ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল মান্নান

‘হায়রে হায়রে কান্না জিয়ার কোলে মান্না’!

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ১ মার্চ ২০১৫

‘হায়রে হায়রে কান্না জিয়ার কোলে মান্না’!

একুশে বইমেলার একেবারে শেষ বেলায় এসে টিএসসি চত্বরে আবার রক্ত ঝরল এবং একজনের প্রাণ গেল। অভিজিৎ রায় সপরিবারে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ঢাকায় এসেছিলেন মেলায় তাঁর দুটি বই প্রকাশ উপলক্ষে। অভিজিৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক সকলের প্রিয় ড. অজয় রায়ের ছেলে। অভিজিৎ নিজেও এক সময় বুয়েটের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী পেশায় ডাক্তার। পুরো পরিবারটিই প্রগতিশীল। অভিজিৎ একজন ব্লগারও ছিলেন। ‘মুক্তমনা’ নামে তাঁর একটি ব্লগ আছে। নিয়মিত তিনি সেখানে মৌলবাদ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লিখতেন। খবরটা শোনার পর আমার এক গুরুজন ফোন করে জানতে চান, অভিজিৎ কী নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নার দু’একজন লাশের প্রথম জন? তাঁকে সঠিক কোন উত্তর দিতে পারিনি। বললাম, হতেও পারে। এখন তো আবার লাশ ফেলার কাজটি আউটসোর্স করা যায়। গভীর রাতে আনসারউল্লাহ বাংলাটিম-৭ নামক একটি মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অভিজিৎকে হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। দেশে এখন এই রকম অনেক কিলিং টিম সক্রিয়। যে কোন সময় যে কেউ হয়ে যেতে পারেন কোন একটা টিমের টার্গেট। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নিন্দিত, আলোচিত ও ব্যাপক সমালোচিত ব্যক্তিটির নাম হচ্ছে নাগরিক ঐক্য নামক সংগঠনের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। একসময় মনে করা হতো জাসদের অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্য পুরুষ সিরাজুল আলম খান ছিলেন এ দেশের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অন্যতম উদ্ভাবক। সম্প্রতি মান্নার সার্বিক কর্মকা-কে বিচার বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাণ্ড মান্না তার যোগ্য উত্তরসূরি হতে পেরেছেন। একদা মান্না সিরাজুল আলম খানের খাদেম ছিলেন। সিরাজুল আলম খান বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মান্নার রাজনীতির হাতেখড়ি ইসলামী ছাত্রসংঘে। কলেজ ও স্কুল জীবনে তিনি ছাত্র সংঘের রাজনীতির সঙ্গে একজন কর্মী বা সদস্য হিসেবে জড়িত ছিলেন। অন্য ছাত্র সংগঠনের চেয়ে ছাত্রসংঘ বা বর্তমানের ছাত্রশিবিরের পার্থক্য হচ্ছে তারা কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের অল্প বয়সেই রিক্রুট করা শুরু করে। স্কুলের বাচ্চাদের মাঝে ভিন্ন নামে তারা নানা ধরনের কর্মকা- পরিচালনা করে থাকে। বর্তমানে স্কুল লেভেলে তাদের ‘ফুলকুড়ি’ বেশ সক্রিয়। অনেকটা ‘খেলাঘর’ অথবা অধুনালুপ্ত ‘মুকুল ফৌজের’ আদলে কাজ করে। স্কুল কলেজ জীবনে মান্নাকেও এই ভাবে ছাত্রসংঘ তাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করে। স্কুল জীবন হতেই তার বাচনভঙ্গি ছিল ভাল। যুক্তি দিয়ে বক্তৃতা করতে বেশ পারদর্শী। আবৃত্তিও ভাল করত। ঢাকা কলেজে পড়াকালে ছাত্রসংঘের অনেক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করে বাহবা পেয়েছিল বলে তার কয়েকজন সতীর্থ জানিয়েছে। ১৯৬৮ সালে এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। তবে ঢাকা ছেড়ে কেন চট্টগ্রাম গিয়েছিল মান্না তা জানা যায়নি। তখনও কিন্তু কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চালু হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রাম বেতার থেকে পাকিস্তানের পক্ষে দু’একবার কবিতা আবৃত্তি করেছে বলে জানা যায়। ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগ বিভক্ত হয় ‘মুজিববাদী’ ছাত্রলীগ আর ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ ছাত্রলীগে। অন্য আরও অনেকের মতো মান্না শামিল হয়েছিল ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ পতাকা তলে। পরবর্তীকালে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে’ মূলমন্ত্র হিসেবে ধারণ করে গঠন করা হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, জাসদ। প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনু, মেজর (অব) জলিল প্রমুখ। সেই আমলে অনেক মেধাবী তরুণ সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল। বলা হতো, যৌবনে যে সমাজতন্ত্রী হয়নি তার জীবনটাই ষোলআনা বৃথা। ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের’ পতাকাতলে মেধাবীরা ছাড়াও সমবেত হয়েছিল ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীরা। কারণ তখন ছাত্রসংঘের কর্মকা- বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল। ‘জাসদ’ বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের প্রধান শত্রু ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাংলাদেশে রাজনীতির পচনটা শুরু করে জাসদ আর তার গুরু ছিলেন সিরাজুল আলম খান গং। শক্তি আর শারীরিক সামর্থ্যে কুলালে তিনি এবং তার বর্তমান সাগরেদরা এখনও আওয়ামী লীগ বধ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন। সেই থেকে দেশটা দু’ভাগে বিভক্ত। একদিকে আওয়ামী লীগ আর অন্যদিকে অন্যরা, যাদের মধ্যে জামায়াত-বিএনপি তো আছেই, আরও আছে সিপিবি, বাসদসহ আরও অনেক হোন্ডা পার্টি। আরও আছে ছদ্মাবরণে সুজন সখী পার্টি, উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ, শত নাগরিক সমাজ, নাগরিক ঐক্য। এরা সকলে সুশীল সমাজের অংশ বলে নিজেদের দাবি করেন। সিপিবি, বাসদ বলে তারা আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করে কিন্তু জনগণের কাছে তাদের সেই আদর্শের তেমন কোন আবেদন নেই। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা সিপিবিকে ১৫টি আসন ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারা বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল কম পক্ষে সত্তরটি আসনে। শেখ হাসিনার মনোনীত আসনে সিপিবি নির্বাচন করে নৌকা মার্কা নিয়ে তিনটিতে বিজয় লাভ করে। বিদ্রোহী প্রার্থীরা নিজেদের দলের কাস্তে হাতুড়ি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতেই জামানত হারায়। পক্ষান্তরে ক্ষতি করে আওয়ামী লীগের। এছাড়াও আছে জাতীয় পার্টি। তারা কখন কোন্ দিকে ছাতা ধরেন বোঝা মুস্কিল। মান্নার বড় ভাই দৈনিক ইনকিলাবের একজন নিয়মিত কলামিস্ট ও সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে জড়িত। মাহমুদুর রহমান মান্না ১৯৭২-৭৩ সালের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের প্যানেল হতে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। বলা হয়, তার বিজয়ের পিছনে ছাত্রসংঘের সর্বাত্মক সমর্থন কাজ করেছিল। নিষিদ্ধ ঘোষিত থাকার কারণে তারা নিজেদের ব্যানারে নির্বাচন করতে পারেনি। সমর্থন দিয়েছিল মান্নাকে। তার প্যানেল হতে সে ছাড়া অন্য কেউ বিজয় লাভ করতে পারেনি। ২৬টি পদের মধ্যে ২৫টি পদে বিজয় লাভ করে ছাত্র ইউনিয়ন। বিপুল ভোটে সহ-সভাপতি পদে বিজয় লাভ করেন শামসুজ্জামান হিরা। আর ছাত্রলীগের এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী (সাবেক মেয়র) আর বাসুদেব প্যানেলের শোচনীয় পরাজয় ঘটে । মান্না চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাগ্যবান মান্না দু’বার ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথমবার ১৯৭৯-৮০ সালে আর দ্বিতীয়বার ১৯৮০-৮১ সালে। তার নির্বাচিত হওয়ার পিছনে যেমন কাজ করেছে তার সংগঠনিক দক্ষতা, তেমন কাজ করেছে তার বাগ্মিতা। সেই মান্না এক সময় জিয়ার কাছে বিক্রি হয়ে গেলেন। ১৯৭৯ সালের ৯ মে অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। ১৯টি আসনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থী মান্না-আখতার (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা) পায় ১৫টি আসন আর মুজিববাদী ওবায়দুল কাদের-রবিউল পর্ষদ মাত্র ৪টি। এই ৪ জন ছিলেন মঞ্জুর কাদের কোরায়েশী, কামাল শরীফ, এনায়েতউল্লাহ আর জাফর ওয়াজেদ। এরই মধ্যে জিয়া ক্ষমতা দখল করে বনে যান বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর। আসতে চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে। ছাত্রদের তীব্র প্রতিবাদ আর ইটের আঘাত খেয়ে জিয়া টিএসসি’র মোড় হতে ফিরে যেতে বাধ্য হন। জিয়া ছিলেন ধুরন্ধর চালাক। বঙ্গভবনে তিনি ইফতারের দাওয়াত দেন ডাকসুর সদস্যদের। এই দাওয়াতে মান্না-আখতার যেতে রাজি হলেও বাকি চারজন সাফ জানিয়ে দেন, রাজাকার শাহ আজিজ থাকলে তারা যাবেন না। এই ৪ জনের চাপাচাপিতে মান্না-আখতারও তা মেনে নেয়। বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে চারজন প্রস্তাব করে সকলে সম্মিলিতভাবে চ্যান্সেলরের কাছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করবে। মান্নারা রাজি হয় না। চারজন তাদের দাবিতে অনড় থাকেন। মান্নারা বিশ্ববিদ্যালয় বহির্ভূত কর্নেল তাহের হত্যার বিচারের দাবির পাল্টা প্রস্তাব তোলে। জাতির জনক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর ছিলেন। মান্নারা বঙ্গভবনে গিয়ে ঠিকই জিয়ার কাছে কর্নেল তাহের হত্যার বিচার চায়, বঙ্গবন্ধুর নয়। লাইনের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো চারজন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত যুবক। বুকে ঝুলছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির ব্যাজ। জিয়া কাছে আসলে তার কাছে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করে। বলে তা না হলে দেশে ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে না। জিয়া বিরক্ত হয়ে ফিরে যান। মান্নারা সেদিন একযোগে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাইলে পরিস্থিতি ভিন্ন কিছু হতে পারত। জিয়া মান্নাকে অদূরে ডেকে নিয়ে মিনিট পাঁচেক কথা বলেন। ক’দিন পরে ক্যাম্পাসে রটে যায় মান্না ১০০টি রিক্সার লাইসেন্স পেয়েছে। ক্যাম্পাসে সেøাগান তুলে- ‘হায়রে হায়রে কান্না, জিয়ার কোলে মান্না।’ মূলত তখন হতেই মান্নার বড় ধরনের পদস্খলন শুরু। ঘটনা আরও আছে। সত্তরের দশকের শেষের দিকে ঢাকা হতে প্রকাশিত হতো ইব্রাহিম রহমানের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘জনকথা’। তিনি আবার মালিকও। কিন্তু পত্রিকা ছাপা হওয়ার আগেরদিন তাঁকে একটা চেক দিতেন আওয়ামী লীগের দুর্দিনের সভাপতি আমেনা বেগম। সবাই জানত ‘জনকথা’ আমেনা বেগমের টাকায় চলে। পত্রিকা ছাপা হওয়ার আগের দিন সম্পাদক আমেনা বেগমের কাছ হতে চেক পেতেন। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে, দলের হাল ধরার মতো কেউ নেই, তখন আমেনা বেগম হাল ধরেছিলেন। তাঁর তেমন কোন অর্থ-বিত্ত ছিল না। কোন একটি জনসভায় যাওয়ার আগে তিনি বেগম মুজিবের শাড়ি পরে যেতেন। সেই আমেনা বেগম কোথা হতে টাকা পান একটি সাপ্তাহিকের প্রকাশনায় সাহায্য করার জন্য? ১৫ আগস্টের পর আমেনা বেগম প্রচণ্ড বঙ্গবন্ধুবিরোধী হয়ে এই হত্যাকা-কে সমর্থন করেছিলেন। ১৯৮০ সালে মান্না দ্বিতীয় দফা ডাকসুর সহ-সভাপতি থাকা অবস্থায় অন্য আরও অনেকের সঙ্গে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে জাসদ ছাত্রলীগ বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের কাছ থেকে বিতাড়িত হন। গঠন করেন বাসদ। বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে জনসভা করলেন মান্না। আমেনা বেগম ইব্রাহিমকে নির্দেশ দিলেন পত্রিকা মান্নার জনসভার পর ছাপতে এবং ঐ সংখ্যায় মান্নার জনসভা ব্যানার লিড হবে কারণ ফারুক তাই চান। কে এই ফারুক? পাঠকের যদি বুঝতে অসুবিধা হয়ে থাকে তবে মনে করিয়ে দেই- এই ফারুক হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হত্যাকারী কর্নেল (অব.) ফারুক রহমান, যার মৃত্যুদ- ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে। ফারুকের চেকটাই আমেনা বেগমের হাত ঘুরে ‘জনকথা’র সম্পাদকের কাছে আসত। ফারুকের সঙ্গে মান্নার কী সম্পর্ক? আমেনা বেগম বেঁচে থাকলে বলতে পারতেন। আর বলতে পারবেন মান্না নিজে, যদি তিনি বলতে চান। মান্না পরে বাসদকে ভেঙ্গে দু’টুকরা করে