ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রিয় অভিজিৎ

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২ মার্চ ২০১৫

প্রিয় অভিজিৎ

ঠিক কী কারণ জানা নেই কোন ভয়ঙ্কর খবর পড়লেই নিজের অজান্তেই আমি নিজেকে সে অবস্থানে কল্পনা করতে শুরু করি। পদ্মা নদীতে লঞ্চডুবির খবর পড়লে আমি কল্পনায় দেখতে পাইÑ একটা লঞ্চ ডুবে যাচ্ছে, আমি তার ভেতরে আটকা পড়েছি, পানি ঢুকছে, মানুষ আতঙ্কে চিৎকার করছে আর পানির নিচে নিঃশ্বাস নিতে না পেরে আমি ছটফট করছি। যখন একটা বাসে পেট্রোলবোমা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার খবর পড়ি তখন কল্পনায় দেখতে পাইÑআমি বাসের ভেতর আটকা পড়েছি, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে আর আমি তার ভেতর দিয়ে ছুটে বের হওয়ার চেষ্টা করছি, আমার সারা শরীরে আগুন জ্বলছে। পরশুদিন আমি যখন খবর পেয়েছি অভিজিৎকে বইমেলার সামনে কুপিয়ে হত্যা করেছে তখন পুরো দৃশ্যটি আমি আবার দেখতে পেয়েছিÑএই দৃশ্যটি আমার জন্যে অনেক বেশি জীবন্ত। কারণ অভিজিৎ যে রকম বইমেলা ঘুরে তার স্ত্রীকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে এসেছেÑ আমি আর আমার স্ত্রী গত সপ্তাহে ঠিক একইভাবে মেলা থেকে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে এসেছি। আমি জানি, অভিজিতের মতো আমার নামও জঙ্গীদের তালিকায় আছে। কল্পনায় দেখেছি, আমার মাথায় আঘাতের পর আঘাত পড়ছে, আমার স্ত্রী আমাকে বাঁচাতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কাছে, খুব কাছেই পুলিশ নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে তাকিয়ে ঘটনাটা দেখছে, কিন্তু কিছু করছে না। সিলেটে বসে আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাটা জানতে পেরেছিলাম। অভিজিৎকে হাসপাতালে নিয়েছে জেনে দোয়া করছিলাম যেন বেঁচে যায়; কিন্তু অভিজিৎ বাঁচল না। অভিজিৎ রায় আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর অজয় রায়ের ছেলে। যারা হাসপাতালে ছিল তাদের কাছে আমাদের স্যারের খবর নিয়েছিÑ একজন বাবার কাছে তার সন্তানের মৃত্যু সংবাদ থেকে কঠিন সংবাদ আর কী হতে পারে? আমাদের পদার্থ বিজ্ঞানের স্যার প্রফেসর অজয় রায় এই ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে তাঁর বুকের ভেতরের উথালপাথাল হাহাকারকে ঢেকে রেখে যে অসাধারণ মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সন্তানের মৃত্যু সংবাদ গ্রহণ করেছেন, প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলেছেন, গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন, তার কোন তুলনা নেই। আমরা তাঁর ছাত্রছাত্রীরা যদি তাঁর ভেতরকার শক্তির একটা ক্ষুদ্র অংশও আমাদের জীবনের কোথাও ব্যবহার করতে পারি তাহলে নিজেদের ধন্য মনে করব। আমি আসলে ফেসবুক, নেট, ব্লগের সঙ্গে পরিচিত নই। আমি জানি, সারা পৃথিবীতেই এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তারপরও আমি শুধু বইপত্র ছাপা খবরের কাগজ দিয়েই দুনিয়ার খবর রাখি। সে কারণে আমি অভিজিৎ রায়ের ব্লগজগতের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না, আমি শুধু তাঁর বইয়ের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। আমি আমার নিজের লেখায় তাঁর বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি। আমার খুব আনন্দ হতো যখন আমি দেখতাম একজন তরুণ ইঞ্জিনিয়ার কী সুন্দর ঝরঝরে বাংলায় লেখে, কী সুন্দর বিশ্লেষণ করে, কত খাটাখাটুনি করে একটা