ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অবরোধে এত ক্ষতির পরও অর্থনীতির ভিত এখনও অটুট

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৬ মার্চ ২০১৫

অবরোধে এত ক্ষতির পরও অর্থনীতির ভিত এখনও অটুট

রহিম শেখ ॥ দুই মাসব্যাপী টানা অবরোধ ও হরতালে বড় অংকের অর্থনৈতিক ক্ষতি হলেও শক্ত অবস্থানেই রয়েছে দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতির প্রায় সব সূচক এখনও ইতিবাচক। দেশের রিজার্ভ, রেমিটেন্স এখনও উর্ধমুখী। আমদানি ব্যয় ও রফতানি আয় বাড়ছে। বাড়ছে পণ্য পরিবহন। স্বাভাবিক হয়ে এসেছে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। হরতালের আগুনে যে কৃষকের স্বপ্ন পুড়েছিল, সেই কৃষকই এখন স্বপ্ন দেখছে। খেটেখাওয়া নিম্নআয়ের মানুষগুলোও আর বসে নেই। অবরোধের আগুনে দগ্ধ হয়ে যে শিল্পের চাকা থেমে গিয়েছিল, সেটিও এখন অনেকটাই সচল। রাজনীতির আগুনে পুড়ে যাওয়া পোশাকশিল্পও ক্ষত সারিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। ‘পুঁজি’ হারিয়ে নিঃস্ব-রিক্ত সেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা বলছেন সরকারের সহযোগিতার কথা। তবে সামনের দিনগুলোতে এভাবে হরতাল-অবরোধ চলতে থাকলে শক্ত অর্থনীতি দুর্বল হতে বেশি সময় লাগবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গত দুই মাস ধরে বিএনপির ডাকা টানা অবরোধ চলছে। সেই সঙ্গে চলছে ঘণ্টা মেপে হরতাল কর্মসূচী। কিন্তু এই কর্মসূচীতে প্রতিদিনই পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছে বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধা ২০ দল। অবরোধ-হরতালে নাশকতা ও যানবাহনে পেট্রোলবোমা হামলায় সারাদেশে এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। আগুনে দগ্ধ হয়েছেন আরও দুই শতাধিক মানুষ। এ পর্যন্ত প্রায় ১৮শ’ যানবাহনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ১৮ দফা নাশকতা চালানো হয়েছে রেলে। হামলা হয়েছে সরকারী স্থাপনা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবহন, কৃষি, পর্যটন, চামড়া ও পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের তথ্যানুসারে, দেশে এক দিনের হরতাল বা অবরোধে গড়ে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এ হিসাবে ৬০ দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। সংগঠনের তথ্যানুসারে, পোশাক খাতে ২৭ হাজার কোটি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১৯ হাজার কোটি, খুচরা ও পাইকারি বিক্রিতে ২৫ হাজার কোটি, আবাসন খাতে ১৫ হাজার ৭৫০ কোটি, কৃষি ও পোল্ট্রি খাতে ১৮ হাজার ১২৫ কোটি, পর্যটন খাতে ১০ হাজার কোটি ও উৎপাদনশীল শিল্প খাতে ৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, টানা অবরোধ ও হরতালে বড় অংকের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরও শক্ত অবস্থানেই রয়েছে দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতির প্রায় সব সূচক এখনও ইতিবাচক। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই গত সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গিয়ে ঠেকেছে ২৩ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণের এই রিজার্ভ বর্তমানে পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রায় ১ হাজার কোটি ডলারের রেমিটেন্স এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭০ কোটি ডলার বেশি। এ সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৮ শতাংশ, যা চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সৌদি, কাতারসহ আরও দুই-একটি দেশের জনশক্তির দুয়ার খুলে গেলে এই প্রবাসী আয় আরও কয়েকগুণ বাড়বে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। হরতাল-অবরোধের ধাক্কায় রফতানি আয় কমেনি, বরং বেড়েছে। গেলো আট মাসে রফতানি আয় এসেছে ২০.৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২.৫৬ শতাংশ বেশি। বাড়ছে আমদানি ব্যয়ও। ছয় মাসেই এই ব্যয় গিয়ে ঠেকেছে ২০ বিলিয়ন ডলার, যা গেল অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি। গত এক বছরে এলসি খোলা ও এলসি দায় মেটানো দুই-ই বেড়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো আরও গতিশীল হতে পারত। তারপরও হরতাল-অবরোধে বর্তমানে অস্থির সময়েও দেশের অর্থনীতি এখনও চাঙ্গা রয়েছে। গত দুই মাসে হরতাল-অবরোধের প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরা একাধিকবার রাজপথে নেমেছেন। ধিক্কার জানিয়েছেন অর্থনীতি বিধ্বংসী এই কর্মসূচীর বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক দলগুলোকে কয়েক দফায় স্মারকলিপি দিয়েছেন সব স্তরের ব্যবসায়ীরা। হরতাল-অবরোধ বন্ধের জন্য হুমকিও দিয়েছেন কোন কোন ব্যবসায়ী সংগঠন। তারপরও কোন সমাধানের পথ দেখেননি ব্যবসায়ী সমাজ। তাই বাধ্য হয়েই সবকিছু স্বাভাবিক করে নিয়েছেন তাঁরা। রাজধানীতে এখন হরতাল-অবরোধের ছিটেফোটাও নেই। সব যানবাহনের ঠিকানাই এখন রাজপথে। দিনভর দীর্ঘ জ্যামে রীতিমতো নাকাল নগরবাসী। খেটেখাওয়া নিম্নআয়ের মানুষগুলোও আর বসে নেই। ছুটছেন কাজের সন্ধানে। গ্রাম