মোরসালিন মিজান
রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে কী ভয়ঙ্কর খেলা! নিরীহ নির্দোষ মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। দিনের পর দিন চলছে অবরোধ। হরতাল। এ অবস্থায় কতটা সফল হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা? কেউ কেউ দুশ্চিন্তায় ছিলেন বটে। আদতে তেমন কিছু হয়নি। একুশ মানে মাথা নত না করা। বাঙালী কখনও অন্যায় অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করেনি। বইমেলার বেলায় সে কথা আরও একবার প্রমাণিত হলো।
যথারীতি ১ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক শুরু হয়েছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এবার সবচেয়ে বড় পরিসর মেলার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। একাডেমি চত্বর ছাড়াও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল অংশজুড়ে বিস্তৃত করা হয় আয়োজনটিকে। স্টলের সংখ্যা ছিল বেশি। যোগ হয়েছে প্যাভিলিয়ন। এরপরও ফাঁকা ছিল না কোন ভেন্যু। প্রতিদিনই শ্রোতের মতো এসেছেন পাঠক। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁরা প্রবেশ করেছেন বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তরুণ তরুণী মাঝবয়সী ও প্রবীণরা নিয়মিত মেলায় এসেছেন। উৎসবে বিপুল পরিমাণে যোগ দিয়েছে শিশু কিশোররা। বাবা মা অভিভাবকদের সঙ্গে মেলায় এসে চমৎকার সময় কাটিয়েছে তারা। মেলায় আড্ডা ঘুরে বেড়ানো ছিল। হুল্লোড়, ছবি তোলা চলেছে। তবে কোনটাই বইকে বাদ দিয়ে নয়। বইপ্রেমীরা স্টলে স্টলে গিয়ে বই দেখেছেন। নিজের জন্য কিনেছেন। উপহার দিয়েছেন। হরতাল অবরোধের মাঝে মেলোয় এসেছে শিশুরাও। তাদের ছিল বিপুল উপস্থিতি। শুক্র ও শনিবার পূর্বনির্ধারিত শিশু প্রহরে যোগ দিয়েছে শত শত শিশু কিশোর। অন্যান্য দিনেও অভিভাবকদের সঙ্গে স্টল ঘুরে প্রচুর বই কিনেছে তারা। বুধবার মেলায় আসা সরকারী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বললেন, বইমেলা শুধু বইয়ের মেলা নয়। এটি সাংস্কৃতিক উৎসব। এখানে আসতেই হবে। এক সময় বন্ধুরা মিলে এসেছি। এখন আসি বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে। বর্তমানে আবারও অশুভ শক্তির উত্থানের শঙ্কা দেখা দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ অবস্থায় মেলায় আসা আরও জরুরী। একে একটি নীরব প্রতিবাদ বলতে পারেন।
মেলায় প্রায় প্রতিদিনই এসেছেন জনপ্রিয় লেখক ও কবিরা। সায়েন্সফিকশনের তারকা লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ঘণ্টার পর ঘণ্টা অটোগ্রাফ দিয়েছেন। নিজের বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টলে দেখা গেছে ইমদাদুল হক মিলনকে। নির্মলেন্দু গুণের মতো প্রিয় কবিরা আলো ছড়িয়েছেন মেলায়। প্রচলিত ধারার বাইরে লিখে খ্যাতি অর্জন করা অনেক লেখকও মেলা ঘুরে দেখেছেন।
প্রকাশকরাও বাদ যাননি। অধিকাংশ প্রকাশক দিনের কোন না কোন সময় মেলায় উপস্থিত হয়েছেন। ইউপিএলের কর্ণধার প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমেদকেও নিয়মিত দেখা গেছে মেলায়। বুধবারও প্যাভিলিয়নের সামনে চেয়ার পেতে লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা গেছে তাঁকে। আগামী প্রকাশনীর ওসমান গনী, শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন আহসান, অ্যাডর্নের সৈয়দ জাকির হুসাইন, তাম্রলিপির একেএম তারিকুল ইসলাম রনি, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের জুয়েলসহ আরও অনেকেই মেলার পুরোটা সময় সশরীরে উপস্থিত থেকেছেন।
এভাবে লেখক পাঠক ও প্রকাশকের হয়ে উঠেছে মেলা। প্রাণের মেলায় কোন আতঙ্ক ছিল না। রাজনীতির নামে যে সন্ত্রাস বর্বরতা চলছে, মেলা এ থেকে মুক্ত ছিল। ২৫তম দিন পর্যন্ত নির্বিঘেœ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাকি দিনগুলোও চমৎকারভাবে শেষ করা যাবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। এ প্রসঙ্গে মেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালীর প্রাণের মেলা। এই মেলার সঙ্গে, মেলার প্রধান উপাদান বইয়ের সঙ্গে কারও শত্রুতা থাকতে পারে না। সে বিশ্বাস থেকেই বইপ্রেমীরা প্রতিদিন আসছেন। সকলের সহায়তা শেষ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে আশা করে তিনি বলেন, অমর একুশের মেলা এবারও সফল হবে। একই প্রসঙ্গে ইউপিএলের প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক নানা টানাপড়েনের পরও প্রচুর মানুষ মেলায় এসেছেন। বই দেখেছেন। কিনেছেন। এটা অনেক বড় ব্যাপার। এই যে শ্রোতের মতো মানুষ আসল, এরও মূল্য আছে। এই শ্রোতটিকে আরও ভালভাবে কাজে লাগানোর ব্যাপারে সকলকে ভাবার পরামর্শ দেন তিনি। এ প্রসঙ্গে অ্যার্ডন পাবলিকেশন্সের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ জাকির হোসাইন বলেন, এই মেলায় বই বিক্রি কম হতে পারে। বেশি হতে পারে। এটা বড় কথা নয়। এখানে হাজার হাজার মানুষ এসেছে। তাদের আসাটাকে সম্মান করতে হবে। মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করে তাদের ধরে রাখার কথা ভাবতে হবে প্রকাশকদের। কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় না এসে বাঙালী পারে না। প্রাণের টানে এখানে ছুটে আসে। আমি নিজেও অপেক্ষা করে থাকি, কবে শুরু হবে মেলা। এবার শরীর সুস্থ না থাকায় কম এসেছি। তবে এসেছি। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিদিন মেলায় আসা পাঠকদেরও অভিনন্দন জানান তিনি।
মেলার সময় বৃদ্ধি ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার সময় সামান্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার পরিবর্তে সকাল ১০টায় শুরু হবে মেলা। রাত সাড়ে ৮টার পরিবর্তে চলবে ৯টা পর্যন্ত। শেষ দুই দিন শুক্র ও শনিবার যথারীতি মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায়। তবে শেষ হবে সাড়ে ৮টার পরিবর্তে রাত ৯টায়। বাংলা একাডেমির সচিব ও মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য মোঃ আলতাফ হোসেন সময় বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মেলা ৭ দিন বাড়ানোর যে দাবি কোন কোন প্রকাশক করেছেন যৌক্তিক কারণেই তা মানা সম্ভব হয়নি।
১১৬ নতুন বই ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২৫তম দিনে বুধবার মেলায় নতুন বই এসেছে ১১৬টি। নজরুল মঞ্চে ১১টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ বুধবার গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক শান্তনু কায়সার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন পূরবী বসু, বদিউর রহমান এবং জাকির তালুকদার। সভাপতিত্ব করেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
প্রাবন্ধিক বলেন, উপন্যাসের উদ্ভব ও বিকাশের ধারাক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে উপন্যাসের কাঠামোয় প্রতিস্থাপন ব্যাখ্যা করলে আমরা দেখতে পাবো ইতিহাসের সত্য কীভাবে শিল্পের সত্যে রূপ নেয়। এই শিল্পরূপ প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে আমাদের ঔপন্যাসিকদের শৈল্পিক অঙ্গীকার ও দ্বন্দ্ব কীরূপে প্রতিফলিত তাও আজকের পাঠকের কাছে জরুরী বিচার্য। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলতে শুধু একাত্তরের যুদ্ধগাথাকেই বুঝায় না, সঙ্গে সঙ্গে বাঙালীর হাজার বছরের সংগ্রামী ইতিহাসকেও নির্দেশ করে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম ছাপিয়ে এর অন্তর্বস্তুর দিকে মনোযোগ দিলে অনাগত কালের ঔপন্যাসিকবৃন্দের হাতেই হয়তো লিখিত হবে মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী উপন্যাস।
আলোচকরা বলেন, বাঙালীর মুক্তির লড়াই আবহমান কালের। ১৯৭১-এ এই লড়াই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। আমাদের কথাসাহিত্যে বিশেষত উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, অভিজ্ঞতা ও আবেগ যে শৈল্পিক মাত্রায় চিত্রিত হয়েছে তা অনন্যসাধারণ। তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ কখনও পুরনো হবার বিষয় নয়। তাই পূর্বজ ঔপন্যাসিকদের ধারাবাহিকতায় নতুন প্রজন্মের লেখকরা ভিন্ন আঙ্গিকে বাঙালীর এই চিরায়ত গর্বের লড়াইকে উপন্যাসে শিল্পমাত্রা দিয়ে যাচ্ছেন।
সভাপতির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনন্ত অহঙ্কার ও গৌরবের বিষয়। আমাদের ঔপন্যাসিকরা নানান আঙ্গিকে মূলত এক অখ- জনযুদ্ধকে ভাষারূপ দিয়েছেন যা সময়ের সীমা পেরিয়ে চিরকালীন শিল্প সত্যে রূপ নেয়।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী সায়েরা হাবীব, মোহাম্মদ লতিফুর রহমান এবং আতাহার ইয়াসির ফাহিম। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী সাজেদ আকবর, সালমা আকবর, মিলিয়া আলী, স্বপন দত্ত, স্বাতী সরকার, অভয়া দত্ত, অনিমা রায়, ড. অনুপম কুমার পাল এবং দীপা চৌধুরী। মাহমুদ এবং রেজাউদ্দিন স্টালিন। সভাপতিত্ব করবেন কবি আসাদ চৌধুরী।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: