ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধৃত শিবির ক্যাডারদের স্বীকারোক্তি;###;৩৭ জেলায় নাশকতার ছক

খালেদা জিয়ার নির্দেশেই ধ্বংসযজ্ঞ ॥ দেশ অচল করার জামায়াতী নীলনক্সা ভণ্ডুল

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

খালেদা জিয়ার নির্দেশেই ধ্বংসযজ্ঞ ॥ দেশ অচল করার জামায়াতী নীলনক্সা ভণ্ডুল

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ অবরোধ-হরতাল অব্যাহত রেখে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার পরামর্শে জামায়াত-শিবির দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৩৭ জেলায় নাশকতা চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু শিবিরের শীর্ষস্থানীয় তিন ক্যাডার চট্টগ্রামে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ায় গোপনীয়তা ভ-ুল হয়ে গেছে, উদঘাটিত হয়েছে অনেক রহস্য। এ ঘটনা নিয়ে সরকারী উচ্চ মহলে তোলপাড় চলছে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের চারটি বিশেষ টিম গঠন করে গত পাঁচদিন ধরে রিমান্ডে এনে আসামিদের একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদে শেষ পর্যন্ত থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে আটক শিবির ক্যাডারদের কাছ থেকে নাশকতার যে ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা রীতিমতো পিলে চমকানো। প্রথমত, নীলনক্সা অনুযায়ী চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বেল্টে স্থাপিত দেশের জ্বালানি মজুদ ও সরবরাহের প্রধান স্থাপনা জ্বালিয়ে দেয়া এবং এতে সন্নিহিত চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর অচল হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটানো গেলে বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সমঝোতায় বসতে বাধ্য হবে, এমন নীলনক্সার পাশাপাশি ৩৬ জেলায় একযোগে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর চক্রান্ত করে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক জামায়াত। আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ে বর্তমান চলমান আন্দোলন শুরুর প্রাক্কালে জামায়াতের সাবেক এক এমপির সঙ্গে বৈঠক করে আন্দোলন সফল করতে প্রয়োজনে এ ধরনের নাশকতার মরণ কামড় দিতে নির্দেশনা দেন। এই নিয়ে জামায়াতের ঐ সাবেক এমপি শীর্ষস্থানীয় শিবিরের ৩৭ ক্যাডারকে এ দায়িত্ব দেন। ফলশ্রুতিতে অন্যতম ক্যাডার এনামুল কবির গত ১২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে এসে প্রণীত নীলনক্সা অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছিল। আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তারা প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দর ও অয়েল বেল্ট থেকে পণ্য সরবরাহ বন্ধের সতর্ক বার্তা প্রেরণ করত। এতে কাজ না হলে চালানো হতো নাশকতার মাধ্যমে ধ্বংযজ্ঞ। পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হওয়ার পথে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপকালে হাতেনাতে গ্রেফতার হওয়া দুই বোমাবাজের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শিবির ক্যাডার এনামুল কবিরের পরিকল্পনার তথ্য পেয়ে যায়। এরপর পুলিশের ঘুম হারাম হয়ে যায়। শুরু হয় চতুর্মুখি অভিযান। ২০ ফেব্রুয়ারি এনামুল কবিরকে চট্টগ্রামের বাকলিয়ার বগারবিল এলাকা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পরে গ্রেফতার হয় শিবির ক্যাডার মোঃ মোস্তফা, মুশফিক আবরার মাহিন। মোঃ মোস্তফা হচ্ছে ছাত্র শিবির চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর শাখার পাঠাগার সম্পাদক ও মুশফিক আবরার মাহিন চট্টগ্রাম মহানগরের দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড সম্পাদক বাইতুলমাল সম্পাদক। গ্রেফতারের পর এদের রিমান্ডে এনে বিশেষ চারটি টিমের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। প্রথম তিনদিন এদের মুখ থেকে কোন তথ্য আদায় করা না গেলেও শেষ দু’দিনে একে একে নাশকতার চাঞ্চল্যকর তথ্য ও যাবতীয় পরিকল্পনা এবং ৩৭ জেলায় একযোগে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর নীলনক্সার তথ্য বেরিয়ে আসে। পিলে চমকানো এসব তথ্য পাওয়ার পর পুলিশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তাৎক্ষণিক