ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতির দুই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ৫ এপ্রিল

আদালতে যাননি খালেদা ॥ পরোয়ানা বহাল

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৫ মার্চ ২০১৫

আদালতে যাননি খালেদা ॥ পরোয়ানা বহাল

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা বহাল রেখেছে আদালত। বুধবার ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার প্রায় দুই ঘণ্টা শুনানির পর খালেদার পরোয়ানা প্রত্যাহারের আবেদন নথিভুক্ত রেখে আগের আদেশই বহাল থাকবে বলে আদেশ দেন। এদিন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা এই দুই মামলার সাতজন সাক্ষী উপস্থিত থাকলেও তাদের জবানবন্দী নেয়া সম্ভব হয়নি। পরে এই দুই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৫ এপ্রিল দিন ঠিক করেছে আদালত। এদিকে, খালেদার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগের মতোই আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন বলে আদেশ দেন আদালত। আদেশের পর দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের বলেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় খালেদা জিয়া আইনের দৃষ্টিতে পলাতক। যেহেতু তিনি আত্মসমর্পণ করেননি, সেহেতু তার কোন আবেদন শোনার সুযোগ আদালতের নেই। তারপরও তাঁর পক্ষে সিনিয়র আইনজীবীরা এসেছেন। এ কারণে তাঁদের বক্তব্য আদালত শুনেছে। সব আবেদন তিনি নথিভুক্ত রেখেছেন, গ্রহণ করেননি। এদিকে, খালেদা জিয়া আত্মসমর্পণ করতে পারেন, এমন খবরে সকাল থেকেই বকশিবাজার অস্থায়ী আদালত এলাকায় উত্তেজনাকর অবস্থা বিরাজ করছিল। বকশিবাজার মোড় থেকে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ পর্যন্ত রাস্তায় তিন স্তর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণেও র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় নিরাপত্তা বলয়। উপস্থিত মিডিয়া কর্মীদের মধ্যেও বিরাজ করে উত্তেজনা। অন্যদিকে, গ্রেফতারি পরোয়ানার আদেশ স্থগিতে বিচারিক আদালতের পাশাপাশি হাইকোর্টেও একটি আবেদন করেছেন খালেদা জিয়া। আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি রেজাউল হক ও বিচারপতি মোঃ খসরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে ওই আবেদনের সঙ্গে দুর্নীতির দুই মামলায় খালেদার বিচারক পরিবর্তনের আবেদনের শুনানি হবে বলে তাঁর আইনজীবী জানিয়েছেন। লাগাতার অবরোধ ডেকে গত দুই মাস ধরে গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থানরত খালেদা টানা কয়েকটি ধার্য তারিখে আদালতে অনুপস্থিত থাকায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন। একইসঙ্গে অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদার ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ৪ মার্চ আদালতে হাজির করতে তাঁর আইনজীবীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারেক চিকিৎসার কথা বলে উচ্চ আদালতের জামিনে গত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। এ দুই মামলার শুনানির আগের দিন মঙ্গলবার বিচারিক আদালতে পরোয়ানা প্রত্যাহারের আবেদন করেন খালেদা। তিনি যে এদিনও আদালতে যাবেন না, তা স্পষ্ট হয় তাঁর আইনজীবীদের বক্তব্যে। আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়ে খালেদার আইনজীবী ও উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং গুলশানের কার্যালয়ে পুনরায় ঢোকার নিশ্চয়তা পেলেই আদালতে যাবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। আত্মসমর্পণ না করলে খালেদা গ্রেফতার হবেন কিনা- এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই বুধবার সকালে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে জড়ো হন সংবাদকর্মীরা। খালেদার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সে সময় সাংবাদিকদের বলেন, বেগম খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইনজীবীরা বিষয়টি দেখছেন, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বেগম জিয়া কী করবেন তা ঠিক হবে। শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুপস্থিতিতেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বকশীবাজার এলাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে নির্মিত অস্থায়ী এজলাসে দুর্নীতির দুই মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতেই গ্রেফতারি পেরোয়ানা প্রত্যাহারে খালেদার আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়। এর পাশাপাশি আদেশ সংশোধন, জামিন বহাল রেখে তার পক্ষে আইনজীবীকে প্রতিনিধিত্ব করতে দেয়া এবং সাক্ষ্য পেছানোর আবেদন করেন তাঁর আইনজীবীরা। খালেদার পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এজে