ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লাঙ্গল বিদায় নিচ্ছে- চাষে কৃষকের হাতিয়ার যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৬ মার্চ ২০১৫

লাঙ্গল বিদায় নিচ্ছে- চাষে কৃষকের হাতিয়ার যন্ত্র

এমদাদুল হক তুহিন ॥ কৃষি শ্রমিকের ক্রমাগত অকৃষি খাতে স্থানান্তরের কারণে দিন দিন কৃষি খাতে শ্রমিকের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। প্রথাগত কারণেই এ খাত এখনও শ্রম নির্ভর। তবে সমাজের আদি এই পেশা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যান্ত্রিকীকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণকে আরও সহজতর করতে সরকারের পক্ষ থেকেও নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। ২০১০ সাল থেকে কৃষককে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে নির্দিষ্ট কিছু জেলায় ২৫ শতাংশ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছিল। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব একনেক সভায় অনুমোদন লাভের পর ভর্তুকির পরিবর্তে উন্নয়ন সহায়তা ৩০ শতাংশে উন্নিত হলো। এখন থেকে ২৫ জেলার পরিবর্তে বাংলাদেশের সব জেলার ও উপজেলার কৃষকেরা যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা পাবেন। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কয়েকটি ধাপের মধ্যে দেশে যন্ত্রের ব্যবহার চাষে ৯০ শতাংশ, মাড়াই ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যন্ত্রের সঙ্গে অপরিচিত জেলাগুলোর কৃষককে যন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চলছে নানা কার্যক্রম। স্থানীয় কৃষি অফিসের মাধ্যমে আবেদন করে যে কোন কৃষক ৩০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে কৃষিযন্ত্রপাতি ক্রয় করতে পারবেন। সরকার গৃহীত নতুন এই প্রকল্পের অধীনে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, হ্যান্ডরিপার, পাওয়ার থ্রেসার, মেইজ শেলার, কম্বাইন হারভেস্টার, স্প্রেয়ার ও গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্রে কৃষকরা কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৩০ শতাংশ কমে যন্ত্রগুলো বাজার থেকে ক্রয় করা যাবে। দেশের সব এলাকা এখন চাষাবাদের ক্ষেত্রে পুরোটাই যন্ত্রনির্ভর। লাঙ্গল কাঁধে মাঠে কৃষককে আর তেমন একটা দেখা যায় না। দেশের কৃষি পুরোপুরি যান্ত্রিকীকরণের দিকে ধাবিত হতে না পারলেও দেশের আদি এই খাত যান্ত্রিকীকরণের দিকে পুরোদমে এগিয়ে চলছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চাষের ক্ষেত্রে দেশের প্রতিটি কৃষক এখন যন্ত্র ব্যবহার করছেন। এ ক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে ফসল মাড়াইয়ের ক্ষেত্রে মোট কৃষকের ৭০ শতাংশ যন্ত্র ব্যবহার করেন। যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিটি এলাকার চিত্র ভিন্ন ভিন্ন হলেও এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, বগুড়া ও ময়মনসিংহসহ কয়েকটি জেলা। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি খাতে দিনদিন শ্রমিকের সংখ্য হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের আদিপেশা কৃষি হলেও কৃষকের সন্তান হয়েও কেউ আর ওই পেশায় ফিরে যেতে চায় না। কৃষি খাতে কৃষি শ্রমিকের স্বল্পতার কারণেই এক সময় বাংলাদেশের কৃষি খাত পুরো যান্ত্রিকীকরণ হবে। দীর্ঘমেয়াদী সময়ে তা সম্ভব-দাবি করেন একাধিক কৃষিবীদ। জানা যায়, কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে সরকার ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি-১ম পর্যায়’ প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পটি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম পর্যায়ে ২৫ জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। পরবর্তীতে আরও ১০ জেলা বৃদ্ধি করে মোট ৩৫ জেলায় নানা ধরনের কৃষি যন্ত্রপতি ক্রয়ে কৃষকদের ২৫ শতাংশ ভর্তুকি প্রদান করা হয়। ওই প্রকল্পের অধীনে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, হ্যান্ডরিপার, পাওয়ার থ্রেসার, মেইজ শেলার, কম্বাইন হারভেস্টার, স্প্রেয়ার ও গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্রে কৃষকরা কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ২৫ শতাংশ কমে ওই যন্ত্রগুলো বাজার থেকে ক্রয় করতে পারত। একাধিক ব্যক্তিবর্গরা ওই প্রকল্পের শতভাগ সফলতা দাবি করেন। ফলে নতুন করে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সরকার নতুন করে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প গ্রহণ করে। আর নতুন এই প্রকল্পের মাধ্যমেই কৃষকদের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা দেয়া হবে। যা আজ থেকে কার্যক্রম হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি-২য় পর্যায় প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার কৃষকদের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩০ শতাংশ ভর্তুকি দেবে। ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে। একনেক সভায় অনুমোদন পাওয়া ওই প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত প্রস্তাবে দেশের মোট ৬৪ জেলার সব উপজেলার জন্যে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪৮১৭.৬৪ লাখ টাকা। এই প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ভর্তুকিকে উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। ভর্তুকি শব্দটি বর্হিবিশ্বে অনেকটা নেতিবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে শব্দটির পরিবর্তন করা হয়েছে বলে জানা যায়। সূত্র আরও জানায়, ২য় পর্যায়ের এই প্রকল্পে আগ্রহী কৃষকদের ৩০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ৩৮২০০ খামারে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে। কৃষি যন্ত্রপাতির সঙ্গে কৃষকদের পরিচিত করাতে ১৪০০০ স্থানের বিভিন্ন খামারে যন্ত্রপাতি প্রদর্শন করা হবে। এই প্রকল্পের অধীনে দেশের সব কৃষি অঞ্চলকে সমভাবে বিন্যস্ত করে ২০ যান্ত্রিক খামার প্রদর্শন করা হবে। জানা যায়, প্রকল্পের অধীনে ১৮০০ গ্রামীণ মেকানিকদের কারিগরি প্রশিক্ষণ, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র ব্যবহারকারী প্রায় ৯০০০ জনকে প্রশিক্ষণ, ৩৭৫ জন টেকনিক্যাল কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে দেশের কৃষি খাতকে যান্ত্রিকীকরণের দিকে এগিয়ে নেয়া হবে। প্রকল্পের অধীনে ১টি জাতীয় ও ১৫টি অঞ্চলিক কর্মশালার আয়োজন করাসহ প্রকল্প চলাকালীন সময়ে একটি কৃষি যন্ত্রপাতি শুমারি সম্পাদন করা হবে। তাছাড়াও যন্ত্রপাতির গুণগতমান পরীক্ষার জন্য ১টি টেস্টিং ল্যাবরেটরি নির্মাণ করা হবে বলে জানা গেছে। খুব দ্রুত প্রতিটি উপজেলার কৃষকেরা সরকারী এই সেবাটি পেতে যাচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণ দ্রুততর করতে সরকার প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন করে প্রকল্প গ্রহণে উদ্যোগী হয়। কৃষকদের যাতে কেউ কোন অবহেলা করতে না পারে তাই নতুন এই প্রকল্প থেকে ভর্তুকি শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ভর্তুকির পরিবর্তে উন্নয়ন সহায়তা হিসাবে কৃষকদের ৩০ শতাংশ অর্থ ছাড় দেয়া হবে। তবে এর জন্যে কৃষককে নিজ নিজ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করতে হবে। উপজেলায় বরাদ্দকৃত কোটা থেকে কৃষকরা এই সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন। জানা গেছে- কর্ণফুলী লিমিটেড, চিটাগাং বিল্ডার্স এ্যান্ড মেশিনারিজ লি. ও এসিআই মেটাল প্রাইভেট লিমিটেডসহ মোট ১৮ কোম্পানির নির্দিষ্ট কিছু যন্ত্রপতি ক্রয়ে কৃষক এই সুবিধা পাবেন। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি দেয়ায় কৃষকরা নানভাবে উপকৃত হচ্ছেন। ফলে সহজেই তারা যন্ত্রপাতি ক্রয়ে মনোনিবেশ করছেন। যশোরে বাঘারপাড়া উপজেলার ৮০ বছর বয়ষ্ক কৃষক কার্তিক দেবনাথ ২০১০ সালে সরকারের দেয়া ২৫ শতাংশ ভর্তুকিতে একটি ট্রাকটর ক্রয় করেছিলেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ২৫ শতাংশ ভর্তুকিতে ট্রাকটর ক্রয় করে খুব উপকৃত হয়েছিলাম। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কৃষক ফরহাদ শেখ সরকারের দেয়া একই সুবিধা গ্রহণকারী। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, দিন দিন শ্রমিক কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে আমাদের যন্ত্রের দিকে যেতে হচ্ছে। যন্ত্রে সময় কম লাগে, দ্রুত সময়ে বেশি কাজ করা যায়। আর এই কাজে সরকারের সহযোগিতা খুবই প্রশসংসার দাবিদার। কৃষি যন্ত্রপাতি বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী সুরজিৎ সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের মাঝে ভর্তুকিতে কৃষি যন্ত্র বিতরণ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে ভর্তুকির আওয়াতায় কৃষি যন্ত্র সরবরাহের জন্যে সহজে ব্যাংক লোনসহ ভর্তুকির পরিমাণ ৫০ শতাংশে উন্নিত করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
×