ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টুম্পার পুড়ে যাওয়া মুখ শুধু কান্না নয়, অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৫ মার্চ ২০১৫

টুম্পার পুড়ে যাওয়া মুখ শুধু কান্না নয়, অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘আমার আশা ভরসা শেষ হয়ে গেল। ওর দিকে তাকাতেও ভয় লাগে! নিজের মেয়ের মুখের প্রতি তাকিয়ে ভয় পাওয়া যে কোন বাবার জন্য দুর্ভাগ্যজনক! টুম্পা টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাত। নিজের খরচ চালিয়েও ছোট ভাইবোনকে নানা সময়ে নানাভাবে সাহায্য করত। এখন মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। মেয়েকে কিভাবে বিয়ে দেব?’- কথাগুলো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রাবিনা করিম টুম্পার বাবা রেজাউল করিম লিটন। গত ১ মার্চ বোনের বাসা থেকে বের হয়ে আলিফ পরিবহনের বাসে চড়ে বাসায় ফিরছিলেন টুম্পা। বাসটি রামপুরার বনশ্রীতে পৌঁছলে হরতাল-অবরোধ সমর্থনকারীদের ছোড়া পোট্রোলবোমায় টুম্পাসহ দগ্ধ হন আরও তিনজন। ওই ঘটনায় ৭১ টেলিভিশনের সাংবাদিক আরেফিন শাকিল, টুম্পার খালাত বোন কুনতলা পুতুল ও নির্মাণশ্রমিক নাজিম দগ্ধ হন। ঘটনার পর পরই তাদের ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে টুম্পার শ্বাসনালী ও মুখম-ল পুড়ে যাওয়ায় তার অবস্থা সবচেয়ে আশঙ্কাজনক। চিকিৎসক ও টুম্পার পরিবার সূত্রে জানা যায়, ওই শিক্ষার্থীর শরীরের ১৮ শতাংশই পুড়ে গেছে। বর্তমানে তাকে বার্ন ইউনিটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। টুম্পার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উজেলায়। বাবা-মায়ের সঙ্গে সে দক্ষিণ বাড্ডায় বসবাস করত। নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বেডে টুম্পার নিথর দেহ পড়ে আছে। কোন সাড়া শব্দ নেই। স্যালাইন ঝুলছে। দুই হাতসহ শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো। পাশেই নার্সসহ চিকিৎসকরা তাকে সেবা দিতে ব্যস্ত। টুম্পার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার বাবা রেজাউল করিমের চোখে তখন স্পষ্ট কান্নার ছাপ! তিনি বলেন, ‘টুম্পা মহাখালী টিএন্ডটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে। ওর ইচ্ছে ছিল ব্যাংকে চাকরি করার। মেয়েটা পড়ালেখায় খুব মনোযোগী। লীজ ফ্যাশন লিমিটেড নামে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করি, তাই পারিবারিকভাবে খুব একটা সচ্ছল নই। পরিবারের কথা চিন্তা করে নিজের খরচ যোগাতেই মেয়েটা টিউশনি করত। ওর এমন পরিস্থিতি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমার মেয়ে এখানে পড়ে থাকুক তা আমরা চাইনি!’ বিএনপি-জামায়াতের কথিত হরতাল-অবরোধের নামে পোট্রোলবোমায় আক্রান্ত রোগীদের সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সাহায্য করা হচ্ছে। হাসপাতালের পক্ষ থেকেও একই ব্যবস্থা। সরকারী সহায়তা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সর্বাত্মক সাহায্যের প্রশংসা করে টুম্পার বাবা লিটন জনকণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খোঁজখবর নিচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। টুম্পার ছোট ভাই রবিউল করিম সাঞ্জু অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সরকার সব রকমের সহায়তা দিচ্ছে। হাসপাতালের চিকিৎসাও উন্নত। সেবা পেতে আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু আমরা এমন সাহায্য প্রত্যাশা করিনি। আমার বোনটার এমন পরিণতি দেখতে হবে তা কখনও কল্পনাও করতে পারি না। দগ্ধ মেয়ের এই করুণ পরিণতিতে পরিবারের অন্য সবার চাইতে বেশি ভেঙ্গে পড়েছেন টুম্পার মা জিন্নাত রেহানা। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আল্লাহ! আমার মেয়ের মতো আর কোন মেয়ের যেন এমন অবস্থা না হয়। আমি আর এই কান্না সহ্য করতে পারছি না। মানুষ কেমন করে মানুষকে পোড়ায়? খবর ও সাহায্য দিয়ে কী হবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার দিন মেয়েটা বনশ্রীতে অবস্থিত খালাত বোনের বাসা থেকে দক্ষিণ বাড্ডার নিজ বাসায় ফিরছিল। ও ৩-৪টা টিউশনি করত। আমার মেয়েটা খুব পরিশ্রমী। ওর খুব সখ ছিল লেখাপড়া শেষ করেই কোন একটি ব্যাংকে চাকরি করবে। ছোট ভাইবোনগুলোর দেখাশুনা করবে। কিন্তু সব কিছুই ফিকে হতে চলল। আমরা তার ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত!’ বিএনপি-জামায়াতের কথিত হরতাল-অবরোধের নামে পোট্রোলবোমার আগুনে দগ্ধ হয়ে টুম্পার মতো বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন আরও ৫০ জন। তাদের কারও মুখম-ল পুড়ে গেছে, কারও কারও সারাশরীর ঝলসে গেছে। বার্ন ইউনিট এখন এক বিভীষিকার নাম। পুরো ইউনিটজুড়ে স্বজনদের আহাজারি। অবুঝ শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ বাদ যায়নি আগুনে পোড়া থেকে! প্রতিটি বয়সের মানুষকে পুড়িয়েও শান্ত হয়নি কথিত ওই হরতাল আহ্বানকারী সন্ত্রাসীরা। প্রতিনিয়তই কেউ না কেউ পুড়ছেন। তাই এখনও স্বজনের আহাজারিতে ভারি হয়ে আছে বার্ন ইউনিটের পরিবেশ। বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল জনকণ্ঠকে বলেন, চলমান সহিংসতায় দগ্ধ ১৫৮ জন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন ৯৪ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ৫০ জন। দগ্ধদের মধ্যে অনেকেরই মুখম-ল ও হাত পুড়ে গেছে। তাদের মধ্যে ৪ জনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) এবং ৬ জনকে হাইডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) রাখা হয়েছে। তাদের অনেকের মতো টুম্পার শরীরের ১৮ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
×