তা থেকে বের হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মাঝখানে আবার জনতামুক্তি পার্টি নামে আর একটি হোন্ডা পার্টির জন্ম দিয়েছিলেন। সেই মান্না হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। আওয়ামী লীগ কখনও তার মিত্র আর শত্রুদের সঠিকভাবে চিনতে পারে না এবং এর জন্য সব সময় তাদের চড়া মূল্য দিতে হয়। মান্নার সঙ্গে নিউইয়র্কে চিকিৎসারত বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা আর অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী এক অজ্ঞাত ব্যক্তির সঙ্গে টেলিফোন আলাপ নিয়ে দেশে এখন তুলকালাম হচ্ছে। এর সপ্তাহ দু’এক আগে ভিয়েনাপ্রবাসী জনৈক সেফায়তুল্লাহর সঙ্গে আর একটি টেলিফোন আলাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। সেখানে সেফায়েতুল্লাহ মান্নাকে বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত হয়ে যেতে। দু’একদিনের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে। এই সেফায়েতুল্লাহর আদি নিবাস কুমিল্লা। লেখাপড়া করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মান্না সেই যাত্রায় একটু সতর্ক ছিলেন, কারণ ফোনটা সাধারণ ফোনে করা হয়েছিল। শুধু বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে। পরে যেন ভাইবারে ফোন করেন, কারণ তাঁর ফোন যদি টেপ করা হয় তা হলে তাকে জেলে যেতে হবে।’ আজকাল ভাইবার বা কোন কিছুই আর গোপন বা নিরাপদ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত নিজ দেশের সাড়ে চার কোটি মানুষের ফোন টেপ করা হয়। প্রয়োজনে সকলের সকল যোগাযোগ মাধ্যম টেপ করা হতে পারে। তারা বলে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তারা এটা করে। বছর দু’এক আগে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মের্কেলের ফোনও টেপ করেছিল। এতে দু’দেশের স্বাভাবিক সম্পর্কের অবনতি হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। মান্নার পরের দুটি ফোনালাপ নিশ্চিতভাবে দেশের বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস। একটিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ষড়যন্ত্র। অন্যটিতে দেশে বেগম জিয়া ঘোষিত চলমান যুদ্ধে নাগরিক ঐক্য ও সুশীল সমাজের সম্পৃক্ততা। তার জন্য বিএনপি থেকে বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেন। তার সঙ্গে আছে বিএনপি থেকে এসে তার জনসভাস্থল পূর্ণ করা। অথচ এই মান্নার পিছনে দেশের কিছু মেরুদ-হীন ব্যক্তি যারা নিজেদের সুশীল বা উদ্বিগ্ন নাগরিক বলে পরিচয় দেন, তারা সারিবদ্ধ হয়েছেন দেশ উদ্ধার করে তা বেগম জিয়ার হাতে তুলে দিতে। এই মেরুদ-হীন ব্যক্তিদের এক এগারোর পূর্বে অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে কে চিনত? এরা প্রতিরাতে টিভিতে গিয়ে দেশের মানুষকে নসিহত করেন। মান্না ড. কামাল হোসেনের প্রীতিধন্য। যখন ফোনালাপ নিয়ে দেশে তুলকালাম চলছে তখন তিনি দেশের বাইরে। আমার এক সহকর্মী বলেন ড. কামাল যদি বাইরে থাকেন তখন লক্ষণ ভাল নয়। তিনি কেন এ কথা বললেন তা জানি না। দেশে ফিরেছেন ড. কামাল। শুক্রবার বলেছেন, এই ফোনালাপ নিয়ে তার তেমন কিছু বলার নেই। কারণ তিনি তখন দেশেও ছিলেন না। কেউ যদি মনে করেন মান্না খোকার টেলিফোনই বাংলাদেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শেষ, তাহলে তারা বড় ভুল করবেন। ধরে নিতে হবে এটি একটা সামান্য ঝলক মাত্র। ষড়যন্ত্র আরও গভীরে প্রথিত। চলবে বেগম জিয়া ক্ষমতা দখল না করা পর্যন্ত। আর কেউ যদি মনে করে থাকেন অভিজিতের লাশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শেষ লাশ, তারাও বড় ভুল করবেন। সতর্ক না হলে আরও লাশ পরবে। এই সব ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার জন্য অঢেল অর্থ দেশে আসছে। বাইরে তো বিলানো হচ্ছে দু’হাতে। এবার ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে হারাতে হলে সেই বাংলাদেশ আর ফিরে পাওয়া যাবে না। অভিজিতের আত্মার শান্তি কামনা করছি। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
×