ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৭ মাসে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিক্রি ॥ কমছে সরকারের ব্যাংক ঋণ

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে রেকর্ড

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে রেকর্ড

রহিম শেখ ॥ টানা অবরোধ-হরতালের মধ্যেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এতো বেশি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা থাকেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলো আমানতে সুদহার কমানোর কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। ঝুঁকিহীন এবং বেশি মুনাফার কারণে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় সরকারের ব্যাংক ঋণের চাপ কমছে। ফলে সরকারও এ খাত থেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঋণ পাচ্ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি সংক্রান্ত জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১৫ হাজার ৭৩৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বেশি। এ বছর নিট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ডাকঘরের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হয়েছে। এই সময়ে ডাকঘরের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৯৩৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ হাজার ৮৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর মাধ্যমে সাত মাসে মোট বিনিয়োগ হয়েছে ২ হাজার ৯৩৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল্য পরিশোধ বাবদ ৭ হাজার ২০৬ কোটি ২২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আর সুদ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৫ হাজার ৩৭১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একক মাস হিসেবে জানুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আসে ২ হাজার ৬০৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এত বেশি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা থাকেনি। জানুয়ারি মাসে ডাকঘরের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১৮৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৮৬৬ কোটি ২৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর মাধ্যমে বিনিয়োগ হয়েছে ৫৫৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল্য পরিশোধ বাবদ ৯৭০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আর সুদ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৭৯৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এর আগের মাস ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আসে ১ হাজার ৮৯৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। নবেম্বরে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১ হাজার ৪৬৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অক্টোবরে এসেছে ২ হাজার ২৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে আসে দুই হাজার ৪৯২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আগস্ট মাসেও এক লাফে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ গিয়ে উঠে দুই হাজার ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকায়। চলতি অর্থবছরের (২০১৪-১৫) প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি আসে এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। আকর্ষণীয় মুনাফা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ার প্রধান কারণ বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অবরোধ-হরতালসহ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে এবং সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়ার কারণে সবাই এ খাতে ঝুঁকছেন। তিনি বলেন, শেয়ার বাজারে দীর্ঘদিনের মন্দার কারণে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটা ভাল সুযোগ দিয়েছে সরকার। সেই সুযোগ তারা নিচ্ছেন, যার প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। জানা গেছে, বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নয় হাজার ৫৬ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা বেশি এসেছে। গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দুই গুণ বাড়িয়ে আট হাজার কোটি টাকা করা হয়। এদিকে গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে খুব বেশি ধার করতে হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৯ জানুয়ারি এ সাত মাসে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোন অর্থ ধার করেনি। উল্টো বিভিন্ন সময়ে নেয়া ঋণের ৯ হাজার ২২৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। একই সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার মাত্র ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ফলে সরকারের নিট ঋণ ঋণাত্মক ধারায় নেমে এসেছে। যার পরিমাণ ৬ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের একই সময় এ নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ নুরুল আমীন জনকণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ভাল থাকায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সাময়িকভাবে সরকারের ঋণ কমেছে। তবে বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হলে তখন ঋণের চাপ বাড়বে। এবারের বাজেটেও অর্থমন্ত্রী এমনটি বলেছেন। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোতে এখন প্রচুর তারল্য রয়েছে। এ সময়ে ঋণ নিলে ব্যাংকের ওপর কোন চাপ তৈরি হবে না, বরং উপকৃত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় ব্যাংক ঋণের চাপ কমছে। ব্যাংকে ঋণের চেয়ে সুদ বেশি হওয়ার জন্যই মানুষ এখন সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখতে বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে সরকারও এ খাত থেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঋণ পাচ্ছে। এজন্য ব্যাংক ঋণের চাহিদা কম হচ্ছে। জানা গেছে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়াতে গত বছরের মার্চ মাস থেকে সুদের হার কিছুটা বাড়িয়েছে সরকার। পরিবার, পেনশনার, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর ও পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১ শতাংশ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করমুক্ত রেখেছে সরকার। বর্তমানে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সুদহার ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ বিদ্যমান রয়েছে।
×