ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

অভিজিৎদের খুন করা যায় চিন্তা খুন করা যায় না

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৫ মার্চ ২০১৫

অভিজিৎদের খুন করা যায় চিন্তা খুন করা যায় না

অভিজিৎ রায় নিহত হলেন। তাঁর স্ত্রীও হয়ত হতেন, অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। কিন্তু এই বাঁচা হয়ত তাঁর জন্য আরও কষ্টকর। অভিজিৎ আমাদের নির্বিরোধী শিক্ষক অধ্যাপক অজয় রায়ের পুত্র। অজয় স্যার আমাদের শিক্ষকদের অনেক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে আছেন দীর্ঘদিন। আমাকে একদিন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সম্পর্কে বলছিলেন, মুক্তমনা নামে একটি ব্লগ চালায় সে। কম্পিউটার জগতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। তাই মুক্তমনা ব্লগ সম্পর্কে ধারণাও নেই। তবে, অনেকে মুক্তমনার কথা বলতেন। প্রশংসা করতেন। পুত্রের মৃত্যুর পর আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘সব দিক থেকে তার পিতাকে সে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কী হলো এখন। আমার বাঁচার অর্থ কী?’ সারা জীবন যিনি মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন করেছেন, শেষ জীবনে কি এটিই তাঁর প্রাপ্য ছিল? যারা প্রগতি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তাদের জীবন প্রায় ক্ষেত্রে এরকম। যারা প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তারা যাবতীয় পার্থিব পুরস্কার পায় এ দেশে। এর কারণ আমার জানা নেই। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বোঝা, পিতার কাঁধে পুত্রের লাশÑ এ সত্য আমি সেদিন আবার অনুভব করেছিলাম। আশি বছরের বৃদ্ধ অধ্যাপকের জন্য এ বোঝা আরও ভয়ঙ্কর। অভিজিতের স্ত্রীর জন্যও জীবন আর আনন্দময় নয়। এ হত্যার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গী মৌলবাদী গোষ্ঠী। ইসলামের নামে খুন করা হয়েছে অভিজিৎকে। এখানে হিন্দু-মুসলমানের কোন ব্যাপার নেই। এর আগে যাঁরা খুন হয়েছেন তাঁরা সবাই মুসলমান। যাঁরা নিজেদের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মনে করেন, এখন তাঁদের সময় এসেছে এটি উপলব্ধি করার যে, ইসলাম এখন আর রসুলের (দঃ) সময়কার একক ইসলাম নেই। ইসলাম বহুধাবিভক্ত। সুতরাং আমরা যখন ইসলাম বলি তখন বুঝতে হবে আমরা একক কোন ইসলামের কথা বলছি না, ৭২ ভাগে বিভক্ত এক অংশের ইসলামের কথা বলছি। অন্যদিকে, সারা মুসলিম জাহানকে মোটা দাগে দু’ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারেÑ একটি ধর্মপ্রাণ অন্যটি ধর্মব্যবহারকারী। শেষোক্ত মুসলমানরা সব সময় ছিল, তবে বিশ শতকের শেষার্ধে এদের উত্থান লক্ষণীয়। ধর্ম ব্যবহারকারী মুসলমানদের উৎস সৌদি আরবের ওয়াহাবি ইসলাম। সৌদিরা সব সময় এদের লালন পালন করেছে। এখন লালিত পালিতরা তাদের থেকেও হিংস্র হয়ে উঠছে। সৌদিরা চায়, ধর্মীয় মৌলবাদ বা জঙ্গীরাজ থাকুক; কিন্তু তা সৌদি রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করবে না বরং তাকে মান্য করবে। উগ্র জঙ্গীবাদীদের অবস্থান ওই ধরনের রাজতন্ত্রের বিপক্ষে। ধর্ম ব্যবহারকারীর কাছে যুক্তি গৌণ। তাদের ভিত্তি বিশ্বাস, সে বিশ্বাস নিজস্ব, তার সঙ্গে ইসলামের মৌল চরিত্রের পার্থক্য থাকতে পারে, তাতে কিছু আসে যায় না। সভ্যতা-সংস্কৃতি বা পারিবারিক বন্ধন কোন বিষয় নয়। গত পাঁচ হাজার বছরে অনেক ধর্ম এসেছে, গেছে। অনেক যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে; কিন্তু এ্যাসিরীয় বা