ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীর চরাঞ্চলে সোলার প্যানেল

সৌরবিদ্যুত- ঘরে ঘরে বাতি, ফসলের মাঠে সেচ পাম্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৪ মার্চ ২০১৫

সৌরবিদ্যুত- ঘরে ঘরে বাতি, ফসলের মাঠে সেচ পাম্প

মামুন-অর-রশিদ ॥ রাজশাহীর গোদাগাড়ীর পদ্মার ওপারের একটি ইউনিয়ন চর আষাড়িয়াদহ। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা এ ইউনিয়নের বাসিন্দারা এখনও পায়নি বিদ্যুতের আলো। তাই বলে তারা অন্ধকারে আছে? মোটেই না। তারা ঠিকই আলোর দেখা পেয়েছে, তবে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে। প্রায় প্রতিটি ঘর আলোকিত এই সৌর বিদ্যুতের আলোয়। সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাড়িতে বাড়িতে জ্বলছে বাতি, চলছে টেলিভিশন, ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখাও। শুধু তাই নয়, এ সোলার প্যানেলের বিদ্যুতে সেচও দিচ্ছেন কৃষক। ইউনিয়নের বাসিন্দাদের মধ্যে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা একটু ভাল, তাঁদের বাড়ি সৌরবিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। প্রযুক্তির সবকিছুই চলে এ বিদ্যুতের সাহায্যে। শুধু বৃষ্টিনির্ভর কৃষি অঞ্চল হিসেবে খ্যাত গোদাগাড়ীর চরাঞ্চলই নয়, সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে এখন বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকাতেও সেচযন্ত্র চলছে। বিদ্যুত সুবিধা না থাকায় এক সময় পুরোপুরি কৃষিনির্ভর বরেন্দ্র ও চরাঞ্চলের কৃষক জমিতে সেচ দিতেন জ্বালানি তেল (ডিজেল) ব্যবহার করে শ্যালো ইঞ্জিনের সাহায্যে। এতে বাড়ত উৎপাদন ব্যয়, তেলের সঙ্কট দেখা দিলে মাঠেই ছারখার হতো কৃষকের স্বপ্ন। আজ তারা তেলের ওপর নির্ভরশীল নয়। বসেছে সোলার প্যানেল, সূর্যের আলো কাজে লাগিয়ে চলছে সেচকাজ। এই প্যানেলের মাধ্যমে সূর্যের আলো শক্তিতে পরিণত হয়ে পাম্পের সাহায্যে উঠছে ভূগর্ভস্থ পানি। সেই পানিতে সতেজ কৃষিজমি, কৃষকের মুখে হাসি। দারুণ ফলনে খুশি কৃষক, ফসল ঘরে উঠছে নির্বিঘেœ। চরআষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের বারীনগর ও চরনওশেরা গ্রামে বসেছে সৌরবিদ্যুতচালিত দুটি সাবমারসিবল পাম্প। একটি স্থাপন করেন ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা, অন্যটি সাবেক সদস্য জইদুল ইসলাম। শুধু তাই নয়, বরেন্দ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত মির্জাপুর ও পবার মদনহাটিতেও সোলার প্যানেলের সেচযন্ত্রে সুফল পাচ্ছেন কৃষক। এখন বিদ্যুতের জন্য আর অপেক্ষা করতে হয় না। লোডশেডিং কিংবা লো-ভোল্টেজের বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয় না, থাকতে হয় না ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায়। চরআষাড়িয়াদহ ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা জানান, বছর তিনেক আগে জ্বালানি তেলের প্রকট সঙ্কট দেখা দেয়। সেচের অভাবে কয়েকশ’ বিঘা জমির আধাপাকা ধান নষ্ট হয়ে যায়। ওই সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নেন সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প বসানোর। পরের বছর একটি বেসরকারি সংস্থার কারিগরি সহায়তায় নওশেরা গ্রামে প্রথম সোলার প্যানেল স্থাপন করেন সেচপাম্প চালানোর জন্য। এতে খরচ হয় মাত্র ৫০ হাজার টাকা। ছোটখাটো কারিগরি ত্রুটি হলেও সারিয়ে নেয়া যায় সহজেই। নিজের জমি ছাড়াও অন্যের জমিতে সেচ দেয়া যায়। সাবেক ইউপি সদস্য জইদুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন ১০-১৫ বিঘা জমিতে সেচ দেয়া যায় সৌরবিদ্যুতচালিত সেচ পাম্পের সাহায্যে। নিজের সাত বিঘা জমি ছাড়াও অন্য কৃষকের জমিতে সেচ দেয়া হয় তার পাম্প থেকে। এতে আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছেন তিনি। সরেজমিন দেখা যায়, ২৪টি সোলার প্যানেল সূর্যের আলোকে শক্তিতে পরিণত করে শুধু ছোট একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটের সাহায্যে বিদ্যুত সরবরাহ করছে সেচ পাম্পে। চার্জ ধরে রাখার জন্য বাসাবাড়ির মতো এখানে নেই কোন ব্যাটারি। যতক্ষণ সূর্যের আলো, ততক্ষণ কোন বিরতি ছাড়াই পানি তুলছে সেচ পাম্প। দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে রাজশাহী পল্লী বিদ্যুত সমিতি ২০১২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে তিনটি সোলার সেচ পাম্প স্থাপন করে, যা দিয়ে ৩৫-৫০ বিঘা জমিতে ১২ মাস চাষাবাদ করা সম্ভব। প্রতিটি সোলার পাম্পে খরচ পড়ছে ৪০ লাখ টাকা। রাজশাহী পল্লী বিদ্যুত সূত্র জানায়, যেসব এলাকায় এখনও বৈদ্যুতিক সেচ সুবিধা পৌঁছেনি সেসব এলাকায় সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সেচ পাম্প ব্যবহার করে সারাবছর জমি আবাদ করতে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় বরেন্দ্র অঞ্চলের তিনটির মধ্যে দুটি সোলার সেচ পাম্প চালু রয়েছে। রাজশাহী পল্লী বিদ্যুত সমিতির এজিএম প্রকৌশলী মনসুর রহমান জানান, সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুত উৎপাদন একটি নতুন ধারণা। সোলার সেচ পাম্প ব্যবহারে যে বিদ্যুত উৎপাদন হয়, তা পরিবেশ দূষণমুক্ত এবং খরচও কম। এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে এখন অনেক সুবিধা পেতে শুরু করেছে কৃষক।
×