ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কয়েকটি নোবেল মেডেলের অদৃষ্ট ছিল...

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কয়েকটি নোবেল মেডেলের অদৃষ্ট ছিল...

[ ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তন করা হয়। নোবেল মেডেলকে নিয়ে উত্তরাধিকারদের মামলা-মোকদ্দমা, মেডেলের পরিণতি নিয়ে নানা ধরনের ঘটনা রয়েছে। এই নিবন্ধে কয়েকজন নোবেল বিজয়ীর মেডেলের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। এই নিবন্ধের প্রথম অংশ ২৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়, আজ শেষাংশ] ১৯৫২ সালে ফন লাউ ও ফ্রাঙ্ক তাঁদের ‘নতুন’ মেডেল পান। সুইডেনে পালিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন বাদে, ১৯৪৩ সালে ডি হেভেসিও রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিদ্যার জগতে যারা নতুন ও অজানা ‘নন-ট্র্যাডিশনাল’ আবিষ্কারের কম্পন তুলেছিলেন, বোরও ছিলেন তাঁদেরই একজন। পারমাণবিক সংস্থিতি (স্ট্রাকচার) ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের পত্তনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নীলস বোর ১৯২২ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসের ১২ তারিখে নীলস বোর তাঁর নোবেল মেডেলটি বিক্রি করেন, অজানা ক্রেতা সেটি কিনে নেয় এবং বোর বিক্রয়লব্ধ অর্থ যুদ্ধপ্রপীড়িত ফিনল্যান্ডের উদ্বাস্তু সেবায় দান করেন। যুদ্ধ শেষে সেই অজানা ক্রেতা ডেনমার্কের ফ্রেডারিকসবর্গ মিউজিয়ামে বোরের মেডেলটি দান করেন, মেডেলটি এখনও সেখানে প্রদর্শনে রয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা যে চার পুরুষের পরিচয় পেলাম, তাঁরা চারজনই নোবেল বিজয়ী। তবে এই ডেনমার্ক অধ্যায়ে নীলস বোরের ছেলে এ্যায নীলস বোরের প্রসঙ্গও চলে আসা উচিত। কারণ বাবার মতো তিনিও নোবেল পুরস্কার পান, ডেনমার্কের বেন রয় মটেলসন ও যুক্তরাষ্ট্রের লিয়ো জেমস রেইনওয়াচারের সঙ্গে একত্রে ১৯৭৫ সালে প্রদত্ত পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান তিনি। এ্যায বোর মারা যান ২০০৯ সালে এবং ২০১২ সালের নবেম্বর মাসে তাঁর নোবেল মেডেলটি নিলামে বিক্রি হয় মাত্র ৪৯,০০০ ডলারে। (নিলামটি হয়েছিল ব্রুন রাসমুসেনের নিউসম্যাটিক বা মুদ্রা ও পদকসংক্রান্ত নিলাম হাউসে। মরক্কো লেদারের আদি বাক্সে রাখা মেডেলটির সঙ্গে আরও ছিল ওরিজিনাল নোবেল পুরস্কারসংক্রান্ত ওরিজিনাল দলিল ইত্যাদি। কাজেই দাম আরও ওঠা উচিত ছিল। এই একই নিলামে, ফিলাডেলফিয়া ফ্র্যাঙ্কলিন ইনস্টিটিউটসহ অন্য কয়েকটি সংস্থা থেকে নীলস বোরকে সোনার যেসব মেডেল দেয়া হয়েছিল, সেগুলোও বিক্রি হয়)। ক্রেতা অজানা, মেডেলগুলোর অদৃষ্টও অজানা। আর নীলস বোরের ভাই হ্যারাল্ড বোর চৌকস গণিতবিদ ছিলেন বটে, তবে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। অবশ্য ডেনিশ জাতীয় ফুটবল টিমের সদস্য হিসেবে ১৯০৮ সালের অলিম্পিকে রূপার একটি মেডেল তিনি পেয়েছিলেন। এ্যাকাডেমিক বল্ডক্লাব নামক ফুটবল টিমের সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন, ক্লাবের শর্ত ছিল যে খেলোয়াড়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে হবে! এখনও টিমটির অস্তিত্ব রয়েছে। তবে টিমটিকে ষাট ও সত্তরের দশকের ‘পেশাদারি টিমের’ ট্রেন্ড অর্জনের কঠিন সময়টি অতিক্রম করতে হয়েছে। হ্যারাল্ড বাদে, বাকি পাঁচ পুরুষের দখলে যে পাঁচটি মেডেল ছিল, সবই