সংঘাতের মাঝে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। আবার এই ভাষণগুলো ইতিহাসের গতিধারাকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। জ্যাকব এফ ফিল্ড তাঁর ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেচ’ বইটিতে ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ৪১টি ভাষণ সংগ্রহ করেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে মাইকেল ও’ মারা বুকস লিমিটেড। এই ৪১টি ভাষণের একটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। বাঙালী হিসেবে এটি আমাদের গর্বের। রেকর্ড করা এই ভাষণটি আমরা বহুবার শুনেছি। বার বার আমরা শুনি। ভাষণটির আবেগ আর আবেদন আমাদের মনকে আবেগাপ্লুত করে দেয় বার বার। আর ৪০টি ভাষণ সম্বন্ধে আমাদের জানা উচিত এই জন্য যে, এই ভাষণগুলো আমাদের সাহায্য করবে মনে করে দিতে ইতিহাসের ৪০ জন শ্রেষ্ঠ মানুষের কথা। এঁদের একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণগুলো আমাদের সাহায্য করবে মনে করে দিতে ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনার কথা। বাক্য আর শব্দ যে কত শক্তিশালী হতে পারে তা আমরা বুঝতে পারব। এসব ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই সংগ্রাম যে সব সময় বিজয় কেড়ে এনেছে তা নয়, তবে মানুষের স্মৃতিভাণ্ডারে গচ্ছিত থেকেছে দীর্ঘকাল ধরে যা পরে ইতিহাসের দিকনির্ণয়ক হয়েছে।
সংগৃহীত এই ভাষণগুলোর প্রথমটি দিয়েছিলেন গ্রীসের সমর নায়ক পেরিক্লিস। তিনি ক্ষমতায় আসেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৬১ সালে। তখন গ্রীস কয়েকটি নগর রাষ্ট্রে (ঈরঃু ঝঃধঃবং) বিভক্ত ছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল এ্যাথেন্স ও স্পার্টা। এ্যাথেন্স আর স্পার্টা যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকত। এ্যাথেন্সের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে পেরিক্লিস এই ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি জনগণকে বলেছিলেন, এ্যাথেন্সের সৌন্দর্য দু’চোখ দিয়ে উপভোগ করতে থাকুন। যখন তার গৌরবগাথা আপনার মন ভরিয়ে দেবে তখন মনে করুন সেসব বীরদের কথা, যারা অসীম সাহসের সঙ্গে এই দেশ সৃষ্টি করেছিলেন।
দিগি¦জয়ী আলেকজান্ডার গ্রীস থেকে যাত্রা শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে ভারতের পূর্বপ্রান্তে পৌঁছান। পূর্ব ভারত জয় করার পর তিনি আরও পূর্বদিকে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেনানায়করা অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি তাঁদের রাজি করনোর জন্য একটি আবেগময় ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আমরা তো মেসিডোনিয়াতে নিজের বাড়ি পাহারা দিয়ে আরামে থাকতে পারতাম। কিন্তু আমাদের আকাক্সক্ষা আমাদের এতদূরে নিয়ে এসেছে। চলুন আমরা আমাদের বিজয়ের সঙ্গে আরেকটু যোগ করি। যাঁরা ফিরে যেতে চান তাঁরা ফিরে যেতে পারেন। আর যাঁরা থাকতে চান তাঁরা তাঁর সঙ্গে থাকতে পারেন। তবে যাঁরা থেকে যাবেন তাঁরা ফিরে যাওয়া মানুষদের ঈর্ষার পাত্র হবেন। ক্লান্ত আর দেশে ফেরার জন্য উন্মুখ সেনানায়কদের আলেকজান্ডার আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।
একাদশ শতাব্দীতে বাইজান্তাইন সম্রাট তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধে কিছুতেই পেরে উঠছিলেন না। এদিকে তাঁর অর্থের ভাণ্ডার প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে পৌঁছায়। তিনি পোপ দ্বিতীয় আরবানের কাছে সাহায্য চেয়ে দূত পাঠান। ধর্মযুদ্ধে যোগদানের জন্য পোপ খ্রীস্টানদের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এই যুদ্ধে যাওয়ার সময় বা এই যুদ্ধে যাঁরা প্রাণ হারাবেন তাঁদের সব পাপ গড মাফ করে দেবেন। এরপর শুরু হয় মুসলমান ও খ্রীস্টানদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই, যা ইতিহাসে ক্রুসেড নামে পরিচিত।
ক্রুসেডে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন সুলতান সালাহউদ্দিন। ১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি একটি ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ৯১ বছর ধরে বিধর্মীরা জেরুজালেম দখল করে আছে। এতদিন আমরা আল্লাহর কাছে এবাদত করতে পারিনি। এবার সুযোগ এসেছে, আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা জেরুজালেম উদ্ধার করতে পারি। মুসলমানরা এই ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রুসেডে যোগ দেয়।
আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন জর্জ ওয়াশিংটন। একপর্যায়ে আমেরিকার অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। অর্থের অভাবে সৈন্যদের বেতন দেয়া যাচ্ছিল না। জর্জ ওয়াশিংটন সৈন্যদের কথা দেন যে, তিনি সব বকেয়া টাকা দিয়ে দেবেন। সৈন্যরা তবু সন্তুষ্ট হয়নি, সেনা বিদ্রোহের সম্ভাবনা দেখা দেয়। সৈন্যদের উদ্দেশে ১৭৮৩ সালের ১৫ মার্চ তিনি একটি হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আমি তোমাদের কথা দিয়েছি, সে কথা রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব। কিন্তু তোমরা এমন কিছু করো না যাতে তোমাদের সৃষ্টি করা গৌরব নিন্দায় পরিণত হয়।
আমেরিকায় ১৮৬১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথাকে কেন্দ্র করে। ১৮৬৩ সালের গেটিসবার্গ যুদ্ধে দাস প্রথার পক্ষের দক্ষিণাঞ্চল পরাজিত হয়। ১৮৬৪ সালে পুনর্নির্বাচিত হলে তাঁর সামনে আরেকটি সমস্যা দেখা দেয়। আর তা হলো গৃহযুদ্ধের পারস্পরিক বিদ্বেষ ভুলে জাতিকে একত্রিত করা। এই পটভূমিকায় ১৮৬৫ সালের ৪ মার্চ তিনি উদ্বোধনী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়; বরং সবার প্রতি প্রীতির হাত বাড়িয়ে আসুন আমরা আমাদের কাজ শেষ করি। যারা আহত হয়েছেন, যুদ্ধের কারণে হওয়া বিধবা আর এতিমদের সঙ্গে নিয়ে আসুন আমরা স্থায়ী শান্তির জন্য কাজ করি।
লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আত্মরক্ষার জন্য সরকার একটি সামরিক বাহিনী গঠন করে, যার নাম দেয়া হয় ‘লাল ফৌজ’। এদিকে তাঁদের বিরোধীরা ভূস্বামী, শিল্পপতি ও কয়েকটি বিদেশী সরকারের সাহায্যে গঠন করে ‘সাদা বাহিনী’। সাদা বাহিনী রাশিয়াকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করে নবগঠিত সরকারের বিরুদ্ধে। এমনি পটভূমিকায় ১৯১৯ সালের ২৯ মার্চ লাল ফৌজের উদ্দেশে ভাষণ দেন লেনিন। তিনি বলেন, ব্রিটেন, আমেরিকা ও ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। রাশিয়ার শ্রমজীবী মানুষ আর কৃষকরা ভূস্বামী আর পুঁজিপতিদের উৎখাত করেছে। এজন্য বিদেশী শক্তি প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু তারা সক্ষম হবে না। আপনারা একতাবদ্ধ থাকুন, একনিষ্ঠ থাকুন, শক্ত থাকুন। সাহসের সঙ্গে শত্রুর মোকাবেলা করুন। জয় আমাদের হবেই। ভূস্বামী আর পুঁজিপতিদের শক্তিকে রাশিয়াতে ধ্বংস করা হয়েছে। এটা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে।
চীনের বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাও সে তুং। ১৯৪৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এক ভাষণে তিনি বলেন, বিপদের সময় আমরা যেন আমাদের অর্জনকে ভুলে না যাই। আমরা যেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভাবি আর সাহস সঞ্চয় করি। চীনের মানুষ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে, তাদের জন্য আমরা যেন সংগ্রাম করি। যেখানে সংগ্রাম সেখানেই মৃত্যু। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে রয়েছে মানুষের জন্য মঙ্গল কামনা। তাদের জন্য মৃত্যুবরণ করা গৌরবের। কিন্তু আমরা যেন অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুবরণ না করি। আমাদের কর্মীদের যেন থাকে সহকর্মীদের জন্য সহমর্মিতা এবং তারা যেন একে অপরকে ভালবাসে এবং পরস্পরকে সাহায্য করে।
চিলির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি স্যালেভদর আলেন্দেকে আক্রমণ করে সেনাবাহিনী। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে রেডিও মারফত জাতির উদ্দেশে তিনি একটি ভাষণ দেন। মনুষ্যত্বের কী মহৎ প্রকাশ! তিনি বলেন, আপনাদের কিছু বলার এটাই আমার শেষ সুযোগ। বিমানবাহিনী রেডিওর এ্যান্টেনাতে বোমা মারছে। আমি আপনাদের জানাচ্ছি, আমি পদত্যাগ করব না। জনগণের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য আমি আত্মত্যাগ করব। তাদের শক্তি রয়েছে এবং কিছুদিনের জন্য তারা হয়ত আমাদের ওপর খবরদারি করতে পারে কিন্তু সামাজিক প্রক্রিয়াকে অপরাধ বা শক্তি দিয়ে থামিয়ে রাখা যায় না। ইতিহাস আমাদের পক্ষে এবং জনগণ ইতিহাস সৃষ্টি করে।
স্থানসঙ্কুলানের সমস্যার কারণে আমরা মাত্র কয়েকটি ভাষণের কথা উল্লেখ করলাম। অন্য ভাষণগুলোও মহৎ ব্যক্তিদের দেয়া মহতী ভাষণ। পৃথিবীর ইতিহাসের ৪১টি শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একটি। এটি আমাদের সবার জন্য অহঙ্কারের। জাতির চরম বিপদের দিনে তিনি আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই আদর্শিক নির্দেশনা আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে।
লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইক্রিয়াট্রিক্সের ফেলে