মোহাম্মদ আলী। সানাহউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদারসহ বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তাঁকে সহায়তা করেন। খালেদার অনুপস্থিতির কারণ হিসাবে তার আইনজীবী মোহাম্মদ আলী আদালতকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ আদালতে আসতে পারছেন না। এ আদালতের বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করার বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি। শুনানিতে তিনি বলেন, মিডিয়া ট্রায়াল করা হচ্ছে, যা বিচারকের আদেশে রিফ্লেক্ট হচ্ছে। আমরা গত তারিখে এই বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলাম এবং উচ্চ আদালতে গিয়েছি। আগামীকাল তা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরেও খালেদার আদালতে না যাওয়ার কথা তুলে ধরে বিচারক এ সময় দুদকের আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, উনি আদালতে আসেননি। উনার আইজীবীদের এসব পিটিশন করার এখতিয়ার আছে? জবাবে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, খালেদা জিয়া আদালতে না আসায় তাদের এসব আবেদন করার কোন এখতিয়ার নেই। এ সময় উভয়পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনার পর আবার শুনানি শুরু হয়। দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত আদেশে বলেন, যেহেতু উচ্চ আদালতে করা আবেদন বিচারাধীন আছে, তাই উচ্চ আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমরা এ মামলা দুটির সাক্ষ্য গ্রহণ আগামী ৫ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করছি। এছাড়া আবেদনগুলো নথিভুক্ত করা হলো। আবেদনগুলোর বিষয়ে কোন আদেশ দেয়া হলো না। আদেশের পর মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আইনগত কোন ভিত্তি না থাকায় আদালত খালেদা জিয়ার সব আবেদন নথিভুক্ত করেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদকের এই আইনজীবী বলেন, পরোয়ানা বহাল থাকায় এখন যে কোন সময় খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হতে পারে। আবার যে কোন সময় তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন। কাজল আরও বলেন, খালেদার আইনজীবীরা নিরাপত্তার কথা বলে অন্য কাউকে তাঁর পক্ষে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করতে দেয়ার আবেদন জানালেও ‘ফৌজদারি কার্যবিধিতে এমন কোন সুযোগ না থাকায়’ দুদকের আইনজীবীরা এর বিরোধিতা করেছেন। বিচারকের প্রতি খালেদার অনাস্থার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কাজল বলেন, বিচারক বলেছেন, তিনি এমন কোন কাজ করেননি যা এ মামলার বিচারের বিপক্ষে যেতে পারে। আর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে গেলেও অনাস্থার পক্ষে বা বিপক্ষে কোন আদেশ আনতে পারেননি এ অবস্থায় মামলার কাজ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এসব বিষয় ফয়সালা করে আসার জন্যই আদালত প্রায় এক মাসের জন্য সাক্ষগ্রহণ মুলতবি করেছে বলে দুদকের এই আইনজীবী জানান। আর তারেক রহমানের বিষয়ে আদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারেকের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তিনি এখনও এ অসুস্থ। এ কারণে তিনি আসতে পারেননি। আমরা বলেছি, তাহলে তাঁকে আরও কিছুদিন সুযোগ দেয়া হোক। তিনি প্রতিনিধির মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারেন। চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ॥ ২০১১ সালের ৮ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ চার জনের বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ। তেজগাঁও থানার এ মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এ মামলার অপর আসামিরা হলেন- খালেদার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। এদের মধ্যে হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু হতেই পলাতক। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে। খালেদাসহ বাকি দুই আসামি জামিনে রয়েছেন। অরফানেজ ট্রাস্ট ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় অন্য মামলাটি দায়ের করে। এতিমদের সহায়তার জন্য একটি বিদেশী ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় এ মামলায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুন উর রশিদ ২০১০ সালের ৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন। মামলার অপর আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। তারেক রহমান উচ্চ আদালতের জামিনে গত ছয় বছর ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন। সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন ছিলেন তবে বুধবার খালেদাসহ তাদের জামিনও বাতিল করে আদালত। বাকি দুজন পলাতক।
×