ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিরাপত্তাহীনতায় ঢাবি ক্যাম্পাস, অপরাজেয় বাংলায় ককটেল

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৫ মার্চ ২০১৫

নিরাপত্তাহীনতায় ঢাবি ক্যাম্পাস, অপরাজেয় বাংলায় ককটেল

মুহাম্মদ ইব্রাহীম সুজন ॥ সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বিজ্ঞান লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এ সব কিছুর পরেও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিনিয়ত ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেই চলেছে। সর্বশেষ বুধবার বেলা ১১টার সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক ‘অপরাজেয় বাংলা’র ভাস্কর্য ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় কলাভবনের পাঁচ তলা থেকে ককটেলটি নিক্ষেপ করা হয়। প্রচ- শব্দে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে ভাস্কর্যটির কিছুটা জৌলুস নষ্ট হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনার পর আমরা ঘটনাস্থল গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। কিন্তু কাউকে আটক করা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা রক্ষায় সামর্থ্য অনুযায়ী তিনি চেষ্টা করছেন বলেও জানান তিনি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে এমন যুক্তি দেখিয়ে গত ২রা মার্চ টিএসসির অস্থায়ী চা, চানাচুর, মুড়ি ইত্যাদির সব দোকান-পাট বন্ধ করে দেয় ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অভিজিৎ হত্যাকা-ের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫০টির বেশি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটেছে। অবিস্ফোরিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে তিনটি। টিএসসির দোকান-পাট বন্ধ করে, ছাত্রনেতারা, পুলিশ, সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতেই ককটেল বিস্ফোরণ ঘটছে, তাহলে এ ধরনের পদক্ষেপ কতোটা কার্যকর? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রক্টর বলেন, চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়নি, সাময়িকভাবে করা হয়েছে। এত বড় ক্যাম্পাস, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও তো রয়েছে। এদিকে অপরাজেয় বাংলায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে কোন মূল্যে জোরদার ও স্বাভাবিক, শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সুফল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতার চেতনার ভাস্কর্যে বোমা মেরে ক্ষতিগ্রস্ত করে হামলাকারীরা পালিয়ে গেল, এটা আমাদের জন্য লজ্জার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এ ভাস্কর্য রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। সবকিছু বন্ধ করে দেয়ার অর্থই হচ্ছে প্রতিক্রিয়শীলদের কাছে পরাজয় মেনে নেয়া। নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ছাত্রলীগ এ অযৌক্তিক ও হাস্যকর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যর্থদের পরিবর্তে যারা এটি পারবেন তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতৃবৃন্দকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে সংগঠনের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ জনকণ্ঠকে জানান, ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সক্রিয় থাকে। আমরা ইতোমধ্যে কয়েকজন ককটেল নিক্ষেপকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছি। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সবাইকে আরও সচেতন হয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। জানতে চেয়ে সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মেহেদী হাসান ও সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ফোন ধরেননি। ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখার সভাপতি মারুফ বিল্লাহ তন্ময় এ ঘটনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম ব্যর্থতা উল্লেখ করে প্রক্টরের পদত্যাগের দাবি জানান। তিনি বলেন, প্রক্টর ব্যর্থ হলে যোগ্য কাউকে দায়িত্ব দেয়া হোক। এভাবে অপরাজেয় বাংলার ওপর হামলা আমরা মেনে নিতে পারি না। পাশাপাশি টিএসসির দোকান-পাট বন্ধ করে টিএসসির সাংস্কৃতিক পরিম-লকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কোন মানে নেই। দেশের স্বাধীনতার বিশ্বাস ও চেতনার ওপরে হামলা নতুন কিছু নয় উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য ধর্মান্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীলরা আবার অপতৎপরতা শুরু করেছে। গণতন্ত্র রক্ষা ও রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে এরা মানুষকে পুড়িয়ে মারছে। একটা ভাস্কর্যের ওপর বোমা মারা কতটা গর্হিত কাজ তা এরা জানে না। এ অপশক্তিকে রুখে দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সব শক্তিকে একত্রিত হয়ে প্রতিহত করতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমাদের সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা যেমন ঐক্যবদ্ধ, আমাদেরকেও ঐক্যবদ্ধভাবে তাদেরকে এদেশের মাটি থেকে নির্মূল করতে হবে। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিরোধ, মুক্তি ও সাফল্যকে ধারণ করে। এর অল্প দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা, যার ধূলো-মাটিতে গেঁথে আছে বাঙালী জাতির অজেয় ইতিহাস। একাত্তরে এখানেই প্রথম উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। কলাভবনের সামনের আইল্যান্ডের ওপর তৈরি হওয়া ত্রিকোণ বেদী-মাটি থেকে ১৮ ফুট উঁচু, বেদীর ওপর ১২ ফুট উঁচু তিনটি ফিগারের দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো এ ভাস্কর্যটির ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। ১৯৭৩ সালে নির্মাণকাজ শুরু হলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর মৌলবাদীদের বিরোধিতার কারণে বারবার এর নির্মাণ কাজে বাধা আসে। ১৯৭৭ সালে প্রতিক্রিয়াশীলরা জিপিওর সামনে থেকে একটি ভাস্কর্য অপসারিত করে। তাদের দ্বিতীয় শিকার হয়েছিল এ ভাস্কর্য। ১৯৭৭ সালের ২৮ আগস্ট তারাই ভাস্কর্যটি নির্মূল করার উদ্যোগ নেয়। স্বাভাবিক ও সঙ্গত কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা তা প্রতিহত করে। অনিবার্য এক সংঘর্ষে ৩০ জন ছাত্র আহত হয়, চারজন গ্রেফতার হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে ছাত্রসমাজ, দাবি ওঠে অসম্পূর্ণ ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ করার। বিভিন্ন সময়ে কাজ বন্ধ থাকায় অপরাজেয় বাংলার নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে উদ্বোধন হয় ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এরপর দীর্ঘ ২৫ বছরে দেশের সার্বিক ক্ষেত্রে ঘটেছে পালাবদল, এ ভাস্বর্যের ওপরও তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া পড়েছে। মৌলবাদীরা বারবার এ ভাস্কর্যকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল।
×