ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আন্দোলনের নামে জাতির সঙ্গে তামাশা করছে বিএনপি

খালেদা জিয়া বাসায় ফিরছেন না কেন?

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

খালেদা জিয়া বাসায় ফিরছেন না কেন?

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ বিএনপির ডাকা টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী খেলো হয়ে গেছে। জনসমর্থন না থাকার পরও একের পর এক গায়েবি বিবৃতি দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে দলটি জাতির সঙ্গে তামাশা করছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। এদিকে বাসা ছেড়ে টানা ৫৬ দিন গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানের পরও আন্দোলনে সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তারপরও তিনি বাসায় ফিরে যাচ্ছেন না কেন? জনমনে এখন এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রসঙ্গত ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে টানা অবরোধ কর্মসূচী পালন শুরু করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। আর ২ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি সপ্তায় টানা ৫ দিন করে সারাদেশে হরতাল পালন করে আসছে তারা। সরকারবিরোধী এ আন্দোলন কর্মসূচী শুরুর পর থেকে দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তারা নিজেদের মোবাইল ফোনও বন্ধ করে ফেলেছেন। কিন্তু আত্মগোপনে থেকেই ভাড়াটে পিকেটারদের দিয়ে পেট্রোলবোমা মারাসহ বিভিন্নভাবে নাশকতা চালিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছে তারা। তাই পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়াতে একেকদিন একেক জায়গায় অবস্থান করছেন। আর আত্মগোপনে থাকা নেতাদের নামে প্রতিদিনই সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি পাঠানো হচ্ছে। কোন কোন দিন ২-৩টি করেও বিবৃতি পাঠানো হয়। এভাবে গায়েবি বিবৃতি পাঠিয়ে দলীয় কর্মসূচী ঘোষণা দেশের রাজনীতিতে নতুন সংযোজন। তাই এমন বিবৃতি নিয়ে জনমনে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে। আন্দোলন শুরুর প্রথম দিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নামে বিবৃতি পাঠানো হলেও আত্মগোপনে থাকার এক পর্যায়ে তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর দলের আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদের নামে বিবৃতি পাঠানো হচ্ছে। গত এক মাস ধরে প্রতি সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সালাউদ্দিন আহমেদের নামে পাঠানো গায়েবি বিবৃতিতে রবিবার সকাল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত টানা ৭২ ঘণ্টা হরতালের ঘোষণা এবং প্রতি মঙ্গলবার আরেকটি গায়েবি বিবৃতি দিয়ে বুধবার সকল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত টানা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। দেশের কোথাও হরতাল পালন না হওয়ার পরও এভাবে দফায় দফায় গায়েবি বিবৃতি দেয়ায় জনগণের কাছে এ হরতাল খেলো হয়ে গেছে। মানুষ এখন বিএনপি-জামায়াতের এই হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী নিয়ে হাসি-তামাশা করছে। এক সময় হরতাল মানে জনমনে আতঙ্ক থাকলেও বিএনপির ডাকা ঘন ঘন হরতাল মানুষের মনের সেই ভয় কাটিয়ে দিয়েছে। আর এ কারণেই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই যানবাহন চলাচলসহ সবকিছুই স্বাভাবিক থাকছে। তবে মাঝেমধ্যে হরতালকারীরা যানবাহনে পেট্রোলবোমা মেরে নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। হরতালকারীদের হামলায় টানা অবরোধ-হরতাল চলাকালে শতাধিক মানুষ নিহত ও কয়েক হাজার যানবাহন দগ্ধ হলেও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে কোন অনুসূচনা হচ্ছে না। আর এ কারণে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে জনমনে ক্ষোভ ও নিন্দা বেড়েই চলছে। কিন্তু এসব দলের নেতারা যেন কানে কিছুই নিতে চাচ্ছেন না। এদিকে বিএনপি জোটের টানা অবরোধের মধ্যে দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী চলাকালে চোরাগোপ্তা হামলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় দেশ-বিদেশে নানামুখী চাপের মুখে বিএনপি। তবে এখন পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে কোন আশ্বাস না পাওয়া কিংবা সংলাপ করে সমঝোতার সম্ভাবনা না থাকায় উভয় সঙ্কটে পড়েছে দলটি। না পারছে কর্মসূচী স্থগিত করতে আবার জনরোষ দিন দিন বাড়তে থাকায় আর বেশি দিন তা চালিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। আর আন্দোলনের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারেও দলের নেতাদের তেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন না খালেদা জিয়া। এক সময়ের