ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চাটগাইয়া শুঁটকি

নাম শুনলেই জিভে জল, ভোজন রসিকের প্রিয় খাবার

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩ মার্চ ২০১৫

নাম শুনলেই জিভে জল, ভোজন রসিকের প্রিয় খাবার

মাকসুদ আহমদ শুঁটকির ভর্তা, চচ্চরি আর সাদা ভাতে দুপুরের খাবার। আহ্! কী তৃপ্তি। বিষয়টি ভাবলে যে কোন ভোজনরসিকের জিভে জল এসে যায়। দেশখ্যাত চাটগাঁইয়া শুঁটকির কথা কে না জানে। আর শুঁটকির নানা পদ রান্নায় বিশেষ করে ঢাকাইয়াদের জুড়ি মেলা ভার। শুধু রাজধানীই নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকরা পুঁটলিবেঁধে নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে যান নানা জাতের শুঁটকি। এক ধরনের বিশেষ ঘ্রাণসমৃদ্ধ সুস্বাদু এ শুঁটকির কদর শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও রয়েছে। প্রবাসীরা চট্টগ্রাম এলেই ফেরারপথে নিয়ে যান চট্টগ্রামের অতি প্রাচীন তালিকার এই শুঁটকি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের যত্রতত্র শুঁটকির যেমন দোকান আছে তেমনি আছে শুঁটকির মেন্যু ঘিরে সুসজ্জিত হোটেলের বুফে তালিকাও। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শুঁটকির রকমারি তরকারি আজকাল বিলাসবহুল হোটেলেও ক্রেতার অপেক্ষায় থাকে। নগরীর নামীদামী হোটেলের মেন্যুতে শুঁটকির ভর্তা স্থান করে নিয়েছে ক্রেতার চাহিদার কারণে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এমনকি হতদরিদ্রশ্রেণীও সপ্তাহের কোন না কোনদিন শুঁটকি তরকারির মেন্যুতে সাজায় দুপুরের বা রাতের খাবার। নগরীর বিলাসবহুল হোটেলগুলোতে বুফে খাবারে কয়েকটি আইটেম থাকে শুঁটকির ওপর। এরমধ্যে রয়েছে শিম আর শুঁটকির ভর্তা, আলুভর্তা, বেগুন আর শুঁটকির চচ্চরি। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশিরভাগ তরকারি রান্না হয় শুঁটকিনির্ভর। এমনও দেখা গেছে, বিত্তশালী পরিবারে গরুর মাংসের সঙ্গে রান্না করা কোরাল মাছের শুঁটকি। যারা খাননি তারা তরকারিটি মুখরোচক হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবতারণায় থাকেন। আর যারা অন্তত চেখে দেখেছেন তারা তো পূর্ণ তৃপ্তির স্বাদই নিয়েছেন। দুইয়ের মধ্যে তফাৎ মেলে সেই হিন্দী প্রবচনে। তা হলো- ‘জো খায়া ... আওর জো না খায়া ওভি পস্তায়া’। চট্টগ্রামে শুঁটকি হাতের নাগালে। শুধু বাজারেই নয়, ব্যস্ততম এলাকাতে সচরাচর চোখে পড়ছে শুঁটকির পসরা। দিনের শেষলগ্নে বিশেষ করে অফিস ছুটির সময় নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড়ে ভাসমাণ বিক্রেতারা পসরা নিয়ে বসেন। বাজারের তুলনায় অস্থায়ী দোকানীদের কাছে দামও অনেক কম। মহানগরীর কর্ণফুলী নদী ও চাক্তাই খালকেন্দ্রিক এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিজেদের উৎপাদিত শুঁটকি নিয়ে পসরা বসান। জমিয়ে তোলা হয় শত আইটেমের শুঁটকির পসরা। চারদিকে শুধু শুঁটকি আর শুঁটকি। দোকানীর যেমন অভাব নেই ক্রেতারও ভিড় ঠেলে চাহিদামাফিক শুঁটকি কেনা অনেকটা দায় হয়ে পড়ে। তবে দোকানীরা রাতের আঁধারকে অনেকটা পছন্দ করেন। এর মূলে রয়েছে নতুন ক্রেতাদের ঠকানোর প্রক্রিয়া। যারা কখনও শুঁটকি কেনেননি তারাই মূলত ঠকতে