পরিকল্পনার বিষয়টি অবহিত করে। এর ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে ৩৭ জেলায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে অবশিষ্টদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। সিএমপির উর্ধতন এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, বিশেষ মিশন নিয়ে চট্টগ্রামে এসে ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় এক নেতা ধরা পড়ায় ভ-ুল হয়ে গেছে দেশের ৩৭ জেলায় একযোগে নাশকতা করার পরিকল্পনা। পুলিশের হাতে ধরা পড়া এনামুল কবিরকে (৩১) জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাওয়া নেতাদের নাম ও সমন্বয়কারী জামায়াত নেতার নাম প্রকাশ করেছে। সে অনুযায়ী পুলিশ তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে। সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সমাজ সেবা সম্পাদক এনামুল কবিরের দায়িত্ব ছিল বাগেরহাট এলাকায়। কিন্তু চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্তরা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দক্ষতা দেখাতে সমস্যার মধ্যে পড়ায় বিশেষ মিশনে চট্টগ্রামে পাঠানো হয় কেন্দ্র থেকে। দেশের জ্বালানি সেক্টরের প্রধান স্থাপনাগুলো চট্টগ্রামে হওয়ায় সবচেয়ে বড় নাশকতার বড় পরিকল্পনাটা ছিল এখানেই। কিন্তু গত ২০ ফেব্রুয়ারি নগরীর বাকলিয়া থানার বগারবিল এলাকার একটি বাড়ি থেকে এনামুল কবিরকে পুলিশ গ্রেফতার করায় ভেস্তে যায় নাশকতার ছক। ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা এনামুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গঠন করা হয়েছে পুলিশের চারটি টিম। ইতোমধ্যে টিমগুলো তাকে জিজ্ঞাসাবাদও শুরু করেছে। পুলিশের এ চারটি টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার ( গোয়েন্দা) মোঃ হাসান চৌধুরী, অতিরিক্ত উপকমিশনার (পশ্চিম) তানভীর আরাফাত, অতিরিক্ত উপকমিশনার (বন্দর) মোস্তাক আহমদ ও কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার শাহ মোঃ আবদুর রউফ। প্রতিটি টিমকে সহযোগিতা করছেন একজন করে পরিদর্শক ও একজন করে উপপরিদর্শক। পুলিশ জানায়, নাশকতার পরিকল্পনাটি এত ভয়াবহ ছিল যে শিবিরের এ নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার নেতৃতে চার-চারটি টিম গঠন করতে হয়েছে। আর পুরো বিষয়টি মনিটর করা হচ্ছে প্রশাসনের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে। কারণ, তাদের পরিকল্পনা ছিল একযোগে দেশের ৩৭ জেলায় নাশকতার। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ ইতোমধ্যেই জেনে নিয়েছে ৩৭ জেলায় কাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে চট্টগ্রামে নাশকতার পরিকল্পনা সমন্বয়ের দায়িত্বটি পালন করছিলেন কক্সবাজার জেলার মহেশখালি-কুতুবদিয়া আসন থেকে নির্বাচিত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আজাদ। সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, অনেক বড় নাশকতামূলক ঘটনার পরিকল্পনায় ছিল ছাত্র শিবির। এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে এনামুল কবিরের কাছ থেকে যেটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই চলছে। যে সমস্ত নাম বেরিয়ে এসেছে তা উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে। পুলিশের সদর দফতর থেকে বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। সিএমপি কমিশনার আবদুল ম-ল সাংবাদিকদের জানান, এনামুল কবির ধরা না পড়লে তারা নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্রিয় হতো। কিন্তু গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করতে সক্ষম হওয়ায় বড় ধরনের ঘটনা থেকে চট্টগ্রামে অবস্থিত দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রধান স্থাপনাগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। এনামুলকে ধরা সম্ভব না হলে গত সোম-মঙ্গলবারের মধ্যে হয়ত বড় নাশকতা হয়ে যেত। তাদের টার্গেট ছিল দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি, বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) আওতাধীন পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যমুনা অয়েল কোম্পানি ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের