ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কিলিং মিশনে জঙ্গীরা ॥ ওদের দমনে বিশেষ কর্মসূচী প্রয়োজন;###;মদদ দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত;###;বৈশ্বিক পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের আইএসআই;###;ব্লগার অভিজিৎ হত্যাকা- জ্বলন্ত প্রমাণ

ক্রাশ প্রোগ্রাম চাই

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১ মার্চ ২০১৫

ক্রাশ প্রোগ্রাম চাই

শংকর কুমার দে ॥ দেশের জঙ্গী সংগঠন ও জঙ্গী তৎপরতার পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতা বিএনপি-জামায়াত জোট। আর বিএনপি-জামায়াত জোটসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না এমন উগ্র মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠন ও সংগঠকদের নেপথ্য থেকে মদদ দিয়ে চলেছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও পাকিস্তান। অবরোধ-হরতালের নামে পেট্রোল বোমার নাশকতার আড়ালে ফের জঙ্গীদের সংগঠিত করে ভয়ঙ্কর হত্যাকা-ের ছক কষে তৎপরতা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছে তারাই। কিলিং মিশন নিয়ে মাঠে নেমে এ্যাকশনে চলে গেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীর, জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাত-উল জিহাদ (হুজি), আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ জঙ্গী সংগঠনগুলোর হাজারো জিহাদী সদস্য। লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের পুলিশের নাকের ডগায় নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনা সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এখনই জঙ্গী দমনে ও জঙ্গী সংগঠনগুলোর তৎপরতা, মদদদাতা, উস্কানিদাতা, অর্থযোগানদাতাদের বিরুদ্ধে ক্রাশ প্রোগ্রাম নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট যে জঙ্গী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতা সেই সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা উদাহরণ টেনে বলেছেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের লিফলেটসহ রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী লেখা সংবলিত রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খানের ছেলে রিসাদ কামাল খান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর আপন ভাই পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়া আরেক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) অন্যতম সংগঠক মাওলানা তাইজউদ্দিন। এই মাওলানা তাইজউদ্দিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা থাকাকালে তাঁকে হত্যার চেষ্টায় ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে যে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল সেই মামলারও অন্যতম আসামি। যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের প্রতিবাদে রাজধানীর শাহবাগে সৃষ্ট গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে রাজধানীর পল্লবীর নিজ বাসার সামনে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়েই আত্মপ্রকাশ করে প্রকাশ্যে আসা জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালায় এবং এই জঙ্গী সংগঠনটির সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইকে (বাংলা ভাই, ইংরেজী ভাই বলতে কিছু নেই) মিডিয়ার সৃষ্টি আখ্যায়িত করে আলোচিত হয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী। এক কথায় ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গী গোষ্ঠীর শিকড় অনেক গভীরে গজিয়ে যাওয়ার পর দেশব্যাপী ডালপালা ছড়িয়ে ব্যাপক আকারে বিস্তৃত হয়ে প্রকাশ্যে এসে তৎপরতায় যুক্ত হয় গ্রেনেড-বোমা, গুলি, খুন ও নাশকতার ভয়ঙ্কর থাবা। সেই থাবার আরেক নির্মম শিকার হয়েছে লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়। পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার বার বারই জঙ্গীবিরোধী অভিযান জোরদার করে অব্যাহত রাখার মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর কতিপয় কর্মকর্তার অসতা ও অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে আইনের ফাঁক ফোকর গলিয়ে অনেক জঙ্গী সদস্য গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও নাশকতা চালাচ্ছে, হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। জঙ্গী কায়দায় চোরাগোপ্তা হামলা করে পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা, একই কায়দায় নির্মমভাবে একের পর এক কুপিয়ে লেখক, শিক্ষক, ব্লগার, বুদ্ধিজীবীসহ প্রগতিশীলদের হত্যা