ব্যবলনীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির নিদর্শনে কেউ হাত দেয়নি। আজ পরিকল্পিতভাবে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া যেখানে ধর্ম ব্যবহারকারী জঙ্গীরা আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে সেখানে তা ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। সৌদিরা যেমন সৌদি আরবের সমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস করে দিয়েছে। কারণ, তা থাকলে সৌদি রাজতন্ত্র সম্পর্কে প্রশ্ন উঠবে। পাকিস্তানেও ইতিহাস পাঠ্যসূচী থেকে অপসৃত হয়েছে। আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও পাকিস্তানকে অনুসরণ করছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন আমাদের। এখানে যে জঙ্গী-মৌলবাদ তরুণদের মধ্যে আশ্রয় পেল এর একটি কারণ, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্ব পেয়েছে ধর্ম, দেশজ সংস্কৃতি বা ইতিহাস নয়। ক্ষমতাসীনরা তা না মানতে পারেন, ক্ষমতায় থাকলে অনেক কিছুই ক্ষমতাবানরা মানতে চান না, মৌল জঙ্গীবাদীদের মতো তাদের বিশ্বাসই অভ্রান্ত মনে করেন, যুক্তি নয়। এখন প্রতিবছর মূল দল থেকে বহু দল হচ্ছে এবং একটি থেকে আরেকটি হিংসাত্মক হয়ে উঠছে। রক্তবীজের মতো যেন সব বাড়ছে। এখন প্রধান হয়ে উঠছে খ্রীস্টান-মুসলমান বা ইহুদী খ্রীস্টান নয়, ইসলাম বনাম ইসলাম। ইসলাম নিয়ে যারা ভাবেন বা করে খান তারা যদি একবার গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতেন, এসব বিবাদ ধর্ম কিনা তাহলে হয়ত অনেক কিছুর মীমাংসা সম্ভব ছিল। অভিজিৎকে ইসলামের নামেই খুন করা হয়েছে। তিনি খুন হওয়ার পর মাঝবয়সী বা তরুণ যারা ধর্ম থেকে ইন্টারনেটে বেশি মনোযোগী তাদের অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তারা যে এতে খুব ব্যথিত আমার মনে হলো না। একজন বললেন, ‘আপনি ব্লগ পড়েন? জানেন, ধর্ম নিয়ে তারা কী লিখছে।’ আমি চিন্তা করে দেখেছি আসলে হেজাবিদের প্রভাব আমাদের মনোজগতে স্থান করে নিয়েছে। এ বিষয়টি কিন্তু কেউ বিবেচনায় আনছেন না। ‘ব্লগার’ শব্দটি এখন নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। আগে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। হেজাবিরা [হেফাজত+জামায়াত+বিএনপি] ক্ষমতা দখলের চেষ্টার পর্বে প্রথমেই আক্রমণ করেছিল ইন্টারনেটকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য আহমদ শফী ও তার অনুসারীরা ‘আমার দেশ’-এ প্রথম যে বিজ্ঞাপন ছেপেছিলেন, সেখানে যদ্দুর মনে পড়ে চারজনকে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছিলÑ শাহরিয়ার কবির, জাফর ইকবাল, অজয় রায় এবং আমাকে। শাহরিয়ার বা জাফর আজ পর্যন্ত ধর্ম সম্পর্কে বা ধর্ম পালন সম্পর্কে কোন বিরূপ মন্তব্য করেছেন বলে কোন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী তো আমাকে হাজী বানিয়েছেনই। [বলে রাখা ভাল, অনেকে বিশ্বাস করেন আল্লাহ কবুল না করলে হজ করা যায় না। আমি হজে যাওয়ার প্রাক্কালে এক জামায়াত কর্মী, আমি যে নাস্তিকতা পরিত্যাগ করে ধর্মের পথে ফিরেছি সে জন্য হেদায়েত করে এক চিঠিতে শেষ বাক্যে জানিয়েছিল, ‘যা হোক আল্লাহ আপনার হজ কবুল করিয়াছেন দেখিয়া আপনি যাইতেছেন। আপনি আমার জন্য দোয়া করিবেন] কিন্তু, অজয় রায় মুরতাদ হন কিভাবে? এর অর্থ আগে যেটা বলেছিলাম, জঙ্গী মৌলবাদ শক্তি চেনে যুক্তি চেনে না। তা হলে, আমাদের ধর্মবিরোধী মুরতাদ ঘোষণা করা হলো কেন? কারণ, আমরা সেক্যুলার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে। আর