প্রধান স্থাপনা ও ডিপো এবং চট্টগ্রাম বন্দর। পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর ঐ স্থাপনাগুলো ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয় এবং একইসঙ্গে নাশকতা পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ধরতে অভিযান শুরু করা হয়। সিএমপি সূত্রে জানা যায়, নাশকতার মিশনে চট্টগ্রাম উত্তর ও নগরীর দায়িত্ব দেয়া হয় ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় আপ্যায়ন সম্পাদক মোহাইমেনুল কবিরকে। তার সঙ্গে সহযোগিতায় ছিল ছাত্র শিবির নেতা মশরুর এবং শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন। মোহাইমেনের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। চট্টগ্রামে জামায়াতী সন্ত্রাসের গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত সাতকানিয়ার সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে পরামর্শ করেই বড় এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছিল তারা। নাশকতার মিশনে এক জেলার নেতা অন্য জেলায় ॥ সিএমপির গোয়েন্দা শাখা সূত্রে জানা যায়, পরিকল্পনাটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে এক জেলার নেতাকে আরেক জেলায় দায়িত্ব দেয়া হয় ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে। যেমন চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেয়া হয় সাতক্ষীরার মোহাইমেনকে। আর বাগেরহাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত এনামুলের বাড়িও বাগেরহাট নয়। শেষ পর্যায়ে তাকে আবার আনা হয় চট্টগ্রামে। ছাত্র শিবিরের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোস্তফা মনোয়ারকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের। তার বাড়ি বগুড়া জেলায়। নোয়াখালীতে সমন্বয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন শিবিরের কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য মোঃ রিয়াদ। তার বাড়ি শেরপুর জেলায়। সিলেটে নাশকতামূলক কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয় ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় স্কুলবিষয়ক সম্পাদক আ ন ম মশরুর হোসাইনকে। এই নেতার বাড়ি চট্টগ্রামে। মাগুরার মিশনের দায়িত্ব পায় শিবিরের কেন্দ্রীয় মাদ্রাসাবিষয়ক সম্পাদক মোঃ মহিউদ্দিন। তার বাড়ি বগুড়ায়। এভাবেই এক জেলার নেতাকে পাঠানো হয় অন্য জেলায়। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামের নেতাদের সম্পর্কে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসনের ধারণা থাকায় তারা এ কৌশল গ্রহণ করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যাওয়ায় তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় রয়েছে পুরো দেশের জ্বালানি সেক্টরের প্রধান স্থাপনা। এছাড়াও রয়েছে বন্দর এবং আরও কিছু ক্রুড সয়াবিন অয়েলের সংরক্ষণাগার। প্রতিষ্ঠানগুলো কেপিআই (কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন) এবং অত্যন্ত স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচিত। নাশকতাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল মূল জায়গায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে পুরো দেশকে বিকল করে দেয়া। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এ তথ্য ধরা পড়ায় সে রাত থেকেই পতেঙ্গা এলাকায় কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বিশেষ করে অয়েল বেল্ট এলাকায় মোটরবাইক ও অটোরিক্সা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ॥ এনামুল কবিরসহ শিবিরের তিন নেতাকে পাঁচদিনের রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত টানা ২ ঘণ্টা এনামুল কবির জবানবন্দী প্রদান করে। এডিসি প্রসিকিউশন কাজী মুত্তাকী মিনান জানান, আসামি এনামুল কবিরকে মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মাশফিকুল ইসলামের আদালতে জবানবন্দী প্রদান করে। এর আগে গত শুক্রবার গ্রেফতারকৃত অপর আসামি শিবির ক্যাডার মুশফিক আবরার মাহিন আদালতে ভয়াবহ এ ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে জামায়াত-শিবিরের নীলনক্সার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে।
×