, তিনি সময় বাস্তবতায় সিদ্ধান্ত নেবেন হঠকারিতার, এমন ভাবনা বাস্তবতাবিবর্জিত। ৭ মার্চ স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন বাঙালীর পথরেখা কোন দিকে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মানুষ বুঝে নিয়েছিল ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার সময় এখন। ৭ মার্চ নয়, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ আর এই স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি হতে জনগণকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু কোন্ পরিপ্রেক্ষিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, জনগণ তাঁর কাছ থেকে সেদিন কী চেয়েছিলেন, তিনি কী দিয়েছিলেন, কেন তিনি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি; দিলে কী হতো পারত ইত্যাদি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর জানা থাকার পরও অযথাই বিভ্রান্তির সম্ভাবনা বাড়ে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, চীনাপন্থীরাও তাদের লেখায় এসব প্রসঙ্গ টেনে আনেন, এটা বুঝাতে যে, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। কূপম-ূকতা তাদের স্বাভাবিক চিন্তার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে পদে পদে। তারা কিছুতেই বুঝতে চায় না যে, প্রতিটি পদক্ষেপই যে শেখ মুজিব সতর্কভাবে ফেলেছেন, তা ইতিহাসের দিকে সুনজরে, নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকালেই স্পষ্ট হয়। শেখ মুজিব নাশকতাকারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ছিলেন না। তাঁর জীবন সংগ্রামই জানান দেয়, কখন কোন্ পদক্ষেপ নিতে হবে, তার সমীকরণ জানা ছিল। তাই পলাতক কাপুরুষের মতো আচরণ কখনও গ্রাস করেনি। সাহসের দৃঢ়তায় তিনি পাকিস্তানের চব্বিশটি বছর ধাপে ধাপে এগিয়ে অনেক জনপ্রিয় নেতাকে ডিঙ্গিয়ে জনগণের একমাত্র নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ থেকে তাঁর অসাধারণে উত্তরণ মেনে নিতে না পারারা নানাভাবে বিরোধিতা করে আসছেন বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশা হতেই। ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়, একাত্তরের ৬ মার্চ ইয়াহিয়ার স্থগিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ২৫ মার্চ হবে বলে ঘোষণার পর সার্বিক পরিস্থিতির একটুও বদলায়নি। বরং জনগণ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিদ্রোহ তখন চারদিকে। ‘৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন’Ñ এমন কথা নানাভাবে উচ্চারিত হতে থাকে দেশজুড়ে। দেশের জনগণও স্বাধীনতার পথে, একদফার পথে বঙ্গবন্ধুকে অগ্রসর হওয়ার জন্য সর্বাত্মক সহায়তা দিতে থাকে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ বিচ্ছিন্নতার পথে, স্বাধীনতার পথে অগ্রসর না হওয়ার জন্য শেখ মুজিবকে চাপ দিতে থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ৭ মার্চ সকালে দেখা করে এ ব্যাপারে তাদের মনোভাব বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেন। রাষ্ট্রদূত জানান যে, পাকিস্তান থেকে পূর্ববঙ্গ বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি মার্কিন সরকার ভালভাবে নেবে না এবং সমর্থনও করবে না। সেই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কী হতে পারে, তা নিয়ে দলের নেতারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তের ভার এককভাবে শেখ মুজিবকেই দেন। রেসকোর্সে সমাবেশ চলাকালে আকাশে উড়ছিল পাকিস্তানী বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার মেশিনগান নিয়ে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ছিল সেনারা সতর্ক। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোন ব্যাটালিয়ন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ছিল না তখন। বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, তবে সর্বাত্মক আক্রমণের যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। বঙ্গবন্ধুসহ নেতা-জনতার ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটত। পাকিস্তান তখন বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে হত্যা করতে পারত এবং তাতে বৈধতা পেত। দেশজুড়ে চলত ভয়াবহ দমননীতি। প্রতিরোধ করার জন্য সংগঠিত হওয়ার সুযোগ মিলত না। যে গণহত্যা তারা একাত্তরের চালিয়েছে, তার বেশি হত্যা করত। স্বাধীনতা আর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যে তফাত রয়েছে, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে ভ্রান্তি আসে না। যদিও জনগণের কাছে স্বাধীনতা তখন একমাত্র চাওয়া। কিন্তু শেখ মুজিব তো বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা নন। নিয়মতান্ত্রিক ধারায় ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। তাই তিনি জনসভার ১৫ লাখ লোকের সমর্থনে স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ক্যান্টনমেন্ট তাদের নিয়ে আক্রমণের ফলাফল কী তা শেখ মুজিবের জানা ছিল। ছিলেন তিনি দূরদর্শী তাই পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং তা সফল হয়েছে। সেদিন দেশের অন্যান্য স্থানের ক্যান্টমেন্টগুলোর পাকিস্তানী নেতারা নিশ্চয়ই হাত গুঁটিয়ে বসে থাকত না। বাঙালী সেনারাও তাদের সমর্থন করত। কারণ ২৫ মার্চের পর যুদ্ধ চলাকালে অনেক বাঙালী সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তানীদের পক্ষাবলম্বন শুধু নয়, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছে। বাঙালী সেনারা তখনও মোটিভেটিভ হননি। তাই তারা ৭ মার্চ বিদ্রোহ করে জনসভায়ও আসেননি। তৎকালীন সময়ের বাস্তবতায় শেখ মুজিব পুরো পাকিস্তানের নেতা, যাঁর হওয়ার কথা তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ইয়াহিয়া খান একাত্তরের গোড়ায় শেখ মুজিবকে ‘মি: প্রাইম মিনিস্টার’ সম্বোধনও করেছিলেন। ৬ দফা তথা পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার দাবি থেকে একটু সরে এলেই তিনি তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পারতেন। কিন্তু স্বপ্ন তো তাঁর বাংলার স্বাধীনতা। দাবি হতে এক ইঞ্চিও সরে আসেননি। বিশ্ব ও স্বদেশ রাজনীতির বাস্তবতার আলোকে জনগণকে ধাপে ধাপে তৈরি করেছেন স্বাধীনতার দিকে। হিসাব না কষে, ভাবাবেগতাড়িত হয়ে ‘খেয়ালখুশি’র কাজ তিনি করেননি। তাছাড়া কোন হঠকারিতায় কখনও আস্থা ছিল না বঙ্গবন্ধুর। তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানীরা সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করুক, যেখানে তারা বাঙালীর হাতে ক্ষমতা না দিতে বদ্ধপরিকর। বরং পাকিস্তানীরা নিজেরাই বাংলা ছেড়ে দেবে। যা ভুট্টো চেয়েছিলেন বলে পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতি সেদিকেই নিয়ে গিয়েছিলেনÑ যেখানে স্বাধীনতার কোন বিকল্প নেই। দেখা যায় যে, বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সে ডাকে সাড়ে সাত কোটি মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১ কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছিল। কিন্তু তারপরও ভারত ও ভুটান ছাড়া বিশ্বের আর কোন দেশ নয় মাসে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। কমনওয়েলথ দেশগুলোও নয়। এমনকি সমাজতন্ত্রীরাও নয়। সুতরাং ৭ মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে প্রতিবেশী ভারত তো নয়ই, বিশ্বের কোন দেশই সমর্থন করত না। আর সেনাছাউনিতে হামলার জন্য নাশকতাকারী হিসেবে চিহ্নিত হতেন। এতে স্বাধীনতার সব আয়োজনই বিনষ্ট হতো। ক্যান্টনমেন্টের বাঙালী সেনারাও সমর্থনে এগিয়ে আসতেন না। যদি তাই হতো, তবে তাঁরা ২৫ মার্চের আগেই বিদ্রোহ করতেন। যখন সারাদেশ শেখ মুজিবের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হচ্ছিল। (চলবে)
×