ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ॥ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হুঁশিয়ারি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৪ মার্চ ২০১৫

ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ॥ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হুঁশিয়ারি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আর্থিক খাতে সুশাসনের সার্বিক উন্নয়ন ঘটলেও সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের মধ্যে বিধি-বিধান ও নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনেক পরিচালক বেনামি কোম্পানির ঋণ মঞ্জুর করে নামে বিপুল পরিমাণের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। বিশেষ করে, পরিচালকদের অনুকূলে নামে-বেনামে সীমাতিরিক্ত ঋণ প্রদান, এসব ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার, বিরূপ শ্রেণীকৃত ঋণকে অশ্রেণীকৃত হিসেবে প্রদর্শন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিচালক নন এমন ব্যক্তি কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে সাবেক পরিচালক বা ঋণগ্রহীতা পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থিত থেকে নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের মতো গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শনে এসব অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যাওয়ায় ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কনফারেন্স রুমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। বৈঠকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংঘটিত আর্থিক অনিয়ম ও পরিচালকদের বিধিবহির্ভূত ঋণ নেয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন পরিচালক মিলে ৩০ শতাংশ ঋণ বিভিন্ন বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক একজন চেয়ারম্যান, কয়েকজন পরিচালক, প্রধান নির্বাহীসহ একটি বহিঃনিরীক্ষক ফার্মকে বহিষ্কার করেছে। আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব সিদ্ধান্ত নিলেও এর বিস্তারিত জানানো হয়নি। বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন অনুসারে আমানতকারীদের আমানত ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের নিজেদের স্বার্থে অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। এ সময়ে বাংলাদেশ লিজিং এ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ও প্রাইম ফাইন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদ খান বলেন, বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বন্ধ করতে প্রধান নির্বাহীদের ভূমিকার জন্য সুরক্ষার প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোতে যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া প্রধান নির্বাহীদের অপসারণ করা যায় না, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অনুরূপ বিধান জরুরী। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর ড. আতিউর রহমান তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গুরুতর অনিয়মের বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও কঠোরভাবে সতর্ক করার পরও এখনও কোন কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথ্য গোপন করে নানা ধরনের অনিয়ম করে যাচ্ছে। এ ধরনের কিছু অনিয়মের তদন্ত কাজ এখন প্রক্রিয়াধীন আছে। তদন্তে কোন অনিয়ম পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাবে। এছাড়া, পর্ষদ সভায় অনুপস্থিত পরিচালককে সভায় উপস্থিতি দেখিয়ে সম্মানী প্রদান, গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা না থাকা সত্ত্বেও ঘন ঘন নির্বাহী কমিটির সভা আয়োজন, অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের বোর্ড রুমের পরিবর্তে অন্য স্থানে পর্ষদ সভা অনুষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব অনিয়মের বিষয়েও আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা মোতাবেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাই এসব বিষয়ে আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং পর্ষদকে অবহিত রাখতে হবে। গবর্নর বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি বাদে বাকি ৩০টি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে তাদের পরিশোধিত মূলধন ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। জিএসপি ফাইন্যান্স লিমিটেডের মূলধন ঘাটতি পূরণের সময়সীমা মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। গবর্নর বলেন, বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু ২-৩টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিরা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। গবর্নর আরও বলেন, আর্থিক খাতে সুশাসনের সার্বিক উন্নয়ন ঘটলেও সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের মধ্যে বিধি-বিধান ও নীতিমালা লঙ্ঘনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে, পরিচালকদের অনুকূলে নামে-বেনামে সীমাতিরিক্ত ঋণ প্রদান, এসব ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার, বিরূপ শ্রেণীকৃত ঋণকে অশ্রেণীকৃত হিসেবে প্রদর্শন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিচালক নন এমন ব্যক্তি কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাক্তন পরিচালক বা ঋণগ্রহীতা পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থিত থেকে নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের মতো গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়েছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে প্রধান নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের জড়িত থাকার বিষয়টিও তদন্তে উদ্ঘাটিত হয়েছেÑ যা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। গবর্নর জানান, কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অনিয়ম ধরা পড়লে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩ এর ২৬ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের আমানত ঝুঁকিমুক্ত রাখা বা জনস্বার্থে উক্ত প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ ও প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পিছপা হবে না। বিভিন্ন অনিয়মের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের একজন চেয়ারম্যান, কয়েকজন পরিচালক এবং একজন প্রধান নির্বাহীকে অপসারণ করা হয়েছে। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করায় কয়েকজন প্রধান নির্বাহীকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ৪১ ধারার আওতায় ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক দ- আরোপ করা হয়েছে। একটি বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গবর্নর বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের ন্যায় বিভিন্ন প্রচলিত খাতে ঋণ প্রদান করছে। এটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠনের মূল উদ্দেশ্যের মধ্যে পড়ে না বলে তিনি মনে করেন। বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ যেমন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, পরিবেশবান্ধব বায়োগ্যাস, সৌরশক্তি প্রকল্প, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এসব বিশেষ খাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ করা উচিত। কিন্তু দু-একটি সরকারী মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করছে না। হরতাল-অবরোধে বর্তমানে অস্থির সময়েও দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর। তিনি বলেন, আমরা অস্থির সময় পার করছি। এই সময় মাথা ঠা-া রেখে কাজ করতে হবে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন। এই পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি এখনও চাঙ্গা রয়েছে। সক্ষম জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
×