ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তের নামে

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৫ মার্চ ২০১৫

মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তের নামে

একটি ডাকে জেগেছিল সাত কোটি প্রাণ। স্বাধীনতার সোনার সূর্য ছিনিয়ে আনার দৃঢ়শপথে তুলে নিয়েছিল হাতে অস্ত্র। দীর্ঘ নয় মাস লড়াই সংগ্রাম করে এনেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। প্রশিক্ষিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছিল বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবা, তরুণ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ কিশোর, কিশোরী এবং সেনাবাহিনী, পুলিশ ও রাইফেলসের সদস্যরা। পর্যুদস্ত করেছিল পাকিস্তানী হানাদার ও তার দোসরদের। বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই পেয়েছিল নতুন এক দেশ- রক্তে রাঙ্গা বাংলাদেশ। সেদিন যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁরা কেউই ব্যক্তিগত প্রাপ্তির জন্য কিছু করেননি। করেছেন দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য, জাতির মুক্তির জন্য। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার মহান ব্রত নিয়ে যাঁরা রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন যাঁরা যোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন নানা ক্ষেত্রে- তাঁরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্রহাতে সবাই যুদ্ধ করেননি। কেউ গানে, কবিতায়, নাটকে, বেতারে শব্দসৈনিক হিসেবে প্রেরণা যুগিয়েছেন। কেউ বা মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন। সবার ওপরে ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের ছিলেন সংগঠক। বিভিন্ন পেশার মানুষ শত্রু হটাতে যার যা আছে তাই নিয়ে লড়াই করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা করেছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা। কারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হবেন, সেটি ১৯৭২ সালে এক সরকারী আদেশে নির্ধারণ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যে কোন সংগঠিত দলের (ফোর্স) সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু ১৯৭৯ সালে রাজাকার পুনর্বাসনকারী জিয়াউর রহমানের শাসনামলে একটি যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে নতুন সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করা হয়। এরপর ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের জারি করা এক পরিপত্রে নয়া সংজ্ঞা করা হয়, এতে কারা মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারী হবেন তার সংজ্ঞা বা চারটি শর্ত দেয়া হয়। এ চারটির যে কোন একটি শর্তে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ পান মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীরা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুনর্গঠিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। পরে আবার নতুন করে নতুন সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এই সংজ্ঞা নির্ধারণ কি কারণে। কার স্বার্থে, কিসের প্রয়োজনে সেসবের জবাব মেলে না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, সকল আইন, বিধি বিধানের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে সকল ব্যক্তি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।’ সংজ্ঞা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে পঁচাত্তর-পরবর্তীকাল হতে নানা রকম জটিলতা তৈরি করা হয়েছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদধারীর সংখ্যা বেড়েছে। সামরিক জান্তা শাসকরা ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করেছেন। নতুন করে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ আবার সংজ্ঞায়িত করার এই উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সংজ্ঞা ক্ষুণœ হবে নাতো? সেটা যাতে না হয়, যাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সঠিক মূল্যায়ন পান সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।
×