ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কোয়ার্টার ফাইনালের সুবাস পাচ্ছে টাইগাররা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৬ মার্চ ২০১৫

কোয়ার্টার ফাইনালের সুবাস পাচ্ছে টাইগাররা

মিথুন আশরাফ ॥ বিশাল রান করে ফেলল স্কটল্যান্ড। স্কটল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের ব্যক্তিগত সবচেয়ে বেশি ১৫৬ রান করলেন কাইল কোয়েটজার। তাঁর এ দুর্দান্ত ইনিংসে ৩১৮ রান তুলে ফেলল স্কটল্যান্ড। এ রান তুলতে যে কোন দলকেই চাপে পড়তে হতো অথচ বাংলাদেশ কী সহজেই না এ রান করে ফেলল। তাও আবার ৪ উইকেট হারিয়ে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান করলেন তামিম ইকবাল (৯৫)। তাঁর সঙ্গে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ৬২, মুশফিকুর রহীমের ৬০, সাকিব আল হাসানের অপরাজিত ৫২ ও সাব্বির রহমান রুম্মনের অপরাজিত ৪২ রানে অনায়াসেই ৪৮.১ ওভারে ৩২২ রান করে ফেলল বাংলাদেশ। জয়ও পেল ৬ উইকেটে। সেই জয় আসল আবার বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রান টার্গেট অতিক্রম করেই। এর আগে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে বুলাওয়েতে ৩১৩ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ৪ উইকেটে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। এবার সেই ইতিহাসকেও হার মানাল বাংলাদেশ। শুধু কি তাই, বিশ্বকাপ ইতিহাসেও বর্ণিল অধ্যায়ে নাম লেখাল টাইগাররা। টার্গেট অতিক্রম করে জয় পাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টার্গেট অতিক্রম করল বাংলাদেশ। এর আগে ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ছুড়ে দেয়া ৩২৮ রানের টার্গেট অতিক্রম করে সবচেয়ে বড় জয়টি পেয়েছিল আয়ারল্যান্ড। সেই হিসেবে বাংলাদেশই বিশ্বকাপে সবার ওপরে আছে। টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে বেশি টার্গেট অতিক্রম করে বিশ্বকাপে জয় পেয়েছে। এ জয়টি পেয়ে এখন গ্রুপ পর্বে নিউজিল্যান্ড (৪ ম্যাচে ৪ জয়ে ৮ পয়েন্ট), শ্রীলঙ্কা (৪ ম্যাচে ৩ জয়, ১ হারে ৬ পয়েন্ট), অস্ট্রেলিয়ার (৪ ম্যাচে ২ জয়, ১ হার ও ১ ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে ৫ পয়েন্ট) পরেই আছে বাংলাদেশ (৪ ম্যাচে ২ জয়, ১ হার ও ১ ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে ৫ পয়েন্ট)। অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের পয়েন্ট সমান। কিন্তু রানরেটে (অস্ট্রেলিয়ার +১.৮০৪ ও বাংলাদেশের +০.১৮২) অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে রয়েছে। তাই বাংলাদেশ পয়েন্ট তালিকার চতুর্থ স্থানে আছে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টি পেয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পথে আরেকধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। কোয়ার্টার ফাইনালের আরও কাছে চলে গেল। এখন বাংলাদেশের বাকি আছে গ্রুপ পর্বের আরও দুটি ম্যাচ। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড (৯ মার্চ, এ্যাডিলেডে) ও নিউজিল্যান্ড (১৩ মার্চ, হ্যামিল্টনে)। যে কোন একটি ম্যাচ জিতলেই কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যাবে বাংলাদেশ। আর যদি কোনভাবে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ডের ম্যাচটিতে না হারে (পরিত্যক্ত হওয়া কিংবা টাই হওয়া) বাংলাদেশ, তাহলে মাশরাফিবাহিনী এক ম্যাচ হাতে রেখেই কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যাবে। আর যদি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জিতে যায়, তাহলে কথাই নেই। ২০০৭ সালের পর আবারও বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে খেলবে। হার হলে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তখন জিততেই হবে বাংলাদেশকে। গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে যে জিতবে ইংল্যান্ড তা অঘটন না ঘটার আগে সবার অনুমিতই। নেলসনের সেক্সটন ওভাল মাঠটি তুলনামূলক ছোট্ট। সেই মাঠে ২৫০, ৩০০ রান যেন কোন ব্যাপারই না। এ মাঠে অলআউট হয়েছে শুধু একটি দলই, শ্রীলঙ্কা। জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চতুর্থ ওয়ানডেতে। তাও রান হয়েছে ২৭৬! বৃষ্টির বাধা ছাড়া কোন ম্যাচ হয়েছে, সেই ম্যাচে এটিই এ মাঠে সর্বনিম্ন রান। ৩০০ রানের বেশি হয়েছে চার বার। ২৫০ রানের বেশি হয়েছে পাঁচবার। এ মাঠেই এবার বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছে আয়ারল্যান্ড। অঘটন ঘটিয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের গড়া ৩০৪ রানকে সহজেই অতিক্রম করে ফেলে আয়ারল্যান্ড! বোঝাই যাচ্ছে, এ মাঠে বেশি রান হওয়াটা যেন স্বাভাবিক বিষয়। আরেকটি বিষয়ও আছে। এ মাঠে এর আগে খেলা হয়েছিল চারটি ম্যাচ। