ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মরদেহ ঢাকা মেডিক্যালে দান

অভিজিতের কফিনে ফুল দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২ মার্চ ২০১৫

অভিজিতের কফিনে ফুল দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা

মুহাম্মদ ইব্রাহীম সুজন ॥ সবাই ফুল হাতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। কারও কারও চোখের পাতা ভিজে উঠেছে। গোপনে অশ্রু লুকিয়ে অনেকেই চোখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছেন। যে মানুষ আজীবন বিজ্ঞানমনষ্ক যুক্তিবাদী কলমে কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাকেই ঘাতকের চাপাতির কোপে রাস্তায় পড়ে মরতে হয়েছে। এমন বর্বর ঘটনার পর তিনদিন অতিবাহিত হলেও খুনীদের এখনও গ্রেফতার করা যায়নি, বিষয়টি যেন কেউই মেনে নিতে পারেননি। তাইতো মনের ভেতরে জমে থাকা সব রাগ, ক্ষোভ, অভিমান তাঁর মৃতদেহের উপস্থিতিতে চোখের জল হয়ে ঝরেছে। রবিবার সকাল দশটা ৪৭ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের মরদেহ বহনকারী এ্যাম্বুলেন্সটি এসে পৌঁছাতেই এমন দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই লেখকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানায় বন্ধু, স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দুপুর বারোটার দিকে অভিজিতের মরদেহ টিএসসির কাছে যেখানে তাঁর ওপর হামলা হয়, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এ সময় মরদেহবাহী এ্যাম্বুলেন্স থেকে তাঁর মরদেহ নামানো হয়নি। হামলাস্থলের ওই স্থানটি ঘিরে রাখা হয়েছে, সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর সময় অনেকেই কাঁদছিলেন। এরপর দুপুর সোয়া বারোটার দিকে অভিজিৎ রায়ের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মগবাজারের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বাসায়। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে মা শেফালী রায় শয্যাশায়ী ছিলেন। ছেলের মরদেহ দেখে আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। বেলা একটার দিকে বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অজয় রায় ছেলের লাশ তুলে দেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শব ব্যবচ্ছেদবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামীম আরার কাছে। এই লাশ গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হবে। এর আগে সকালে অভিজিতের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ক্যাম্পাসে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলায়। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে শ্রদ্ধা নিবেদন কার্যক্রম চলে। এ সময় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জাননোর জন্য অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায়। সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পর্যায়ক্রমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান, জবি শিক্ষক সমিতি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুনুর রশীদ, আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক আবদুর রাজ্জক, ছাত্রলীগ, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণফোরাম, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নারী নেত্রী খুশি কবিরের নেতৃত্বে ‘নিজেরা করি’, রোকেয়া কবিরের নেতৃত্বে ‘নারী প্রগতি সংঘ’, ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বোয়ান), ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ), গণজাগরণ মঞ্চ, উদীচী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ মুক্ত ও প্রগতিশীল মননের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ এবং সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফের সঞ্চালনায় অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অজয় রায়সহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সৈয়দ হাসান ইমাম, জোটের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ছাত্রলীগ সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ, যুগ্মসম্পাদক শামসুল কবির, আইনজীবী সারা হোসেন, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, ঢাবির ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, এটা জঘন্যতম হত্যাকা-। এই ধরনের ঘটনা কেন ঘটল? এটা আমার নিজের কাছে প্রশ্ন, রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন। একই জায়গায় বহুমাত্রিক প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদকে একইরকম ভাবে কুপিয়ে জখম করা হয়। অভিজিৎ একজন গবেষক, লেখক। সে বই লিখেছে, তার মত প্রকাশ করেছে। এ জন্যই কি তার জীবন দিতে হবে? তাকে হত্যা করে হত্যাকারীরা এ দেশের সংবিধানকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলল। এই ঘটনা নিয়ে যেন কোন রাজনীতি না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। শ্রদ্ধা জানাতে এসে নিহত ব্লগার রাজীব হায়দারের মা নার্গিস হায়দার জনকণ্ঠকে বলেন, আমার ছেলের মতো আরেকটি সন্তানকে কুপিয়ে মারা হলো। কয়েকদিন প্রতিবাদ হবে। মিছিল হবে, মিটিং হবে, পরে সব থেমে যাবে। কিন্তু অপরাধীদের বিচার হবে না। অপরাধীদের শাস্তি দিতে সরকারকে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এই ঘটনাটি যেন অন্য ঘটনার মতো শেষ না হয়। খুনীদের