ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চিন্তার স্বাধীনতা খুন মৌলবাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

চিন্তার স্বাধীনতা খুন মৌলবাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ

মোরসালিন মিজান ॥ আবারও আক্রমণ। আবারও মুক্তবুদ্ধির চর্চার ওপর আঘাত। এবার নামটি- অভিজিৎ রায়। অত্যন্ত মেধাবী বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগারকে বৃহস্পতিবার নির্মম নৃশংসভাবে খুন করেছে মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী। রাতে প্রাণের মেলা থেকে ফেরার পথে প্রাণ হারান মুক্তচিন্তা ব্লগের মডারেটর। তাঁর স্ত্রী লেখিকা বন্যা এখনও জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর যেভাবে আক্রমণ করা হয়, একইভাবে আক্রমণ করা হয় অভিজিতের ওপর। রাতে খবরটি প্রচার হওয়ার পর থেকেই শোকের ছায়া নেমে আসে অমর একুশে গ্রন্থমেলা, টিএসসি, শাহবাগসহ আশপাশের এলাকায়। সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করে রাতেই অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদী মিছিল সমাবেশ। আর তারপর শুক্রবার সকালে মেলার ২৭তম দিনের সূচনা। মেলায় তরুণ তাজা লেখক খুন হওয়ায় পরিবেশ ছিল ভারাক্রান্ত। একই সঙ্গে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন লেখক, পাঠক ও প্রকাশকরা। অভিজিৎ রায় হত্যার প্রতিবাদে সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমিতে সমাবেশ করে লেখক প্রকাশকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এক দশক আগের এই দিনে মৌলবাদী আক্রমণের শিকার হন হুমায়ুন আজাদ। দুই লেখকের হত্যাকারী হায়েনাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতারের দাবি জানানো হয় সমাবেশ থেকে। গ্রন্থমেলার তথ্যকেন্দ্রের সামনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেনÑ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ড. মুহাম্মদ সামাদ, আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি, অন্যপ্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ। বক্তারা বলেন, পরমতসহিষ্ণুতা বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্য। সেখান থেকে সরে এলে আমাদের বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। কারণ চিন্তার স্বাধীনতা ছাড়া সভ্যতা এগোয় না। মৌলবাদী অপশক্তি পূর্বঘোষণা দিয়ে প্রগতিশীল লেখক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছে জানিয়ে তাঁরা বলেন, এভাবে চলতে পারে না। সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখেন, আর কত প্রাণ গেলে পরে বিচার পাব আমরা? বক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হুমায়ুন আজাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার এক দশক পার হয়ে গেছে; বিচার হয়নি। এ কারণেই মৌলবাদী ঘাতকচক্র মরিয়া। এরাই অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে। এ ধরনের হত্যা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেয়ার গভীর ষড়যন্ত্র। অবিলম্বে ঘাতকদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান তাঁরা। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে সর্বস্তরের নাগরিকদের প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহ্বান জানানো হয় সমাবেশ থেকে। এর আগে প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদ এবং অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে মুষ্টিবদ্ধ হাতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। মেলা মঞ্চেও ছিল একই রকম কর্মসূচী। এদিকে ভয়কে জয় করে মেলায় এসেছিলেন হাজার হাজার বইপ্রেমী মানুষ। জনতার যেন ঢল নেমেছিল। নারী-পুরুষ শিশুসহ সব বয়সী পাঠকের উপস্থিতি যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলÑ একুশ মানে মাথানত না করা। পাঠকের মাঝে শোক ছিল। অনেকেই বিমর্ষ ছিলেন। তবে তারও বেশি ছিল প্রতিবাদ। আজকের প্রতিবাদ ॥ অভিজিৎ রায় হত্যার প্রতিবাদ ও খুনীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে আজ মেলায় বেলা ২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত বই বিক্রি বন্ধ রাখা হবে। জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির পক্ষ থেকে এই কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। একই রকম কর্মসূচী ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশে পুস্তক প্রকাশক ও বিপণন সমিতির পক্ষ থেকে। বিকেল ৪টা থেকে ৪টা ১০ মিনিট পর্যন্ত বই বিক্রি বন্ধের ঘোষণা দেন সমিতির নেতারা। নতুন বই ॥ বাংলাদেশের ফোকলোরকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করানো এবং বিশ্বের ফোকলোরের তত্ত্ব-পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশের ফোকলোরের আধুনিক চর্চা ও গবেষণা করার ক্ষেত্রে আশির দশক থেকে কাজ করে আসছে বাংলা একাডেমি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রকাশ করা হয়েছে ঋড়ষশষড়ৎব : ঘবি ঈযধষষবহমবং শীর্ষক গ্রন্থ। ফোকলোর স্থানীয় বহমান ঐতিহ্যের বিষয় হলেও এর বিষয়গত গবেষণায় তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অপরিহার্য বিশ্ব পরিম-লে স্বীকৃত। প্রকাশিত গ্রন্থটি বাংলাদেশে আধুনিক ফোকলোর চর্চাকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে আশা বইটির প্রধান সম্পাদক শামসুজ্জামান খান, সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ ও শাহিদা খাতুনের। বইটির মূল্য ১ হাজার টাকা। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন- দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান ও সাংবাদিক হাসান হাফিজ। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান। প্রাবন্ধিক বলেন, বিশ শতকের প্রায় আট দশকজুড়ে আমাদের এই পৃথিবীতে পদচারণা করেছিলেন একজন সন্তোষ গুপ্ত। তিন তিনটি পতাকার নিচে- প্রথম ২২ বছর ইউনিয়ন জ্যাক, ২৪ বছর পাকিস্তানের চাঁদ-তারা এবং জীবনের শেষ ৩২ বছর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার নিচে জীবনযাপন করেছেন। ত্রিকালদর্শী সন্তোষ গুপ্ত আয়ুর ভিখারি ছিলেন না। হাস্যমুখে অদৃষ্টকে পরিহাস করে জীবনযাপন করতে চেয়েছেন জীবনকেই অর্থবহ করে। সে জীবনযাপন শুধু নিজের জন্য বা পরিবারের জন্য নয়; মানুষ, সমাজ এবং দেশের জন্য। তিনি বলেন, বরেণ্য সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত ইতিহাসের পথ ধরে চলেছেন, আবার বার বার অংশীদার হয়েছেন ইতিহাস নির্মাণেও। ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার আলোকবর্তিকা নিয়ে সমাজ ও জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। আলোচকরা বলেন, সন্তোষ গুপ্ত বিশ্বাস করতেন যে সাংবাদিকতার জন্য অপরিহার্য হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ এবং দায়বদ্ধতা। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে দায়বদ্ধতা না থাকার ফলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটছে এবং সাংবাদিকতা তার পুরনো গৌরব হারিয়ে ফেলেছে। সমস্যাটিকে তিনি দেখতে চেয়েছেন নীতিবোধ ও নৈতিকতার চ্যালেঞ্জ হিসেবে। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান বলেন, শুধু সাংবাদিকতা নয়, সংবাদ-ভাষ্য, শিল্প-সমালোচনা, অনুবাদ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে সন্তোষ গুপ্ত তাঁর বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রেখেছেন। উত্তোর প্রজন্মের কাছে তাঁর চিন্তাকে পৌঁছে দিতে বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর রচনাবলি প্রকাশ হওয়া জরুরী। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাঙালী ফাউন্ডেশন’ এবং ‘হামিবা সাংস্কৃতিক একাডেমি’র পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী ইফফাত আরা নার্গিস, নাশিদ কামাল, মাসুদা নার্গিস আনাম, নাদিরা বেগম, অনামিকা ত্রিপুরা, নারায়ণ চন্দ্র শীল, ক্যামেলিয়া সিদ্দিকা, তানজিনা করিম স্বরলিপি, মোঃ আলতাফ হোসেন এবং নাজিয়া মিশকাত তমা।
×