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে নিউজিল্যান্ড যে জিতে, সেটি বৃষ্টি আইনে জেতে এবং রানে জেতে। এছাড়া সব ম্যাচেই পরে ব্যাটিং করা দল জিতেছে। টার্গেট কোনটাই ২৫০ রানের নিচে ছিল না। এমনকি দু’বার ৩০০ রানেরও বেশি ছিল। সেই টার্গেট অতিক্রম করেই জয় মিলেছে। বাংলাদেশও তাই করল। টস জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্তই নিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। স্কটল্যান্ডের ছুড়ে দেয়া বিশাল টার্গেট অনায়াসেই ১১ বল বাকি থাকতেই অতিক্রম করে ফেলল। এ উইকেটে যে বোলারদের জন্য কিছুই নেই, তা আরেকবার ভালভাবেই বোঝা গেল। পেসার তাসকিন আহমেদ ৩ উইকেট নিলেন। তবে তা হলো ছন্নছাড়াভাবেই। ৩৮ রানে স্কটল্যান্ডের ২ উইকেট তুলে নেয়ার পর মনে হয়েছিল, কম রানেই গুটিয়ে যাবে দলটি। কিন্তু এরপরই ঘুরে দাঁড়াল। তৃতীয় উইকেট তুলে নিতে ১১৬ রান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। চতুর্থ উইকেটে তো আসল কাজটিই করে ফেলল স্কটল্যান্ড। অধিনায়ক প্রেসটন মোমসেন ও কোয়েটজার মিলে ১৪১ রানের জুটি গড়ে ফেললেন! যে জুটি দলকেও ২৫৭ রানে নিয়ে গেল। স্কটল্যান্ড ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করা মোমসেন ৩৯ রান করে আউট হলেও ততক্ষণে কোয়েটজার একাই যা করার করে ফেললেন। ২৬৯ রানে কোয়েটজারকে আউট করলেন নাসির হোসেন। ততক্ষণে ১৩৪ বলে ১৭ চার ও ৪ ছক্কায় ১৫৬ রান করে ফেললেন কোয়েটজার। এরপর আরও তিনটি উইকেট পড়ল, স্কটল্যান্ডের ৮ উইকেটের পতনও ঘটল; কিন্তু সবাই কোয়েটজারেই মোহিত হয়ে থাকল। আইসিসির সহযোগী দল হয়েও স্কটল্যান্ড শিবিরে এমন এক ব্যাটসম্যান লুকিয়ে ছিলেন, যিনি বাংলাদেশের বিপক্ষে সহযোগী দলগুলোর ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান করার ক্ষমতা রাখেন। এর আগে যে, ২০১০ সালে আইসিসির সহযোগী দেশ আয়ারল্যান্ডের পোর্টারফিল্ড ১০৮ রান করেছিলেন, সেই ইনিংসকেও পেছনে ফেলে দিলেন কোয়েটজার। ম্যাচ শেষে তাই বাংলাদেশ জিতলেও কোয়েটজার ধ্বনিই শুধু বেজেছে। ম্যাচসেরাও হয়েছেন কোয়েটজারই। এ ব্যাটসম্যানের এমন স্কোর বাংলাদেশকেও খানিক কাঁপিয়ে দিয়েছে। এত বড় স্কোর গড়েছে স্কটল্যান্ড। যতই নেলসনের এ মাঠের ইতিহাস বাংলাদেশের পক্ষে থাকুক, যদি ব্যাটসম্যানরা চাপ নিয়ে মাথা গরম করে খেলতে শুরু করেন, তাহলেই তো জয়ের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে! কোথায় কী। বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা যেন আগেই বুঝে যান, এ রান কোন ব্যাপারই না। ধীরে ধীরে রানের গতি ঠিক রেখে এগিয়ে গেলে জয় আসবেই। তবে শুরুতেই যে ৫ রানে সৌম্য সরকার (২) আউট হয়ে যান, সেখানেই একটু ভয় ঢুকে যায়। কিন্তু এরপর একবারের জন্যও বাংলাদেশ হারতে পারে বোঝাই যায়নি। ব্যাটসম্যানরা তা বুঝতেই দেননি। দ্বিতীয় উইকেটে তামিম-মাহমুদুল্লাহ মিলে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে ১৩৯ রানের রেকর্ড জুটিই গড়ে ফেললেন। প্রথম উইকেট পড়ার পর যে ব্যাটসম্যানরা নিজেদের মেলে ধরেছেনÑ ১৪৪ রানে মাহমুদুল্লাহ, ২০১ রানে তামিম, ২৪৭ রানে মুশফিক আউট হন। এরপর আর কোন উইকেটই হারাতে হয়নি বাংলাদেশকে। জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন সাকিব ও সাব্বির। এর মধ্যে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম শতক করার যে আশা প্রকাশ করেছিলেন তামিম, মাত্র ৫ রানের জন্য স্বপ্ন সফল করতে পারেননি। তবে অনুমিতভাবেই আফগানিস্তানের পর স্কটল্যান্ডকেও হারাল বাংলাদেশ। তবে ম্যাচটিতে একটি দুর্ঘটনাও ঘটল। দুঃসংবাদও মিলল। ফিল্ডিং করার সময় এনামুল হক বিজয় যে কাঁধে আঘাত পেলেন। সেই আঘাতে তাঁর দুটি ফ্র্যাকচারও ধরা পড়ল। বিশ্বকাপও তার শেষ হয়ে গেল। তবে দ্রুত দেশে ফিরে আসার আগে বাংলাদেশের জয়ই দেখে এলেন বিজয়। যে জয়টি কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার আরও কাছে নিয়ে গেল বাংলাদেশকেও।
×