কিংবা শহর সর্বত্রই কর্মচাঞ্চল্যতা দেখা যাচ্ছে। রাজধানীতে শুধু সড়ক পথেই নয়, নৌপথেও আসছে বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত পণ্য। বৃহস্পতিবার কারওয়ানবাজারে গিয়ে দেখা যায়, সবজিবাহী ট্রাক থেকে মাল নামানো হচ্ছে। বেশ কয়েকটি ট্রাকের কারণে সুরু হয়ে গেছে বাজারের প্রবেশ পথ। ট্রাকচালক শফিকুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি একটি মিনিট্রাকে নানা ধরনের সবজি ভরে কুষ্টিয়া থেকে রওনা দেন। গত মাসে বেশ কয়েকবার অবরোধকারীদের হামলার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেননি তিনি। কারওয়ানবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিদিন কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী এসব এলাকা থেকে সবজি আসছে। চালভর্তি ট্রাক নিয়ে কাউছার মিয়া ঈশ্বরদী থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে এসেছিলেন রাজধানীতে। দুপুরে তাঁর সঙ্গে কথা হয় কারওয়ানবাজার ট্রাক স্ট্যান্ডে। তিনি জানান, হরতাল-অবরোধের প্রথম কয়েক দিন ট্রাক চালাতে সাহস পাইনি। কয়দিন আর বসে থাকব। তাই বাধ্য হয়েই কাজে নেমেছি। ঈশ্বরদী থেকে আসতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি বলে তিনি জানান। পথে পথে পুলিশী প্রহরা ছিল বলে তিনি জানান। ওই স্ট্যান্ডে কথা হয় আরও একজন ট্রাকচালকের সঙ্গে। আমিরুল ইসলাম নামের ওই ট্রাকচালকের হেলপার জানুয়ারি মাসে পেট্রোলবোমায় আহত হলেও তিনি বেঁচেছিলেন বলে জানান। জনকণ্ঠকে বলেন, হরতালের মধ্যেও ট্রাক চালাতে হয়েছে। পরিবারের খরচ যোগাতে এছাড়া আর কোন উপায় নেই। বসে থাকলে তো কেউ এসে খাবার দেবে না বলে প্রশ্ন রাখেন আমিরুল। শুধু শহরে নয়, গ্রামেও থেমে নেই কর্মযজ্ঞ। পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ায় কৃষিজাত পণ্য সরবরাহ বাড়ছে। পরিবহন ভাড়া বেশি হলেও ক্ষেতের ফসল নিজেই পাঠাচ্ছেন কৃষক। আগের তুলনায় ফুটপাথের ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা কিছুটা বেড়েছে। বায়তুল মোকাররমের সামনের ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমাজাদ আলী জনকণ্ঠকে জানান, হরতাল-অবরোধে একদিনও দোকান বন্ধ রাখিনি। কিন্তু কোন কোন দিন একেবারেই বিক্রি হয়নি। পুঁজি ভেঙ্গে খেতে হয়েছে। আমরা প্রায় শেষ হয়ে গেছি। তবে এখন বিক্রি বাড়লেও সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠাতে পারছি না। ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম জানান, দোকান বন্ধ রাখলেও ভাড়া দিতে হবে, খোলা রাখলেও দিতে হবে। তারপর আছে কর্মচারীর বেতন। সবকিছু মিলিয়ে যে খরচ তার এতটুকু অংশও বিক্রি করতে পারিনি। এই হরতাল-অবরোধের মধ্যেই ঋণ করে দোকান ভাড়া দিয়েছি। কথা হয় ঢাকা মহানগর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি তৌফিক এহসানের সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, হরতাল-অবরোধে উৎপাদন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শিল্প প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন খরচ, কর্মীদের বেতন-ভাতা, ব্যাংক ঋণের সুদ দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, এই হরতাল-অবরোধ দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। সব কিছুই এখন স্বাভাবিক। ব্যবসায়ীরা হরতাল-অবরোধ মানেন না। কেননা হরতালে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন, হরতালের বিরুদ্ধে কঠোর আইন তৈরির কথা আমরা সরকারকে বলেছি, এখনও বলছি। রাজনীতির আগুনে পুড়ে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে পোশাকশিল্পের, যার কারণে বাতিল হয়েছে একের পর এক রফতানি আদেশ। সম্প্রতি পোশাকশিল্পের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে ২১টি দাবি উত্থাপন করেছেন রফতানিকারকরা। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, অবরোধের কারণে তাদের প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। যদি উৎপাদন হরতাল-অবরোধের কারণে ৫০ শতাংশও বিঘিœত হয়, তাহলে প্রতিদিন উৎপাদন ব্যাহত হয় অন্তত ২১৫ কোটি টাকার। এই ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরে আমরা সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছি। সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, চলমান হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির তিন ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, তাৎক্ষণিক ক্ষতির মধ্যে শিল্পের উৎপাদন, কৃষিপণ্য সরবরাহ বাড়ছে। মধ্যমেয়াদী ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হবে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। আর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মধ্যে সরকারের যেসব বড় প্রকল্প রয়েছে সেগুলো কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনা করে বলা যায়, এই হরতাল-অবরোধ জিডিপির প্রবৃদ্ধি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। এ কারণে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে এমন কোন কর্মসূচী রাজনৈতিক দলগুলো যেন না দেয়।
×