বিষয়কে যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে। আমি জানতাম না, ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাঁকে এভাবে টার্গেট করেছে। ধর্মান্ধ জঙ্গীগোষ্ঠীর তালিকায় আমাদের অনেকেরই নাম আছে, আমরা ধরেই নিয়েছি এই দেশে এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। কিন্তু সত্যি সত্যি যে তারা অভিজিৎকে এভাবে হত্যা করার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। স্বজন হারানোর এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি? শনিবার দুপুরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে একটি মানববন্ধন, মৌন মিছিল শেষে আমাদের লাইব্রেরির সামনে জমায়েত হয়েছিল। ছাত্র-শিক্ষক নিজেদের ক্ষোভের কথা বলেছে, দুঃখের কথা বলেছে, হতাশার কথা বলেছে, অভিজিতের জন্য গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসার কথা বলেছে। সমাবেশের শেষে তারা আমার হাতেও মাইক্রোফোন দিয়ে তাদের জন্য কিছু বলতে বলেছে। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। তরুণ শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে আমি শেষ পর্যন্ত সব সময় যে কথাগুলো বলি তাই বলেছি। এই দেশের ভাবনা-চিন্তার জগতের দায়িত্বটি এখন এই তরুণদেরই নিতে হবে। বলেছি, তাদের দুঃখ পাবার কারণ আছে, তাদের ক্রুদ্ধ হবার কারণ আছে। কিন্তু যত কারণই থাকুক তাদের হতাশাগ্রস্ত হলে চলবে না। অন্ধকার জগতের যে মানুষগুলো পেছন থেকে এসে একজনকে হত্যা করে আনন্দে উল্লসিত হয়ে যায়, তারা কোন্্ বিষয়টাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় আমরা এখন সেটা জানি। তারা ভয় পায় বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী চিন্তা, তারা ভয় পায় উদারমনের মানুষ, তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মুক্তচিন্তা। আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধ করেছি, তারা যেন অভিজিতের সম্মানে আর ভালবাসায় আধুনিক পৃথিবীর উপযোগী মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। সরকার অভিজিতের হত্যাকারীদের ধরতে পারবে কী না জানি না। যদি ধরতে পারে, এই দেশের আইনে শাস্তি দিলেই কী যে বিষবৃক্ষ এই দেশে জন্ম নিয়েছে তার শিকড় উৎপাটিত হবে? সারা পৃথিবীতে ধর্মান্ধ মানুষের যে নৃশংসতা শুরু হয়েছে আমাদের দেশেও কী তার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেনি? আমরা কী সেই অন্ধকার শক্তিকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছি? অভিজিতের বাবা, আমার শিক্ষক প্রফেসর অজয় রায় তাঁর সন্তানের মৃত্যুর পর যে কথাটি বলেছেন, আমাদের সবারই এখন কী সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করার সময় আসেনি? ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়ে যে বাংলাদেশ তৈরি করেছিল আমরা সেই বাংলাদেশকে ফিরে পেতে চাই। এই বাংলাদেশ আমাদের সেই ত্রিশ লাখ মানুষের, তাদের আপনজনের। এই দেশ অভিজিতের, এই দেশ অভিজিতের আপনজনের। এই দেশ জঙ্গীদের নয়, এই দেশ ধর্মান্ধ কাপুরুষের নয়। খুব দুঃখের সময় আপনজনরা একে অন্যের হাত ধরে নিজেদের ভেতর সান্ত¡না খুঁজে পায়, সাহস খুঁজে পায়। অভিজিতের আহত স্ত্রী, তাঁর কন্যা, তাঁর বাবা, মা, ভাইবোনকে বলতে চাই, আপনাদের পাশে আমরা আছি। একজন দুইজন নয়, বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ। আপনারা হয়ত আমাদের দেখছেন না, কিন্তু আমরা আছি। আপনাদের পাশে আছি। পাশে থাকব। ২৮-২-১৫
×