করে গ্রেফতার হয়েও জামিনে মুক্ত হওয়া এবং গ্রেফতার এড়িয়ে আত্মগোপনে গিয়ে বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। রাজনীতির নামে আন্দোলনের মাঠে এনে উগ্র মৌলবাদী দল ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে জঙ্গী সংগঠনগুলোকে যুক্ত করে গোটা দেশকে জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও বিদেশী প্রভাবশালী শক্তির জোরে পার পেয়ে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট। বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধ-হরতালের নাশকতায় জঙ্গীবাদ ছড়ানোর প্রশ্রয় ও সহায়তা করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও পাকিস্তানের বড় ভূমিকা এক কূটনীতিক মোঃ মাজাহার খান পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তদ্বির করে ছাড়িয়ে নেয়ার পর বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ তৎপরতায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে প্রত্যাহার করে নিয়েছে পাকিস্তান। বিগত ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের প্রত্যক্ষ মদদে ২০০২ সালের ডিসেম্বরে আত্মপ্রকাশ করে হিযবুত তাহরীর। আর ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে রীতিমতো এক গোলটেবিল বৈঠক করে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনটি বাংলাদেশে কার্যক্রম চালুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে হিযবুত তাহ্রীরের কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রকাশ্যে এবং নিষিদ্ধ হওয়ার পর আজ পর্যন্ত তারা মাঝে মধ্যেই প্রকাশ্যে তৎপরতা চালায়। আবার নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই জঙ্গী সংগঠনটি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামেও সংগঠিত হতে থাকে। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত। সংগঠনের সদস্যরা ৪ থেকে ৫ জনের একেকটি দলে বিভক্ত হয়ে সিøপার সেল পদ্ধতিতে কার্যক্রম চালাতে থাকে। যাতে একটি দল ধরা পড়লেও আরেকটি দল সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ না পায়। সর্ববিধান বাতিল করে তারা ইসলামী শাসন কায়েমের পক্ষে। এমন আদর্শের কারণে স্বাধীনতা বিরোধীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নানাভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। স্বাধীনতা বিরোধীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবি, হিযবুত তাহরীর ও হুজি জঙ্গীদের দিয়ে দেশে গুপ্তহত্যা চালিয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্র তৈরি করতে চায়। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ব্যাপকহারে তৎপরতা শুরু করেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে। রাজশাহী ও টাঙ্গাইলেও সীমিত পরিসরে তাদের তৎপরতা আছে। সারাদেশ থেকে গ্রেফতারকৃত ৩ শতাধিক হিযবুত তাহরীর সদস্যের মধ্যে ২ শতাধিক জামিনে মুক্ত হয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা গোপন তৎপরতার জন্য সাধারণত বেছে নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠচক্রগুলোর মতো গোপন স্থানগুলোকে। হিযবুত তাহরীর সৃষ্টির পর থেকেই নানাভাবে সহায়তা করে আসছে জামায়াত-শিবির। ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা, বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে পরিচালিত এনজিও এ্যাকশন এইডের পলিসি এ্যানালিস্ট শেখ তৌফিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ, কাজী মোরশেদুল হক, প্রিন্সিপাল মাওলানা মামুনুর রশীদ, অধ্যাপক মুস্তফা মিনহাজসহ ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে তৎপরতা শুরু করে। হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ ঘোষিত করার পর তারা মিশে একাকার হয়ে যায় আনসারুল্লাহ বাংলাটিমে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেছেন, জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বিস্ফোরক ভর্তি চালকবিহীন ড্রোন দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যার মিশন বাস্তবায়নে এখন মরিয়া। তাদের প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা ও গণভবন। ড্রোন দিয়ে গণভবনে হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল। গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন এলাকা থেকে কোয়াড হেলিকপ্টার বা ড্রোনের কাঠের তৈরি একটি রেপ্লিকা, ড্রোন তৈরির সরঞ্জাম, বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও উগ্রমতবাদ সংবলিত বইপত্রসহ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য মোঃ তানজিল হোসেন বাবু ও মোঃ গোলাম মাওলা মোহনকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। বিশেষ করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ড্রোন দিয়ে ২৫ থেকে ৩০ তলা উঁচু ভবনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে ২৫ থেকে ৩০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক বহনে সক্ষম একটি চালকবিহীন ড্রোন তৈরির দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছে গিয়েছিল। বিস্ফোরক ভর্তি ড্রোনটি আকাশপথ দিয়ে দূর নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র দ্বারা গণভবনে হামলা চালানোর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনাও ছিল জঙ্গীদের। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ের সিংহভাগ আসার কথা ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছ থেকে। ৫ জানুয়ারি বিএনপি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার যে ঘোষণা দিয়েছে তা মাথায় রেখেই এখন কাজ করে চলেছে জঙ্গীরা। পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর সঙ্গে হরকাত-উল জিহাদও (হুজি) একই ভাবে হত্যার চেষ্টার টার্গ্টে করে চলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। হুজির প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটনানোর জন্য ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে রাখা, ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা-সহ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অন্তত এক ডজন বার হামলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহর-সহ বিভিন্নস্থানে। আওয়ামী লীগের সরকার ও তার নেতা-নেত্রীদের মুরতাদ ঘোষনা, ভারতের দালাল ইত্যাদি আখ্যায়িত করে বিভিন্ন সময়ে যে হামলা ও আক্রমণ করা হয়েছে তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে জঙ্গীরা। আর এসব জঙ্গীদেরকে মদদ দিয়ে চলেছে পাকিস্তান। আশির দশকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করার জন্য তালেবানদের হয়ে আল-কায়েদা জঙ্গী সংগঠনে নাম লেখান হরকাত-উল জিহাদ (হুজি) প্রধান মুফতি আবদুল হান্নান। আফগান ফেরত জঙ্গীরাই বাংলাদেশে এসে জঙ্গী গোষ্ঠীর ভিত্তি স্থাপন করে তৎপরতা শুরু করে গোপনে, যা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে তার শিকড় অনেক গভীরে গজিয়ে ডাল পালা মেলে ব্যাপক আকারে বিস্তার লাভ করে। তবে তখনও কেবলমাত্র হুজি ছাড়া অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনগুলোর নাম পরিচয় তৎপরতার পুরোপুরি পরিচয় পায়নি গোয়েন্দারা। হুজি দমন করার পর আত্মপ্রকাশ করে জেএমবি। আবার জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান-সহ ৬ জনকে আদালতের রায়ের পর ফাঁসি দেয়ার পর সামনে আসে হিযবুত তাহরীর। হিযবুত তাহরীর প্রধান-সহ অন্যদেরকে গ্রেফতার করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় আত্মপ্রকাশ করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-সহ অন্তত অর্ধ শতাধিক জঙ্গী সংগঠন ও গোষ্ঠী। এসব জঙ্গী সংগঠনের দেশীয় মদদদাতা হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট এবং তাদেরকে অর্থ, অস্ত্র, মদদ দিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তান ও তার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও তেহরিক-ই-তালেবানের অনুসারী। সংগঠনের অন্যতম আধ্যাত্মিক নেতা জসীম উদ্দিন রাহমানী কারাগারে। সংগঠনের অপারেশনাল দায়িত্বে রয়েছেন ইজাজ হোসেন। তিনি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী নাগরিক। বর্তমানে পাকিস্তানে রয়েছেন। ২০০৮ সালে সামরিক প্রশিক্ষণ ও জঙ্গী কার্যক্রমে দীক্ষিত হওয়ার জন্য তিনি পাকিস্তানে যান। পাকিস্তান যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইজাজ হোসেন জামায়েতুল মুসলিমিনের বাংলাদেশ শাখার আমির ছিলেন। এ সংগঠনটির আন্তর্র্জাতিক আমির হচ্ছেন জর্ডান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শেখ আবু ইসা আলী আররিফাই আল হাশেমী আল কোরাইশি-ই- আবু ইসা। তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বারিধারার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পাশে একটি দোতলা বাড়ি ভাড়া করে জঙ্গী কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। পরে তিনি ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে গ্রেফতার হন। জঙ্গী সংগঠনটির মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০০৮ সালে প্রথমে হিযবুত তাহরীর পরে আনসারুল্লা বাংলা টিমে যোগ দেয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তেহজীব, রেজওয়ান