অধ্যাপক অজয় রায় হলেন ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিতের বাবা। তখন থেকেই শুনেছি ধর্ম ব্যবহারকারীদের বিশাল ক্রোধ আছে মুক্তমনার বিরুদ্ধে। শাহবাগ জাগরণ বিকশিত হতে থাকলে সংবাদ মাধ্যম ব্লগারদের ওপর আলো ফেলতে থাকে। এটিই কাল হয়ে দাঁড়ায়। হেজাবিরা ঘোষণা করে ব্লগাররা নাস্তিক। এই শব্দটি ব্লগারদের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়। এবং অনলাইন ও অন্যান্য মাধ্যমে তা গুরুত্ব পায়। ব্লগারদের মধ্যেও সমস্যা আছে। এদের একটা অংশ ধর্ম না বুঝে ধর্ম নিয়ে হয়ত গালাগালি করেছে যেটি হেজাবিদের সুযোগ দিয়েছে। যুক্তিবাদীরা এখানে হেরে গেছেন। ইন্টারনেটে জ্ঞানচর্চা ও বাস্তবের সঙ্গে যোগ না থাকলে এ ধরনের মতিভ্রম হতে পারে এবং তা মুক্তমনাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আমি এর একটা উদাহরণ দিই। অভিজিৎ হত্যার পর, ১৪ দল সাধারণত যেভাবে চেঁচামেচি করে, তা করেনি। জামায়াত-বিএনপির করার কথা তো আসেইনি। এমন কী সোচ্চার সাহিত্যিক-শিল্পী-সংস্কৃতিমনাদের গরিষ্ঠ অংশও সামান্য প্রতিবাদে আসেননি। এর কারণটা কি? উত্তর জানি না। শেখ হাসিনা যেভাবে হেজাবিদের দমন করেছিলেন সেভাবে দমন না করলে হয়ত আজ হেজাবিরাই ক্ষমতায় থাকতেন। কিন্তু তারপর শুনেছি, আওয়ামী লীগের একটি অংশ তাতে খুশি হননি। তাদের মতে হয়ত সমঝোতা করলে পরিস্থিতি আয়ত্তে থাকবে। কিন্তু একটি শিক্ষা আমরা পাই এখান থেকে, তা হলো, মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে হয়। তার সঙ্গে খেলাধুলা অন্তিমে কাজে আসে না। এ কথা আজকের নীতিনির্ধারকরা মানতে রাজি নন যে, পদ অর্থ দিয়ে ইসলাম ব্যবহারকারীদের সাময়িকভাবে শান্ত হয়ত রাখা যায়, কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বা নির্বাচনে তারা কখনও আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের পক্ষেও থাকবে না, ভোটও দেবে না। কিন্তু শক্ত হাতে দমন করলে তারা টু শব্দটি করবে না। এমন কী ভয়ে পক্ষেও থাকতে পারে। এর বড় উদাহরণ আমেরিকা বা পাকিস্তান। এই দুই দেশের নীতিনির্ধারকরা তালেবানদের সঙ্গে খেলাধুলা করার ফলে সারা বিশ্বের অবস্থা কী হয়েছে তা তো দেখাই যাচ্ছে। মৌল জঙ্গীবাদের জন্য যে আমেরিকাও দায়ী তা বলাই বাহুল্য। আজ পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার কালে, সেনাবাহিনী যারা তালেবানদের সমর্থক তারাও ঝুলে থাকা ফাঁসির দ- কার্যকর করছে। এমনকি সরকারের অনুমোদন ছাড়া মাদ্রাসা খোলা যাবে না এই আদেশও জারি করেছে। পাকিস্তানে কিন্তু জঙ্গী হামলা অনেক হ্রাস পেয়েছে। শেখ হাসিনা বিশ্বে নাম করেছেন জঙ্গী মৌলবাদের সন্ত্রাস দমনের কারণে। তাঁর সেই নীতি এখনও অব্যাহত। কিন্তু হেজাবিদের দমনে যে কৌশল নিয়েছিলেন হেজাবি দমনের পর সেই নীতিতে হয়ত খানিকটা শৈথিল্য বা পরিবর্তন হয়েছে। জঙ্গী মৌলবাদীদের ধরা হচ্ছে, কিন্তু দ্রুতবিচার হচ্ছে না। অভিজিতের হত্যাকারী বলে যাকে সন্দেহ করা হচ্ছে সেই ফারাবী তো অনেক আগেই ব্লগে জানিয়েছে হত্যা করা হবে অভিজিতকে। এর আগে আরেকজন ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল, হত্যাও করেছিল। যে ইমাম তার জানাজা পড়িয়েছিলেন তাকেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। একবার তাকে গ্রেফতার করা হয়; কিন্তু জামিনে সে ছাড়া পায়। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বিচারকরাও কিন্তু এর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরও তার হুমকি অব্যাহত ছিল এবং অবশেষে অভিজিৎ খুন হলেন। (বাকী অংশ আগামীকাল)
×