যেন গ্রেফতার করা হয়, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, অভিজিৎকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তচিন্তার ওপরে আঘাত করা হয়েছে। যা প্রতিনিয়ত এদেশে ঘটেই চলেছে। অভিজিতের মরদেহ পড়ে থাকার সময় তাঁর স্ত্রী সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল। কিন্তু সেদিন সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। অন্যের বিপদে যদি আমরা এগিয়ে না যাই, তাহলে আমাদের বিপদেও কেউ এগিয়ে আসবে না। এ হত্যাকা-ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীদের হাত রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির সাংবাদিকদের বলেন, আমার মনে হয়, অভিজিতের হত্যাকা- যারা ঘটিয়েছে তাদের মূল টার্গেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অভিজিতের হত্যাকারীদের না ধরলে প্রধানমন্ত্রীর জীবনও সঙ্কটের মধ্যে। সন্তান হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তাঁর বাবা অজয় রায়। শ্রদ্ধা নিবেদনের মাঝে তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান। এ সময় তিনি বলেন, এই শোকার্ত মুহূর্তে আমার কথা বলার ক্ষমতা নেই। তবে আমার মনে হয় মৌলবাদী ও ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী এই হত্যাকা-ের পেছনে থাকতে পারে। এই হত্যাকা- সরকারের একটি ব্যর্থতার প্রতীক। কারণ, মৌলবাদীরা যখন তাঁকে হত্যার হুমকি দিচ্ছিল, তার প্রমাণসহ ডিজি, ডিআইজি সবাইকে জানানো হয়েছিল। তারপরও এই হত্যাকা- প্রমাণ করে তারা কত দরিদ্র, কত অক্ষম, কত ব্যর্থ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ যেন এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে সরকারের ওপর চাপ রাখে। তিনি বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমার ছাত্রীসম। আমি আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ করে বলছি, ‘অভিজিত ও অভিজিতের মতো অন্য যাদের হত্যা করা হয়েছে, এর পেছনে দায়ী জঙ্গী, সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের মূল উৎপাটনের জন্য আপনি যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. ফাহমিদুল হক জনকণ্ঠকে জানান, যেই ক্যাম্পাসকে আমরা সবচেয়ে নিরাপদ মনে করতাম, সেখানেই সবার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হলো একজন সৃজনশীল ও মুক্তচিন্তার মানুষকে। এতো মানুষ, এতো পুলিশ তবুও কেউ ছিল না তাঁকে রক্ষার করার জন্য। ঘাতকেরা তাদের কাজ সেরে নির্বিঘেœ চলে গেছে। ভাবতে কষ্ট হয়। এই হত্যাকা-ের বিচারে যেকোন ধরনের আন্তরিকতার অভাব কোনভাবেই কাম্য নয়। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, দেশ এখন বৈরিতামূলক দ্বন্দ্ব সমস্যায় জর্জরিত। জনগণ এখন বিভক্ত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং এর বিপক্ষের শক্তির মধ্যে চলমান এই দ্বন্দ্বের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সুযোগ খুঁজছে। স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তিকে একত্রিত হয়ে এই সমস্যার অবসান করতে হবে। জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, অভিজিতের বাবার সব কথাই আমাদের কথা। দেশে লাশের সারি দীর্ঘতর হচ্ছে। দেশের প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। অভিজিতকে হত্যার মাধ্যমে সংবিধানকে পদদলিত করা হয়েছে। অবিলম্বে এই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রকৌশলী অভিজিৎ (৪৩) গত বৃহস্পতিবার রাতে স্ত্রীকে নিয়ে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন। হামলাকারীরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা করে। এ সময় তাঁর স্ত্রীকেও কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। প্রকৌশলী অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রের একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করতেন। স্ত্রীকে নিয়ে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশে আসার পর প্রায় প্রতিদিনই বইমেলায় যাচ্ছিলেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রায় ডজন খানেক বই প্রকাশিত হয়েছে যেগুলোর বেশিরভাগই বিজ্ঞান, দর্শন এবং বস্তুবাদ নিয়ে লেখা। পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ব্লগেও লিখতেন। এ কারণে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হুমকিও পেতে হয়েছিল অভিজিৎকে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি হন অভিজিৎ। যন্ত্র প্রকৌশলে লেখাপড়ার পর কর্মজীবন শুরু করেন অটবিতে। চাকরিরত অবস্থায় বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে সিঙ্গাপুরে যান তিনি। এরপরে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে সেখানে জিপিএস প্রযুক্তির গবেষণায় যুক্ত ছিলেন তিনি। এদিকে অভিজিতের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন, মিছিলের কর্মসূচীসহ বিবৃতি প্রদান করা হয়। রবিবার এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয় হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), সন্ত্রাস ও প্রতিরোধ কমিটি, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা প্রভৃতি সংগঠন। এসব বিবৃতিতে বলা হয়, ড. হুমায়ুন আজাদ এবং অভিজিৎ রায়ের হত্যাকা- একই সূত্রে গাঁথা। মুক্ত চিন্তার বিকাশে ও চর্চায় মৌলবাদী ও ধর্মান্ধগোষ্ঠীর আক্রমণকে প্রতিহত করতে সবাইকে একসঙ্গে রাজপথে নামতে হবে।
×