পারেন। শুঁটকি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা না থাকলে ভেজা শুঁটকি ওজনে যেমন বাড়বে তেমনি স্বাদেও ব্যতিক্রম থাকবে। এক্ষেত্রে ক্রেতা একটু সচেতন হলেই অর্থাৎ শুকনো শুঁটকি বা বেশি পুরনোটি কিনে জিভের স্বাদ মেটাতে পারবেন। চট্টগ্রামে শুঁটকির বাজার হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম স্টেশন সংলগ্ন রেয়াজুদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, পাহাড়তলী বাজার, হালিশহর ফইল্যাতলী বাজার, কর্ণফুলী বাজার, কাজিরদেউড়ি বাজার, ইপিজেড বাজার, বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার, পতেঙ্গা নারিকেলতলা বাজারসহ কয়েকটি বাজারে শুঁটকির দোকান সবচেয়ে বেশি। তবে চাক্তাই হচ্ছে শুঁটকির সবচেয়ে বেশি যোগানের অধিকারী। এক কথায় চাক্তাইকে শুঁটকির খনি বলা হয়। পাইকারি ও খুচরা বাজার হিসেবে আসাদগঞ্জ ও চাক্তাই দেশব্যাপী পরিচিত। এসব বাজারে চট্টগ্রামের সেন্টমার্টিন দ্বীপ অঞ্চল থেকে শুরু করে কুমিরা সাগরপার পর্যন্ত সব উপকূলীয় অঞ্চলের শুঁটকির যোগান দেয়া হয়। এর মধ্যে চরলক্ষ্যা, কক্সবাজারের মহেশখালী, সোনাদিয়া, রাঙ্গাবালি, টেকনাফের সাহাবুদ্দিয়া, বাঁশখালির উপকূল অঞ্চল, ভাটিয়ারি, ফৌজদারহাট ও ছোট এবং বড় কুমিরা থেকে শুঁটকির যোগান দেয়া হয় এসব বাজারে। জিভে পানি আসা শুঁটকির মধ্যে রয়েছে লইট্যা, ইলিশ, কোরাল, চিংড়ি, রূপচাঁদা, লাক্কাসহ কয়েক প্রজাতির শুঁটকি। এছাড়াও ছুরি শুঁটকি, মইল্যা, কেচকি, পোয়া, ফাইস্যা, পিতল শুঁটকিসহ নানা প্রজাতির ছোট শুঁটকি প্রতিনিয়ত তরকারিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে সুস্বাদু হয়ে ওঠে শুঁটকির স্বাদে। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শুঁটকি ছাড়া কোন তরকারি রান্না করা হয় না এমন রেওয়াজ রয়েছে। তবে যারা চট্টগ্রামে বসবাস করেন তাদের অনেকেই এখন শুঁটকিনির্ভর হয়ে গেছেন। বিশেষ করে নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের লোকজন যারা দীর্ঘ সময় চট্টগ্রামে রয়েছেন তারাও চাটগাঁইয়াদের হাল ধরেছেন। মনে হয় শুঁটকি ছাড়া খাবার সুস্বাদু হবে না। আর শুঁটকির ভর্তায় সাদা ভাত যেন অধিক পরিমাণে খাওয়া যায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পরিবারগুলোতে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন বাজারে কমপক্ষে সহ¯্রাধিক দোকানী রয়েছে শুঁটকি ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। বিত্তশালীদের নজর কাড়ে লাক্কা আর কোরাল শুঁটকি। চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা কেজি দরেও ৭/৮ কেজি ওজনের লাক্কা শুঁটকি বিক্রি হয়। এছাড়াও কোরাল শুঁটকি পাওয়া যায় আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা দরে। রূপচাঁদা রয়েছে ১৪শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা কেজিতে। লইট্যা শুঁটকি ৬/৭শ’ টাকা, ছুরি শুঁটকি ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। চিংড়ি শুঁটকি ৭/৮শ’ টাকায় বিক্রি হয়। তবে ছোট জাতের চিংড়ি বা পুইস্যা গুঁড়া বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৪শ’ টাকা কেজিতে। ফলে শুঁটকির কদর কমছে না, বরং বাড়ছেই।
×