ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দশ কারণে ঘন ঘন নৌ দুর্ঘটনা- কোন প্রতিকার নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৫ মার্চ ২০১৫

দশ কারণে ঘন ঘন নৌ দুর্ঘটনা- কোন প্রতিকার নেই

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ যে কোন দুর্ঘটনার সংবাদ মানুষকে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ফেলে দেয়। আর সে দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষের মৃত্যু হলে তা শুধু ব্যথিত করে না ক্ষেত্র বিশেষে দায়-দায়িত্ব অবহেলার কারণে ক্ষোভের মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়। স্বজনহারাদের আহাজারি পরিবেশকে করে তোলে ভারি। জীবিকা অর্জনকারীদের অকাল মৃত্যুতে অনেক পরিবারের জীবন তলিয়ে যায় অনিশ্চয়তার অতল গহ্বরে। দেশে বিভিন্ন রুটে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়ে আছে। বিশেষ করে নৌ-রুটে ঘন ঘন দুর্ঘটনায় অকাতরে মানুষের মৃত্যু পুরো দেশকে শঙ্কায় ফেলেছে। নৌরুটে সর্বশেষ লঞ্চডুবির ঘটনায় ৮০ জনের প্রাণহানির ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে এ সংক্রান্ত সেক্টরে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পদ্মা নদীর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার মাঝামাঝি স্থানে সারবাহী একটি কার্গোর ধাক্কায় দু’শতাধিক যাত্রী বোঝাই এমপি মোস্তফা নামের একটি লঞ্চ নদীগর্ভে ডুবে গিয়ে এসব মানুষের সলিল সমাধি ঘটে। নারী, শিশু ও পুরুষের সলিল সমাধির ঘটনা বিবেকবান মানুষকে কাঁদিয়েছে। কিন্তু এ সেক্টর নিয়ে যারা দায়িত্ব পালনরত তারা যেন কেবলই নির্বাক। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, নৌ-রুটে একের পর এক লঞ্চডুবিতে সাধারণ মানুষের অকাতরে সলিল সমাধি কি ঘটতেই থাকবে। এর কি কোন পরিত্রাণ হবে না। দৈব দুর্বিপাকে, ঝড় জলোচ্ছ্বাসে দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট দুর্ঘটনার পর এ নিয়ে হাজারো প্রশ্ন উঠে আসে। কিন্তু এর কোন সমাধান হয় না। প্রতিটি ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়, কমিটি রিপোর্টও প্রদান করে। কিন্তু এসব রিপোর্ট ও সুপারিশ কোন কার্যকরিতা বয়ে আনে না। সমুদ্র ও নৌ সেক্টরে নৌযান চলাচলে দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। তাদের অধীনে এ সেক্টর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ও নৌ বাণিজ্য অধিদফতর। পুরো দেশের হাজার হাজার সমুদ্রগামী জাহাজ ও ট্রলার এবং ইঞ্জিনচালিত বোটগুলোর ফিটনেস থেকে শুরু করে চলাচল যোগ্যতার সার্টিফিকেট এদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এসব দফতর এ কাজে বছরের পর বছর তাদের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যর্থতার চিত্র ও তদন্ত কমিটিগুলো উদঘাটন করছে। কিন্তু ফলাফল রয়ে যাচ্ছে শূন্যের কোটায়। নৌপরিবহন অধিদফতর সূত্রে প্রাপ্ত গ্রাফিক্স তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ১০ কারণে নৌ-রুটগুলোতে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে। দুর্ঘটনার পর তদন্তের মাধ্যমে নেপথ্য কারণগুলো বেরিয়ে আসছে। কিন্তু এসব কারণ নিয়ে সুরাহা না করে এবং যাদের মাধ্যমে দুর্ঘটনা রোধের উপায় খুঁজে বের করতে অভিজ্ঞদের নিয়োগ না দেয়ায় বারে বারে ষড়যন্ত্র হচ্ছে নতুন অর্গানোগ্রামে এরই প্রতিফলন ঘটছে। নৌবাণিজ্য অধিদফতর প্রণীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী নৌ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা যায় মাস্টারের গাফিলতি ও মাস্টারবিহীন চালনায় ৩০ শতাংশ, চরায় আটকে যাওয়া ও প্রবল স্রোতে ৮ শতাংশ, বিরূপ আবহাওয়ায় ১০ শতাংশ, সংঘর্ষে ১০ শতাংশ, ওভারলোডিংয়ে ২০ শতাংশ, বাধ্যতামূলক চরে উঠা ৫ শতাংশ, আগুনে ১ শতাংশ, নির্মাণজনিত ত্রুটিতে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদির অভাবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। সূত্র জানায়, এসব দুর্ঘটনা নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে নৌযান দুর্ঘটনা মুখ্য ভূমিকা রাখছে। সঙ্গত কারণে দুর্ঘটনা ঘটার পূর্বে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং যাদের দিকনির্দেশনায় সঠিক রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভে পাওয়ার কথা সে প্রফেশনাল লোকজন নিয়োগ বিধিতে উপেক্ষিত। একইভাবে নির্মাণজনিত ত্রুটি রোধে যেসব প্রফেশনাল সার্ভেয়ার হিসাবে সম্পৃক্ত হওয়ার কথা নিয়োগ বিধিতে তাদের সংখ্যাও নগণ্য। সূত্র জানায়, নৌ প্রশাসনের অন্য দফতরগুলোর চিত্র আরও করুণ। যা দেশের শিপিংয়ের জন্য একটি অশনিসঙ্কেতও বটে। নৌবাণিজ্য অধিদফতরের রেজিস্ট্রিকৃত (সমুদ্রগামী, কোস্টার, ফিশিং) ৫ সহস্রাধিক নৌযানের দেখভাল করেন মাত্র এক সার্ভেয়ার। এ করুণ চিত্রের কথা মন্ত্রণালয়সহ কারও কি অজানা। কিন্তু প্রশাসনের এ চরম অব্যবস্থা ও অনৈতিক কর্মকা- বহির্বিশ্বে দেশের শিপিং সেক্টরের কর্মকা-কে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। একইভাবে শিপিং অফিসের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির মূল কেন্দ্র সিডিসি (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) ও দক্ষতা সার্টিফিকেটে জালিয়াতির কারণে বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নাবিক চাহিদা কেবলই হ্রাস পাচ্ছে। সূত্র জানায়, নৌ নিরাপত্তর বিশাল বলয়ের পোস্টমর্টেম না করে বার বার দুর্ঘটনার পেছনে যে অপকর্মগুলো কাজ করছে তা হচ্ছে সম্পূর্ণ অনৈতিক উপায়ে নৌযানের রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস দেয়া। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ও এর অঙ্গ সংস্থাসমূহে মাত্র ৬ ইঞ্জিনিয়ার সার্ভেয়ার ও এক খ-কালীন নটিক্যাল সার্ভেয়ার আনুমানিক ১৬ হাজার নৌযানের রেজিস্ট্রেশন, সার্ভে, সুপারভিশন, ডকিংসার্ভে, ডিজাইন ইত্যাদির যে বিশাল কর্মযজ্ঞ সেখানেই আন্ডারহ্যান্ড লেনদেনের ঘটনাগুলো ঘটছে। এদের দুর্বৃত্তপনার শিকার ও অকালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে হাজার হাজার লঞ্চযাত্রী। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। প্রসঙ্গত, সাধারণ নৌযান হিসেবে রেজিস্ট্রিকৃত নৌযান পরবর্তীতে নক্সা রূপান্তরের মাধ্যমে একটি সিঙ্গেল হাল ও সিঙ্গেল বটম ট্যাঙ্কারে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এটি হচ্ছে দুর্ঘটনাকবলিত ওটি সাউদার্ন স্টার-৭। অনৈতিক এ প্রক্রিয়াটি কার মাধ্যমে সম্পাদিত হল তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরবর্তীতে অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ার সার্ভেয়াররা এর বার্ষিক ফিটনেস দিয়ে যান। এদের ভাবটা এমন যে ‘উই ডোন্ট কেয়ার এবাউট লাইফ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’। সর্বশেষ গত ২২ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ দুর্ঘটনার তদন্ত শুরুর আগেই ঘাতক নৌযান (নার্গিস-১)-এর নথিপত্র গায়েব হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সূত্র জানায়, পরিবেশ অধিদফতরের বিভিন্ন ধারা ও নৌ অধিদফতরের বাধ্যবাধকতার কিছুই প্রয়োজন হয় না যদি আনফিট নৌযানের রেজিস্ট্রেশন ও চলাচল অনুমতি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা যায়। এ কথা সত্য যে, ৯০ শতাংশ নৌযানের রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সার্ভেয়াররা প্রদান করছে কোন ধরনের সার্ভে না করেই। সঙ্গত কারণে মনুষ্য সৃষ্ট এসব দুর্ঘটনার দেশের নৌ সেক্টরের জন্য বয়ে আনছে বিপজ্জনক পরিস্থিতি। আর অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা। শঙ্কায় নবীন মেরিন ক্যাডেটদের ভবিষ্যত ॥ সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ের মেরিটাইম ইনস্টিটিউট থেকে লাগামহীনভাবে ক্যাডেট প্রশিক্ষণ দিয়ে এর পূর্বাপর চিন্তা না করে চাকরির বাজারে ছেড়ে দেয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে ভুক্তভোগীদের মাঝে ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি করেছে। গেল বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মেরিন একাডেমি থেকে উত্তীর্ণ ৪৮ ও ৪৯তম ব্যাচের ৪ শতাধিক ক্যাডেট জাহাজে যোগদানের অপেক্ষায় আছে। যার মধ্যে প্রায় ২০ জন রয়েছেন নারী ক্যাডেটও। এদিকে, বেসরকারী পর্যায়ে ১৮ মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের ১২ থেকে পাস করা মেরিন ক্যাডেট সংখ্যা এ মাসে দাঁড়াবে প্রায় ৬৫০ জনে। বর্তমানে সী টাইম করার উপযোগী দেশীয় সমুদ্রগামী পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা মাত্র ৩২। এসব জাহাজে পর্যায়ক্রমে মাত্র ১৩০ ক্যাডেটের সঙ্কুলান হতে পারে। সূত্রমতে, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশে অদূরভবিষ্যতে সমুদ্রগামী জাহাজ বহর বৃদ্ধির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অথচ, মেরিন একাডেমিতে ক্যাডেট সংখ্যা প্রতিবছর বৃদ্ধির বদলে কমানোর কোন চিন্তা নেই। যা সামগ্রিকভাবে অশুভ একটি তৎপরতা বলে মনে করছেন এ সেক্টরের বিশেষজ্ঞগণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শিপিং সেক্টরের নীতিনির্ধারক দফতর, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর সম্পূর্ণ অনৈতিকপন্থায় গেল ২০১২-১৩ সালে অর্থাৎ ১৪ মাসে ১২ মেরিটাইম ইনস্টিটিউট পরিচালনার লাইসেন্স প্রদান করেছে, যা বিপুলসংখ্যক ক্যাডেটদের বেকার জীবনে নিপতিত করেছে। সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাপী জাহাজ ব্যবসায় বর্তমান মন্দাভাব, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশী নাবিকদের গ্রহণযোগ্যতা পুরোপুরি ফিরে না আসা, ভিসা জটিলতা, ভুয়া সনদ ও সিডিসি নিয়ে বিভিন্ন দেশে গমন ও ধরা পড়া ইত্যাদি কারণগুলো পর্যালোচনা না করে মেরিন একাডেমিতে অতিরিক্ত ক্যাডেট ভর্তি ও বেসরকারী মেরিটাইম ইনস্টিটিউটগুলোর কর্মকা-ের ওপর সরকারী নজরদারির অভাব আগামী দিনগুলোতে এ সেক্টরের ক্যাডেটদের জন্য অশুভ বার্তাই নিয়ে আসছে। সোসাইটি অব মাস্টার মেরিনার্স বাংলাদেশের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে জানান, অতিসম্প্রতি একটি বেসরকারী মেরিন একাডেমির ৬ ক্যাডেট বিদেশে যোগ দিতে না পেরে লাঞ্ছিত হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। পুরো ব্যাপারটি ঘোলাটে হলেও ম্যানিং এজেন্টদের কারসাজিতে এ ঘটনা ঘটেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি জানান, আইএমও ও বাংলাদেশের শিপিং নিয়মানুযায়ী ক্যাডেটদের মেরিটাইম প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের পর জাহাজে যোগদানের ও এক বছর সী টাইম অতিবাহিত করার দায়িত্ব স্ব স্ব মেরিটাইম প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়। অথচ, সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে এর ব্যত্যয় ঘটছে নজিরবিহীন। তার মতে, এ অবস্থায় চাকরির বাজার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মেরিন একাডেমিতে ক্যাডেট সংখ্যা হ্রাস জরুরী। যেসব বেসরকারী মেরিটাইম ইনস্টিটিউট কাক্সিক্ষতসংখ্যক ক্যাডেট পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছে তাদের কার্যক্রম নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। মেরিন ক্যাডেট ও নাবিকরা যাতে ম্যানিং এজেন্সি দ্বারা প্রতারিত না হয় সে জন্য তাদের ব্যপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জাল সনদ ও ভুয়া সিডিসি কঠোরভাবে দূর করা।
×