কিন্তু ২৩ ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়ে তৈরি ছিল এবং প্রতিটির গড় ওজন ছিল প্রায় দু’শ’ গ্রাম। এবারের কাহিনী জেমস ওয়াটসনকে নিয়ে। ওয়াটসনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব যে তিনি এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ১৯৫৩ সালে ‘ডিএনএ’-এর গঠনকাঠামো আবিষ্কার করেন। সৃষ্ট জগতের ক্রমবিবর্তনের বা অন্যভাবে প্রাণিজগতে কিভাবে তথ্যাদি প্রজন্ম পরম্পরায় পরিবাহিত হচ্ছে, সেই চাবিকাঠির জিম্মাদার ‘ডিএনএ’। তাঁদের আবিষ্কার জীবজগতের শারীরবৃত্তের জগতে বিপ্লব আনে। তাঁরা অনায়াসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর দলভুক্ত। ‘ডিএনএ’ রহস্যের উন্মোচনের রোমাঞ্চকর টানাপোড়েনের দিনগুলো নিয়ে ওয়াটসন ১৯৬৮ সালে ‘দি ডবল হেলিক্স’ নামে চমৎকার একটি বই লেখেন। এত বছর বাদেও বইটি তার আকর্ষণ হারায়নি। বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বই একটি। অভূতর্পূব আবিষ্কারের জন্য ১৯৬২ সালে জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক এবং মরিস উয়িলকিন্স সম্মিলিতভাবে চিকিৎসাবিদ্যা শাখায় নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৮০ সালের আগের ঘটনা। অর্থাৎ, নোবেল মেডেলটি তেইশ ক্যারেট স্বর্ণ দিয়ে তৈরি এবং পরিমাণেও দুই শ’ গ্রামের কাছাকাছি। জেমস ওয়াটসন বৃদ্ধ বয়সে, জন্ম ১৯২৮ সালের ৬ এপ্রিল, তাঁর নোবেল মেডেলটি নিলামে বিক্রি করে দেন। ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর, ক্রিস্টি’স নামক ন্যু ইয়র্কের এক নামী নিলাম কোম্পানি বিক্রি সম্পন্ন করে। কারণ আর্থিক টানাটানি। হঠাৎ করে বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক দুরবস্থার সর্বশেষ এক কাহিনী রয়েছে। বোঝার ওপর যে শাকের আঁটিটি ‘আর্থিক দুরবস্থার’ প্রান্তে নিয়ে আসে, সেটি বলা যাক। স্পষ্টবাদী বিজ্ঞানী হিসেবে সম্মানিত ওয়াটসন, মাঝে মধ্যে যে অদ্ভুত পাগলাটে কথাবার্তা বলে ফেলেন, তার সঙ্গে কম-বেশি সবাই পরিচিত। যেমন : সূর্যালোক ও মানুষের কামনাবাসনার সংযোগ নিয়ে তাঁর মন্তব্য, বেশ হৈচৈয়ের সৃষ্টি করে। তবে তাঁর পতন দ্রুত করে ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে দি সানডে টাইমসের এক সাক্ষাতকারে :‘আফ্রিকার বিষণœ অনালোকিত পরিপ্রেক্ষিতে’ বলেন যে ‘আমাদের সব সামাজিক নীতি নির্মিত হয়েছে এই ভিত্তিতে যে ওদের বুদ্ধিবৃত্তি আমাদের সমানে সমান, অথচ সব পরীক্ষা-প্রক্রিয়া বলছে যে আসলে তা নয়।’ কালো আফ্রিকীয়দের আইকিউ নিয়ে এই প্রকাশ্য বচন বিরূপ মন্তব্য সমেত ওয়াটসনকে ‘রেইসিস্ট বিজ্ঞানী’র লেবেল দেয়া হয়। তাঁকে ‘একঘরে’ করা হয়। কোল্ড স্প্রিং হারবার গবেষণাগারে চার দশক ধরে সফল গবেষণাকর্ম চালিয়ে গেলেও তাঁকে অবসর জীবনে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। বোর্ডস অব কোম্পানিজ থেকে খারিজ করে দেয়া হয়। ২০০৭ সালের পর থেকে ভুলেও কেউ আর তাঁকে পাবলিক ভাষণ দিতে নিমন্ত্রণ করে না। এভাবে তাঁর পরিধি ও পরিস্থিতি সঙ্কুচিত করা অব্যাহত থাকে। ওয়াটসন যে জেনেটিক্সের চশমা পরে আসলে ‘সাবজেক্টিভ জগতের’ পদ্ধতিগত অসম্পূর্ণতার কথাই বলছেন, এমন যুক্তি নিয়ে শক্তিধর শিবির থেকে ওয়াটসনকে ডিফেন্ড করতে কাউকে পাওয়া গেল না। ওয়াটসন নিশ্চয় জানেন যে ‘বুদ্ধিবৃত্তি’ নিয়ে যে এত হৈচৈ হচ্ছে, সেটির বিকাশ হতে কিছু পূর্বশর্ত পূর্ণ হতে হয়। মানুষ যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তার ওপরে নির্ভর করে। এই পরিবেশ আবার নির্ভর করছে শিক্ষা, ‘লালন-পালন প্রক্রিয়া’র উপরে এবং সেই পরিবেশ যেই পরিবেশ সাধারণ শিক্ষা, পরীক্ষা-প্রক্রিয়া বা টেস্ট, স্কুলের পরীক্ষা ইত্যাদি উপাদানের মধ্য দিয়ে ক্রমশ আকার-অবয়ব নেয়। অতঃপর সৃষ্টি করে সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি প্রয়োগের ক্ষেত্র। ওয়াটসনের কপাল খারাপ, তাঁকে ‘রেইসিস্ট বিজ্ঞানী’র লেবেল দেয়ার দল বেশি জোরদার বলে প্রমাণিত হয়। ২০০৭ সাল থেকে অদ্যাবধি ওয়াটসন ‘রেইসিস্ট বিজ্ঞানী’র লেবেল অস্বীকার করে আসছেন। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে (নবেম্বর ২৮, ২০১৪) বলেন যে ‘আমি গতানুগতিক ধারার রেইসিস্ট নই’। ‘আমি দুঃখিত... যে (দি সানডে টাইমসের) সাংবাদিক কোন না কোনভাবে লেখে যে আফ্রিকার মানুষদের জন্য আমি উদ্বিগ্ন ওদের নিচুমানের আইকিউর জন্য এবং এই জাতীয় কথা বলা ঠিক নয়।’ আরও বলেন যে, ‘আমি যে রয়েছি, কেউ স্বীকার করতে চায় না।’ ‘সমাজচ্যুত’ ওয়াটসন আর্থিকভাবে একেবারেই হত অবস্থায় নেই, পেনশন পান। কিন্তু পাবলিক লেকচার থেকে আয়ের পথ রুদ্ধ। গবেষণাকর্ম থেকে বঞ্চিত। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন যে নোবেল মেডেল নিলামে বিক্রি করবেন। বিক্রয়লব্ধ অর্থের কিছুটা দুই আলমা-মাটের, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ও কেমব্রিজসহ যেসব ইনস্টিটিউট তাঁর ‘দেখশুন’ করেছে, সেগুলোকে দান করবেন, নিজের জন্য (ইংরেজ পেইন্টার) ডেভিড হকনীর ছবি কিনবেন একটি ইত্যাদি। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের আটাশে নবেম্বর ক্রিস্টি’স-এ ওয়াটসনের নোবেল মেডেল নিলামের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, নিলাম পর্বের এই অধ্যায়ে আলিশের উসমানভের নামটি চলে আসে। রুশদের ধনীতম ব্যক্তি উসমানভ, ফোরবসের মতে, উসমানভের সম্পত্তির পরিমাণ কম করেও ১৫.৮ বিলিয়ন ডলার তো হবেই, তাঁকে তাই ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় ধনীতমের স্থান দিয়েছে। নানা রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবের শেয়ারহোল্ডার তিনি। ওয়াটসন মেডেল বিক্রি করছেন শুনে উসমানভ তো থ’! ‘এমন এক অবস্থায়, অভূতপূর্ব বিজ্ঞানী অভূতপূর্ব আবিষ্কারের স্বীকৃতি বাবদ পাওয়া মেডেলটি বিক্রি করবেন, তা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ক্যান্সার গবেষণায় তাঁর অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই, আমার বাবা এই রোগটিতেই মারা গেছেন।’ ঠিক করেন যে মেডেলটি তিনি কিনবেন, টাকা যাবে গবেষণাকর্মে, আর মেডেলটি পাবেন তিনি যিনি তার নির্ভুল প্রাপক, অর্থাৎ ওয়াটসন। এক অর্থে, অবশেষে ওয়াটসনের ভাগ্যাকাশে খুশির ঝলক দেখা দিল। কারণ যদিও মনে করা হয়েছিল যে মেডেলটি বড়জোর তিন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হবে, কিন্তু উসমানভ ৪.৮ মিলিয়ন ডলারে সেটি কিনে নেন। নিলাম বাবদ খরচাপাতি শোধের পর ওয়াটসন হাতে পান ৪.১ মিলিয়ন ডলার, উসমানভ পান নোবেল মেডেল। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে অনুভব করেন, তারপরে ফিরিয়ে দেন ওয়াটসনকে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা অব্যাহত রাখা এবং মেডেল, দুই-ই ওয়াটসনের হলো। তবে ড. ওয়াটসন, সাবধান! সংবেদনহীন সাংবাদিককে সাক্ষাতকার দেবেন না! হধফরৎধযসধলঁসফধৎ@মসধরষ.পড়স
×