ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিপন্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৬ মার্চ ২০১৫

বিপন্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার চারদিনের ভেতর প্রধান প্ররোচক শাফিউর রহমান ফারাবীকে গ্রেফতার করা হলেও মাঠ পর্যায়ের ঘাতকরা এখনও ধরা পড়েনি। একইভাবে ফারাবীর গডফাদারদের সম্পর্কেও কেউ উচ্চবাচ্য করছেন না। এগারো বছর আগে প্রথাবিরোধী বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদকে একই কারণে যারা হত্যা চেষ্টা করেছিল তাদের অধিকাংশ আজ অবধি অধরা থেকে গেছে। ষোলো বছর আগে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র এক সময়ের সভাপতি, বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানকে একই কারণে যারা হত্যা করতে গিয়েছিল এবং যারা হত্যার পরিকল্পনা করেছিল ১৯৯৯ সালে তাদের গ্রেফতার করা হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে তাদের ছেড়ে দিয়েছে। অভিজিৎকে যেভাবে ছুরি চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে হুমায়ুন আজাদকে প্রায় একই জায়গায় একইভাবে হত্যার জন্য হামলা করা হয়েছিল। হুমায়ুন আজাদ এই হামলার জন্য জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে হুকুমের আসামি করলেও অভিযোগপত্রে তার নাম নেই। অভিজিৎ মার্কিন নাগরিক হওয়ার কারণে তার হত্যাকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, জামায়াত-শিবিরের মৌলবাদীরা একই কারণে অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস ও অধ্যাপক তাহের আহমেদসহ মুক্তচিন্তার অনুসারী বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করলেও আমেরিকা এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তালিকা প্রস্তুত করে হাজার হাজার প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীকে হত্যাসহ গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার পরও আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা জামায়াতে ইসলামীকে ‘মডারেট ইসলামী দল’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পছন্দ করে। আমরা যতই বলি না কেন জামায়াত যাবতীয় জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের জন্মদাতা, ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’, ‘আল কায়েদা’, ‘আইএস’-এর জ্ঞাতি ভাই- আমেরিকার এতদসংক্রান্ত নীতিনির্ধারকরা তা মানতে নারাজ। অভিজিৎ হত্যার কারণ হিসেবে যখন ঘাতকরা ফেসবুকে বলল, মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক তাদের দু’জন জঙ্গী সহযোদ্ধাকে হত্যার বদলাÑ তখন আমেরিকার টনক নড়েছে। এফবিআইকে পাঠানো হচ্ছে অভিজিৎ হত্যার তদন্তে সাহায্য করার জন্য। এফবিআইর দক্ষতা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। তবে স্টেট ডিপার্টমেন্ট যতদিন জামায়াতকে মডারেট ইসলামী দল বিবেচনা করবে ততদিনে এফবিআইয়ের পক্ষে অভিজিৎ হত্যার মূল নায়কদের যে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে নাÑ একথা তদন্তে নামার আগেই আমরা বলতে পারি। বর্তমান যুগে ধর্মের নামে রাজনীতি এবং হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্ম দিয়েছে ‘ওহাবিবাদ’; এই উপমহাদেশে যার অভিব্যক্তি হচ্ছে ‘মওদুদিবাদ’। ‘ওহাবিবাদ’ বা ‘মওদুদিবাদ’ কোন ভিন্নমত সহ্য করে নাÑ তা নাস্তিক হোক, কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী আস্তিক হোক, কিংবা স্বধর্মী মুসলমান হোক। স্বধর্মীদের ভেতর শিয়া, সুন্নি, আহমদী বিরোধ বাদ দিলেও সুন্নি হানাফী তরিকার অনুসারী জামায়াত কি ’৭১-এ ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে একই তরিকার মুসলমানদের হত্যা করেনি? ‘ওহাবিবাদ’ ও ‘মওদুদিবাদ’-এর কারণে পশ্চিমা জগতে অনেকের কাছে ইসলাম আজ সন্ত্রাসের সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। অভিজিৎ হত্যার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত ফারাবীর সন্ত্রাসী ব্লগ সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে লেখা হচ্ছে। গত ২ মার্চ (২০১৫) দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত ‘অভিজিতের খুনীরা ফেসবুকে সরব’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ খুনীরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা-লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার পরিকল্পনা এক মাস আগেই করেছিল। এমনকি তাঁকে এক বছরের বেশি সময় ধরে ফেসবুকের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল। আর এই খুনের অন্যতম নায়ক ইসলামপন্থী নামধারী উগ্র মতাদর্শের দুই ব্লগার। এদের একজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রেদোয়ানুল ইসলাম রানা ও অপরজন নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিজবুত তাহরীর নেতা ফারাবী সাইফুর রহমান। ... খুনী চক্রের অন্যতম ফারাবী সাইফুর রহমানের ফেসবুক স্ট্যাটাসে অভিজিৎকে হত্যার প্রত্যক্ষ হুমকি দেয়ার প্রমাণ রয়েছে। এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ যুগান্তরের হাতে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎকে হত্যার পর অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ফারাবীর ফেসবুকে অভিজিতের রক্তাক্ত লাশের একটি ছবি পোস্ট করে জানতে চান, ‘ছবি পাইছেন কি? কি রকম অনুভূতি হচ্ছে আপনার? জবাবে ফারাবী বলেন, হ্যাঁ (ছবি পেয়েছি)। আমি গ্রেফতার হব কাল-পরশুর মাঝে।’ এর আগে গত বছর ২৭ জানুয়ারি ফারাবীর ফেসবুকে মোজাম্মেল হক নামে এক ব্লগার লেখেন, অভিজিৎ রায়, উমর ফারুক লুক্স, দাঁড়িপাল্লা দমাদম, সাদিয়া সুমি উজ্জা, সুব্রত শুভ, মোশারফ হোসেন সৈকত ও দিগম্বর পয়গম্বরকে হত্যা করা সময়ের দাবি...। ৩১ জানুয়ারি ফারাবীর ফেসবুকে আরেক সন্দেহভাজন ব্লগার আসাদুজ্জামান লেখেন, ‘অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা বাংলার মুসলমানদের জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ ২৫ জানুয়ারি দুপুর ১২টা ৪৯ মিনিটে উগ্রপন্থী ব্লগার সাহাবুদ্দীন ইলিয়াস নিজের ফেসবুক পোস্টে বলেন, মুক্তমনা ওয়েবসাইটের প্রতিটি নাস্তিক ব্লগারকে পাথর মেরে হত্যা করা বাংলার মুসলমানদের জন্য ফরজ।...’ রাত ৯টা ১১ মিনিটে মাসুম খান নিলয় নামের সন্দেহভাজন আরেক ব্লগার লেখেন, ‘আমাদের ইমানী কাজ হচ্ছে, তাকে (অভিজিৎ) সহ সব নাস্তিককে হত্যা করা।’ রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে ব্লগার ইকবাল বিন আহমেদ লেখেন, ‘অভিজিতের বাপেরে (অজয় রায়) আগে মারতে হবে।...’ ১০টা ৪৬ মিনিটে রুহিন আহমেদ নামের এক ব্লগার লেখে, ‘... বাচ্চাকে খুন করতে হবে।’ রাজভীর হোসাইন বিন সাখাওয়াত নামের উগ্রপন্থী এক ব্লগার লেখেন, ‘ওই ওয়েবসাইটের (অভিজিতের মুক্তমনা ওয়েবসাইট) অ্যাডমিনের খোঁজ লাগান। কই থাকে আর মোবাইল নাম্বারেরও খোঁজ নেন। টাকা দরকার হলে আমি দিব।’ ফারাবী ও তার জঙ্গী সহযোগীদের এহেন কর্মকা-ের প্রতিবাদ অভিজিৎ তার ব্লগে বহুবার করেছেন। এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় অভিজিৎ লিখেছেনÑ ‘ফারাবীর মতো ‘বিশ্বাসের ভাইরাস আক্রান্ত’ মননেরা মনেই করে যে, লেখকরা ধর্মকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেন, এ নিয়ে যুক্তিবাদী লেখা লেখেন, তাদের ধরে ধরে হত্যা করা জায়েজ। ফেসবুকে ফারাবীর খুব সহজ স্বীকারোক্তিÑ ‘ইসলাম অর্থ শান্তি নয়, ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ। ইসলামের ভিতরে জিহাদ, ক্বিতাল সবই আছে। আল্লাহর রসুলকে যারা ঠা-া মাথায় গালিগালাজ করবে, আমরা তাদের হত্যা করব, এতে লুকোচুরির কিছু নেই।’ ফারাবী তার ফেসবুকে শুধু যে অভিজিৎ বা অভিজিতের মতো যুক্তিবাদী লেখকদের বিরুদ্ধে লিখেছে তা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কী কদর্য ভাষায় ফারাবী সেনাবাহিনীকে প্ররোচিত করেছে সে বিষয়েও মন্তব্য করেছেন অভিজিৎ। ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’-এর ভূমিকায় অভিজিৎ লিখেছেনÑ ‘কিছুদিন আগে সেনাবাহিনী এবং পুলিশকে উস্কানি দিয়েছিল ‘দেশের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে’ অস্ত্র তুলে নিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ড্রাকুলা মানবী’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশে ‘আরেকটি রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট’ ঘটানোর উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিল এই উগ্রপন্থী ব্যক্তিটি। ‘এ ধরনের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।’ এ ধরনের বক্তব্য দিয়েও ফারাবী কিভাবে আইনের উর্ধে থাকে সেটা রীতিমতো বিস্ময়কর। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এক কলামে ফারাবীর ব্যাপারে এমনকি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকেও দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। অথচ দেশের আইনরক্ষকরা এ ব্যাপারে ছিলেন বরাবরই নির্বিকার। ‘তাদের নির্বিকার থাকার একটি কারণ হয়ত এই যে, ফারাবীর মৃত্যু হুমকিকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। ফারাবী প্রতিদিনই ফেসবুকে কাউকে না কাউকে মৃত্যু হুমকি দিয়ে বেড়াত। ফারাবীর মৃত্যু হুমকির ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে ফেসবুকের প্রায় সকল মননশীল লেখক-সাহিত্যিক এতদিনে পরপারে সুখনিদ্রা যাপন করতেন। সত্যি বলতে কি, ফারাবীর মতো লুম্পেনের দেয়া মৃত্যু ফতোয়া আমরা কেউই ‘সিরিয়াসলি’ নেইনি।’ অভিজিৎ যে এ ধরনের হুমকির পরোয়া করতেন না তার হত্যাকা- তা প্রমাণ করেছে। বছরের পর বছর ফারাবীর ফেসবুকে এ ধরনের উন্মাদনা প্রকাশের পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ কী কারণে উদাসীন ছিল এর জবাব তাদের দিতে হবে। ফারাবীর ব্লগ বন্ধ না করলেও কর্তৃপক্ষ অভিজিতের ‘মুক্তমনা’ বন্ধ করে কি তাকে বাঁচাতে পেরেছে? ফারাবীদের গডফাদার হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামী মুক্তমনাদের আক্রমণের লক্ষ্য করেছে বহুকাল আগে। অভিজিৎ হত্যার পক্ষে সাফাই গেয়েছে হেফাজত। তাদের বিবৃতিতে বলেছেÑ ‘অভিজিত দেশের ইসলামবিরোধী তৎপরতার সূতিকাগার মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। তথাকথিত মুক্তচিন্তার নামে লাগামহীনভাবে ইসলাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)-এর নামে কটূক্তি ও অবমাননা করাই ছিল ব্লগটির মূল উদ্দেশ্য। ২০০৭ সালে ইসলামবিদ্বেষী কার্যকলাপের পুরস্কারস্বরূপ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক-২০০৭’ মুক্তমনা ব্লগকে দেয়া হয়। সুতরাং মুক্তমনা ব্লগটি যে দেশের একটি ইসলামবিদ্বেষী দুষ্টচক্র ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’ (দৈনিক সংগ্রাম, ২ মার্চ ২০১৫) ৩০ লাখ শহীদের রক্তের মূল্যে অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে যতদিন জামায়াত হেফাজত গং বেলাগাম বিচরণ করবেÑ ততদিন আন্দোলনের নামে জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারা, অভিজিতের মতো যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবীদের কুপিয়ে মারা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পিটিয়ে মারা কিংবা ২১ আগস্টের মতো গ্রেনেড-বোমা হামলার মতো নৃশংস মানবতাবিরোধী অপরাধের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা যাবে না। অভিজিৎ হত্যার পরদিন ফারাবী তার ফেসবুকে আমার একটি ছবি লাল বৃত্তে চিহ্নিত করে আমাকে চিনে রাখতে বলেছে। ওদের হাতে ছুরি-চাপাতি, পেট্রোলবোমা, গ্রেনেড, এ কে ফরটি সেভেন সবই আছে। আমাদের হাতে কলম ছাড়া কিছুই নেই। ওরা প্রতিনিয়ত হামলা করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর, বিজ্ঞান, মানবতা ও সভ্যতার ওপর। শামসুর রাহমান বা হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলাকারীরা যেভাবে পার পেয়েছে, অভিজিতের ঘাতকদের এবং তাদের গডফাদারদের যদি একইভাবে রেহাই দেয়া হয় ভবিষ্যতে তারা শুধু আমার মতো নগণ্য লেখকদের নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ছাড়বে না। ৪ মার্চ ২০১
×