বুদ্ধিদাতা দলের সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ অনেকেই এখন খালেদা জিয়ার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছেন বলে জানা গেছে। জানা যায়, বিএনপির হাইকমান্ড মনে করছে টানা অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচী চালিয়ে গেলে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপে সরকার একদিন বিএনপির প্রতি নমনীয় হয়ে ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু জাতিসংঘসহ বিদেশীদের দৌড়ঝাপ শুরু হলেও সরকারের ওপর এখন পর্যন্ত তেমন চাপ বাড়ছে না। বরং আন্দোলনের নামে নাশকতায় জড়িয়ে পড়ায় বিএনপির ওপরই চাপ প্রয়োগ করে সহিংসতা পরিহার করার আহ্বান জানাচ্ছেন বিদেশীরা। তাই দিন যত যাচ্ছে সরকারও আন্দোলনকারী বিএনপি জাটের প্রতি ততই কঠোর হচ্ছে। ইতোমধ্যেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাই সরকার প্রয়োজন মনে করলে যে কোন সময় তাকে গ্রেফতার করতে পারবে। তাই খালেদা জিয়ার ওপর এখন বাড়তি মানষিক চাপ পড়েছে। বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন কর্মসূচী সফল করতে দলের সিনিয়র নেতারা মাঠে না থাকায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান অনড় অবস্থানে থাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের মতো তৃণমূল নেতাকর্মীরাও প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। তবে বিএনপির নেতাকর্মীরা আস্তে আস্তে দলীয় কর্মকা- থেকে নিজেদের ঘুটিয়ে নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। কেউ কেউ এ দল ছেড়ে অন্য দলে চলে যাওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রসঙ্গত ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্রের কালো দিবস’ হিসেবে পালন করতে রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ করতে চেয়েছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। কিন্তু সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করায় সেদিন সমাবেশ করতে পারেনি তারা। তবে তার আগেই অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি রাতেই বাসা ছেড়ে গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সমাবেশ করার ব্যাপারে ডিএমপি (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ) নিষেধাজ্ঞা জারির পরও ৫ জানুয়ারি বিকেলে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে যাওয়ার জন্য গাড়িতে চড়ে বসলে গুলশান কার্যালয় থেকে পুলিশ বের হতে দেয়নি খালেদা জিয়াকে। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা সরকারবিরোধী সেøাগানে মুখরিত হয়ে লাথি মেরে তালাবদ্ধ গেট ভাঙ্গার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে মারে। এর কিছুক্ষণ পর খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে ওখানে দাঁড়িয়েই ৬ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দেন। টানা অবরোধের মধ্যেই দফায় দফায় হরতাল ডাকছেন তিনি। আর ৫৬ দিন ধরে তিনি গুলশান কার্যালয়েই অবস্থান করছেন। ১৯ জানুয়ারি জিয়াউর রহমানের জন্মদিনে শেরেবাংলানগরে তার মাজারে ফুল দিতেও যাননি খালেদা জিয়া। এমনকি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারেও যাননি তিনি। এদিকে বেশ ক’দিন ধরে পুলিশ গুলশান কার্যালয়ে খাবার প্রবেশে বাধা দিচ্ছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলেও বাস্তবে প্রতিদিনই বিভিন্নভাবে গুলশান কার্যালয়ের ভেতর পর্যাপ্ত খাবার যাচ্ছে এবং বর্তমানে ওই কার্যালয়ে অবস্থান করা প্রায় ৪০ জনের মধ্যে সবাই সুস্থ আছেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসি আন্দোলন কর্মসূচী ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমান তার মায়ের কাছে পরবর্তী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার আশা পোষণ করেন। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়াসহ ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারাও তারেক রহমানের নির্দেশনায় আন্দোলনের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। তাই এবার ৫ জানুয়ারির আগেই তারেক রহমানের পক্ষ থেকে নির্দেশনা আসে আন্দোলন জোরদার করার। আর সরকারের তরফ থেকে মামলা-নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় খালেদা জিয়াও কঠোর আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান করেন। এ কারণেই তিনি এবার আন্দোলন শুরুর আগেই বাসা ছেড়ে গুলশান কার্যালয়ে এসে অবস্থান নেন। এখানে বসেই তিনি প্রতিদিন ছেলে তারেক রহমানসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার কথা বলতে থাকেন। কিন্তু দলের নেতাকর্মীরা এখন আর তার কথায় সাড়া না দেয়ায় জনগণের কাছে এ আন্দোলন কর্মসূচী হাস্যকর হয়ে গেছে।
×