শরীফ, মইনউদ্দিন ইয়েমেনে চলে যান। তারা আল কায়েদা নেতা আনোয়ার আল আওলাকির ঘনিষ্ঠ সহযোগী সামির খানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইয়েমেনে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় ২০০৯ সালে রেজোয়ান শরীফ ওরফে রাজিব শরীফ গ্রেফতার হন। রাজীব শরীফ ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্স উড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টাকালে গ্রেফতার হয়ে ২০ বছরের কারাদ-ে দ-িত হন। আর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার হয়ে সম্প্রতি আরেক ছাত্র নাফিজ ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আটক আছে যুক্তরাষ্ট্রের কারগারে। জঙ্গীদের গোড়াপত্তন ॥ গোয়েন্দা সংস্থার রেকর্ড থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে জঙ্গীদের গোড়পত্তন হওয়ার ঘটনা ফাঁস হয় ১৯৮৮ সালের দিকে। তখন আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পাকিস্তানে নিহত ওসামা বিন লাদেন, শীর্ষ স্থানীয় নেতা মোল্লা ওমর ও বর্তমান আল কায়েদার প্রধান আইমান আল জাওয়াহিরির সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে এসেছিল আফগানিস্তানের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশের ১০ জঙ্গী নেতা। আফগানিস্তানে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৪০ জনের এক জঙ্গী গ্রুপ পাকিস্তান হয়ে তখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আফগান যুদ্ধ ফেরত জঙ্গীরা বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন জঙ্গী গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ক্ষমতার লোভের টোপে পড়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন সময়ে বোমাবাজি ও গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে। ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের একটি জঙ্গী প্রতিনিধি দল পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সফর করে। এই সফরকারী দলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদের (হুজি) নেতা শেখ ফরিদ, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, মাওলানা আবদুস সালাম, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি হুজির একাংশের প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল। আফগানিস্তানে সফরকালে এই প্রতিনিধি দলটির নেতাদের সঙ্গে আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা হয় এবং বাংলাদেশের আল কায়েদার অনুকরণে জঙ্গী গ্রুপ প্রতিষ্ঠার আলোচনা হয়। মিয়ানমারের আরাকানের হুজি নেতা মাওলানা আবদুল কুদ্দুছ বার্মি, বাংলাদেশের মাওলানা আবদুস সালাম, মাওলানা আবদুল হাই আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন ও আফগান মুজাহিদদের সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যাপারে কো-অর্ডিনেটরের ভূমিকা পালন করেন। ২০১১ সালে মাওলানা শেখ ফরিদ গ্রেফতার হওয়ার পর গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তার দেয়া তথ্যে দেখা যায়, ১৯৮৮ সালে ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের উদেশে রওনা হয়। সেই বছরের ২ মার্চ বিকেল সাড়ে তিনটায় আফগানিস্তানে পৌঁছান তারা। আফগানিস্তানে যাওয়া ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন নোয়াখালীর মাওলানা হাবিবুল্লাহ মেজবা, ঢাকার শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, মোহাম্মদপুরের মুফতি নসরুল হক, মাওলানা আজিমউদ্দিন, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, চট্রগ্রামের মাওলানা সুলতান জৌক, মাওলানা মনসুর, কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতাউর রহমান খান, ফরিদপুরের মাওলানা আবদুল মান্নান, সিলেটের মাওলানা হাবিবুর রহমান খান। আফগান ফেরত ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের কয়েকজন ইতোমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন, কয়েকজন মারা গেছেন ও আত্মগোপনে চলে গেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, তখন যারা গ্রেফতার হয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়, ১৯৮৮ সালের ৫ মার্চ সকাল ৯টার দিকে তারা আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসে পাকিস্তানে। সেই বছরের ১২ মার্চ তারা ঢাকায় চলে আসে। আফগানিস্তানের সাত্তাহ নামক এলাকায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলটির সঙ্গে আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাত হয়। আফগানিস্তানে অবস্থানরত আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলটিকে জেহাদের বিভিন্ন ধরন, প্রশিক্ষন, অত্যাধুনিক রাইফেল একে-৪৭সহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দেন। আফগান যুদ্ধে রাশিয়া পিছু হইলে ক্ষমতার দখল নিয়ে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ হওয়ার সময়ে পাকিস্তান থেকে একাধিকবার আফগানিস্তানে যাতায়াত করেন মাওলানা শেখ ফরিদ। বাংলাদেশ থেকে যারা আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তখন গিয়েছিল তারা কখনও ৩ মাস, কখনও ৬ মাস, কখনও ১ বছর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্নস্থানে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে আল কায়েদা যখন হামলা চালায় তখন মাওলানা শেখ ফরিদ আফগানিস্তানেই অবস্থান করছিলেন। বহুজাতিক বাহিনী যখন আফগানিস্তানে একযোগে হামলা চালায় তখন শেখ ফরিদসহ অন্যরা আফগান মুজাহিদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়। বহুজাতিক বাহিনীর ব্যাপক হামলার মুখে আফগানিস্তানের একের পর এক শহরের পতন ঘটতে থাকলে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমর ও বর্তমান প্রধান আইমান আল জাওয়াহিরি নিরাপত্তার জন্য একের পর এক স্থান বদলাতে থাকেন। তারাও আফগান যুদ্ধের পর পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। বাংলাদেশে এসে তারা হরকাত-উল-জিহাদ(হুজি) নামে জঙ্গী সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৯৮ সালে হুজির মধ্যে জিহাদ ও নেতৃত্বের প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা দেয়। এর মধ্যে জঙ্গী সংগঠন হুজি তিন ভাগ হয়ে যায়। আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুজাহিদরাও বিভক্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি হুজি প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে হুজির একাংশ। বিএনপি-জামায়াত জোট রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করে আফগান ফেরত মুজাহিদ ও তাদের নেতৃত্বাধীন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীদের। দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা, আউলিয়ার মাঝার, গীর্জা, সিনেমা হল, রমনা বটমূল, সিপিবির সমাবেশ, ব্রিটিশ হাইকমিশনারসহ বিভিন্নস্থানে ও ব্যক্তিদের ওপর গ্রেনেড-বোমা হামলা চালায় তারা। এমনকি আফগান ফেরত যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেয়া নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংঠন হরকাত-উল-জিহাদ (হুজি) প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে জঙ্গীরা গোপালগঞ্জে বোমা পুতে রাখা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করেছে প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক সৈয়দ বজলুল করিম জানিয়েছেন, বর্তমান আল কায়েদার প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির ইউটিউবে ছাড়া কথিত একটি অডিও-বার্তায় বাংলাদেশের মুসলমানদের প্রতি ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারীদের প্রতিরোধের যে আহ্বান জানানো হয়েছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের বিএনপি-জামায়াত জোটের ব্যবহার করা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন ও উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠির সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি অস্বাভবিক কিছু নয়। যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচাল ও রায় ঘোষণার প্রতিবাদে জামায়াতÑশিবিরের নেতৃত্বে বিদেশে যে তাদের লবিস্ট নিয়োগ করা আছে তারা যেভাবে পশ্চিমা গনমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত সংবাদ প্রকাশ করে চলেছে তার সঙ্গে আয়মান আল জাওয়াহিরির বার্তায় বাংলাদেশকে ‘বিরাট এক জেলখানা’, ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র’, নানাভাবে আখ্যায়িত করার ঘটনার সঙ্গে সাদৃশ্য দেখা যায়। এখন আবার বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা অবরোধ-হরতালের নামে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা আর তা লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকা- একই সূত্রে গাঁথা। প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার যে ছক কষা হয়েছে, তা স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানী ও তাদের প্রেতাত্মা উগ্র মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠীরই। এখনই, উগ্র মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠী ও তাদের মদদদাতাদের দমনে ক্রাশ প্রোগ্রাম নেয়া প্রয়োজন।
×