ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাসুদা ভাট্টি

আমি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রকে খুঁজছি

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৪ মার্চ ২০১৫

আমি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রকে খুঁজছি

অভিজিতের মৃত্যুর কারণ কী? অনেকেই এর উত্তরে নানা কিছু বলবেন। ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, তিনি ধর্ম নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন এবং সেজন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। যারা ইতোমধ্যেই এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে তারা টুইটারে লিখেছে যে, যেহেতু আমেরিকা মাত্র কিছুদিন আগে দুই মুসলিম ছাত্রকে হত্যা করেছে সেহেতু তার বদলা নিতে তারা আমেরিকান নাগরিক অভিজিৎকে হত্যা করেছে। কাউকে হত্যা করতে চাইলে কোন কারণ লাগে না, হত্যাকারীর ইচ্ছেই যথেষ্ট, যে কোন হত্যাকা- বিশ্লেষণে প্রাথমিকভাবে এটাই মনে করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের মতো যারা অভিজিৎকে জানতাম, ওর লেখালেখির সঙ্গে, ওর জীবনাচরণের সঙ্গে, ওর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, আমরা জানি যে, ও আসলে পুরনো চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, ও চিন্তার মুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছিল নিরলস। ও বলতে চেয়েছিল বা বলেছিল যে, উটে চড়ে চাঁদে যাওয়া যায় না, চাঁদে যেতে হলে রকেট লাগে। কিন্তু ওর এই কথাতো সবার ভাল লাগবে না, কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছে, কেউ ওকে হুমকি-ধমকি দিয়েছে এবং শেষপর্যন্ত দেশে যাওয়ার পর ওকে হত্যা করেছে। আমরা যাঁরা অভিজিৎকে জানি, তাঁরা মনে করি অভিজিতের মৃত্যুর কারণ আর কিছুই নয়, ওর মতামত প্রকাশ করাটাই ওর জন্য কাল হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে অভিজিৎ একা নয়, এই মৃত্যু মিছিলে লাখ লাখ নারী-পুরুষের নাম করা যেতে পারে কিন্তু আমাদের চোখের সামনে ঘটা হুমায়ুন আজাদের কথাই স্মরণ করি, স্মরণ করি ব্লগার রাজীবকেÑ যাঁরা সকলেই হত্যাকা-ের শিকার এবং তার কারণ মূলত একই। প্রশ্ন হলো, একটি দেশ বা সমাজব্যবস্থা তো একদিনে এই হত্যাকারীদের তৈরি করেনি। সমাজে উদারতা, প্রথাবিরোধিতা এবং অগল ভাঙ্গার মতো মানুষ সব সময়ই ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাঁদের হত্যা করে ‘সমাজ পরিষ্কারের’ (?) দায় নিজের কাঁধে তুলে নেয়ার মতো মানুষও (পড়ুন অমানুষ) ইতিহাসে কম নেই। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের চেহারা আমরা দেখতে শুরু করেছি স্বাধীনতার পর থেকেই। রাজনীতিতে একপক্ষ আরেকপক্ষকে সমূলে বিনষ্ট করার চেষ্টার উদ্বোধনও স্বাধীন বাংলাদেশে। অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এই স্বাধীনতাও অর্জন করেছি যে, নিজের মতের সঙ্গে না মিললে, নিজের রাজনীতির সঙ্গে না মিললে অন্য পক্ষকে প্রয়োজনে হত্যাও করা যায়! আমার কাছে মনে হয়, এখানেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরাজয়, এখানেই বাংলাদেশ আসলে স্বাধীন হয়েও স্বাধীনতা অর্জন করেনি, বরং ভূ-খ-গত স্বাধীনতা এখানে সম্পূর্ণই ব্যর্থ হয়ে যায় মানুষের চেতনার দীনতা এবং উগ্রতার কাছে। ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশ বহু ধর্ম ও বর্ণের দেশ, এটাই এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য। যুগ যুগ ধরে এই সৌন্দর্যকে এই অঞ্চল ধারণ করে আসছে তার সংস্কৃতি, তার জীবনযাপন, সাহিত্য, এমনকি ধর্মগ্রন্থেও। যে সকল ধর্ম ভারতভূমির নিজস্ব তাদের প্রত্যেকটিতেই জোর দেয়া হয়েছে মানুষে মানুষে সম্মিলনের, জ্ঞানের পরিধি বিস্তারের এবং পরমত সহিষ্ণুতার। কিন্তু বাংলাদেশ যে সে অবস্থানে নেই তা আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশ একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের দেশে পরিণত হতে গিয়ে এই মাটির উদারতার ইতিহাস ভুলে গেছে। অথচ মনে না থাকার কোন কারণ নেই যে, এই দেশ যদি উদার না হতো তাহলে যে ধর্মের নামে তারা আজকে এতো হত্যাকা- ঘটাচ্ছে সেই ধর্মটিও এদেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না। কিন্তু কাকে বোঝাবেন? কারও শোনার সময় বা ধৈর্য আছে? নেই। এ এক ভয়াবহ অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা, যেখানে আপনার পাশে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনিই যে একজন খুনী, প্রয়োজনে আপনাকে খুন করে ফেলতে পারে আপনার বিশ্বাস বা জীবনাচরণের জন্য। এর থেকে আমাদের মুক্তি নেই, অন্তত আমাদের জীবদ্দশায় যে নেই, তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আমরা অনেকেই বার বার বলে থাকি যে, বাংলাদেশ বিগত ৪০ বছরে সম্পূর্ণই বদলে গেছে। যে চাওয়া থেকে বাংলাদেশকে পাওয়া, তার ধরন বাংলাদেশকে পাওয়ার পর সম্পূর্ণ বদলে ফেলা হয়েছে। এজন্য কাকে দায়ী করবেন আপনি? মোটা দাগে আমরা জিয়াউর রহমান, এরশাদ, বেগম জিয়া, গোলাম আযম, নিজামিসহ আরও অনেকের নাম করতে পারি কিন্তু তাতে এদেশের সম্মিলিত মানুষের দোষ কোনভাবেই ছোট করে দেখা সম্ভব নয়। এই ভূখ-ের মৌলিক আকাক্সক্ষাকে সবকিছুর উর্ধে তুলে ধরার সার্বিক দায়িত্ব ছিল এখানকার মানুষের। কিন্তু কার্যত আমরা দেখতে পেয়েছি যে, এখানকার মানুষ ধর্মের চশমায় সবকিছু দেখতে শুরু করে স্বাধীনতার পর থেকেই। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করে ভুল করেছিলেন কিনা তা বোধ করি এখন কেউ চাইলে গবেষণা করে বের করতে পারেন। কারণ, স্বাধীনতা মানে যদি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হয়ে থাকে তাহলে এই আত্মাকে বন্ধক দেয়ার, বিবেক বিক্রি করে দেয়ার মতো নোংরামি এই স্বাধীন দেশে কোত্থেকে এলো? কে আমদানি করল? আর আমদানি করলেই যে তা নিতে হবে তার কী কারণ থাকতে পারে? নাকি, ‘বাঙালী ফ্রি পেলে আলকাতরাও লুঙ্গিতে ভরে নিয়ে যায়’- এই গ্রাম্য প্রবাদের সত্যিকার ভিত্তি রয়েছে? আর সে কারণেই উগ্রবাদ বিশেষ করে ধর্মীয় উগ্রবাদ যখন দেশে দেশে ডানা মেলতে শুরু করেছে তখন বাঙালীও তা মাগনা পেয়ে গ্রহণ করেছে? কোন্্টা সত্য আসলে বুঝতে পারছি না, কারণ, অভিজিতের হত্যাকা- আমাদের এমন এক রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে সত্য বিশ্লেষণ এবং সত্যকে খোঁজার তরিকা আমরা গুলিয়ে ফেলতে শুরু করেছি। যেমনটি করেছিলাম গণজাগরণ মঞ্চের উত্তুঙ্গ অবস্থানকালে। যখন হঠাৎই সেই তরুণদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে এদেশে রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছিল। রাতারাতি হেফাজতে ইসলামের মতো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছিল অরাজনৈতিক গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের ইতিহাস এদেশে নতুন নয়, কিন্তু এমনভাবে বোধকরি ধর্মকে আর কখনোই রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়নি এদেশে। এবং আমরা সেই অচলায়তন থেকে মুক্ত হইনি এখনও। এখনও আমরা দেখতে পাই যে, সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অপ্রাসঙ্গিক ইস্যুর সঙ্গেও ধর্মকে জড়িয়ে ফেলা গেলে তা সম্পূর্ণই বদলে যায় এবং তার ফলাফলও হাতেনাতে পাওয়া যায়। অভিজিৎ হত্যাকা-ের বিষয়টিকে ধর্ম দিয়ে সিদ্ধ করার প্রচেষ্টা যে কতটা সফল তা আমরা বুঝতে পারি বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর এই হত্যাকা-ের নিন্দা না জানানো এবং এক অর্থে গা বাঁচানোর ক্রমাগত প্রচেষ্টা থেকে। এটা কেবল নিন্দনীয় নয়, চরম আত্মঘাতীও বটে। আজকে আমরা সেটা বুঝতে পারছি না, কিন্তু যেদিন বুঝব সেদিন হয়ত অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাহলে কি এরকমই চলতে থাকবে? বছর কয়েক আগে হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা হয়েছিল, বিগত বছরে ব্লগার রাজীবকে, এখন অভিজিৎকে, এরপর হয়ত আরেকজনকে, মৃত্যুর সংখ্যা দীর্ঘায়িত হবে কেবল? এর কোন স্থায়ী সমাধানে কেউ আগ্রহী নই আমরা? কেউ কেউ বিতর্ক করছেন যে, এর আগের হত্যাকা-গুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে হয়ত অভিজিৎকে মরতে হতো না। একেবারে কেউ যে, এরকম কথা বলেন না তা নয়, কিন্তু যাঁরা বলেন, তাঁদের রাজনৈতিক শক্তি নেই, তাঁরা নিতান্তই একা। মূলত অভিজিৎদের মতোই, তাঁরা অনেকের ভালবাসা পান ঠিকই কিন্তু ভালবাসা তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। নাহলে, যে বইমেলায় অভিজিৎ নিহত হলেন সেখানে তাঁকে ভালবাসার মতো মানুষের অভাব ছিল বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কেউ কি এই হত্যাকা- ঘটার সময় এগিয়ে এসেছিলেন? রক্তাক্ত অভিজিৎ পড়ে আছেন রাস্তায়, অনেকেই তখন ছবি তুলেছেন কেবল, কিন্তু কেউ এগোননি। মনে হয়, এখানেই মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা হেরে যাই এবং হেরে গিয়ে বেঁচে থাকি অনেকটা পোকামাকড়ের মতো। আজকের লেখার শেষ কথা বলতে কিছুই নেই। শেষ কথা আমি আসলে জানি না। মানুষের মনস্তত্ত্ব বদলানো সহজ কাজ নয়, যাঁরাই বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেন তাঁরা জানেন যে, কোন প্রজেক্টে যদি মানুষের আচার, বিশ্বাস বা মনস্তত্ত্ব বদলানোর বিষয় উল্লেখ থাকে তাহলে সেই প্রজেক্ট নিয়ে কোন দাতা তেমন আগ্রহী হন না, কারণ সেটা বদলানো খুব সহজ নয়। তার মানে কি বাংলাদেশের মানুষের এই উগ্র মনস্তত্ত্বকে বদলানো অসম্ভব? কোনকিছুই অসম্ভব নয় এ পৃথিবীতে। রাষ্ট্র চাইলে, রাষ্ট্র শক্তিশালী হলে সবকিছুই সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্রকে সেটা চাইতে হবে তো। যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাঁদের তো চাইতে হবে সেটা এবং সে জন্য তো রাষ্ট্রের মনস্তত্ত্ব আরও শক্তিশালী হতে হবে, তাই না? আমি সেই শক্তিশালী রাষ্ট্রকেই খুঁজছি বাংলাদেশে। ২ মার্চ, সোমবার ॥ ২০১৫॥ [email protected]
×