ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

নৃশংস না হলে বিএনপি-জামায়াত করা সম্ভব নয়

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নৃশংস না হলে বিএনপি-জামায়াত করা সম্ভব নয়

(২৪ ফেব্রুয়ারি সম্পাদকীয় পাতার পর) অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনা ও জামায়াতী ও তাদের সহযোগীদের নৃশংসতার কথা কেউ ভুলে যায়নি। সেটি স্মৃতিতে রয়ে গেছে। এ কারণেই বলছি জাতিগত স্বার্থে স্মৃতি সংরক্ষণ জরুরী। স্মৃতি অবলুপ্ত হলে ইতিহাস থাকে না, ইতিহাস না থাকলে একটি জাতির ভিত তৈরি হয় না। যে মানুষের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যায় তিনি তো তখন জীবন্মৃত। এরকম মানুষ তো আপনারা দেখেছেন। নির্যাতিতরাও কথা বলছেন। এ কৃতিত্ব যারা গত ৪০ বছর এ নিয়ে লেখালেখি করছেন ও শেখ হাসিনার। তাঁর কারণেই আজ নৈঃশব্দ ভেঙ্গে অনেকে এগিয়ে আসছেন। ভয়ের সংস্কৃতির বিনাশ এভাবেই করতে হয়। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যে দেশে স্বাধীনতার পরও স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যে দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে বিরোধিতা করছে দু’টি দল- বিএনপি ও জামায়াত। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে সুপ্রীমকোর্ট বারের প্রধান সরাসরি এবং স্বেচ্ছায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থন করে যাচ্ছেন। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে মিডিয়ার একটি অংশ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সমর্থন দিয়েছে। এসব মিডিয়ার মালিকদের এই অংশটি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হিসেবে পরিচিত এবং এই আমলেই লাইসেন্স পেয়েছে এ কারণে। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যে দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সমর্থক, পরিপোষক ও প্রচারকরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছেন, এখনও পাচ্ছেন এবং এই আমলসহ সব আমলেই পেয়েছেন। আমাকে একজন সংসদ সদস্য বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে গালিগালাজ করতেন এমন ব্যক্তিও এবার একুশে পদক পেয়েছেন। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে ১৯৭১ ও ১৯৭৫-এর খুনীদের মানুষ সংসদ সদস্য নির্বাচন করেছে। অষ্টাদশ শতকের কবি আবদুল হাকিমের ভাষায় বলতে হয়- “সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।” সে জন্য বলি, বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। আবার এও বলি, এরকম একটি অজাত-কে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং এমনভাবে মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিলেন যে, তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর নামে সবাই যুদ্ধ করে গেছেন এবং জয়ী হয়েছেন। এ সত্যও সদাই বিস্মৃত হই। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এবং এখন যে ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে, সুবহানদের রায়ের সঙ্গে মেলালে তার কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে। ১৯৭১ সালে যারা নৃশংস নির্দয়ভাবে খুন ধর্ষণ লুট করেছিল তারা ছিল পাকিস্তান বাহিনী, জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামী প্রভৃতি। তখন বিএনপি ছিল না। জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী যখন বাঙালী পাকিস্তানীদের একত্রিত করছিলেন তখন ওই সব মুসলিম লীগার, নেজামী ইসলামী, দলহীন পাকিস্তান সমর্থক ও আওয়ামী বিরোধীরা বিএনপি গঠন করে। এখন যারা মানুষ কাবাব বানাচ্ছে তারা বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক-কর্মী ও নেতা। সে সময় তারা ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে। তখন তারা মানুষকে মসজিদ থেকে ডেকে এনে হত্যা করেছে। এখন তারা কোরান পোড়ায়, স্কুল-মসজিদে আগুন দেয়, বোমা মারে এবং শিশু নারী বৃদ্ধদের পুড়িয়ে মারে। মানুষ যখন কাবাব হয়ে যায় তখন তারা খুব আনন্দ পায়। সে সময়ও অনেক ‘বুদ্ধিজীবী’ তাদের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছে। এখনও কখনও ১৫ জন, কখনও ১৩ জন, কখনও ৪১ জন তাদের হয়ে ‘সংলাপ সংলাপ’ বলে বিবৃতি দিচ্ছেন। তখনও অনেক রাজনীতিবিদ এদের সমর্থন করেছিলেন, এখনও করছেন। আগের অনুচ্ছেদে যাদের কথা বলেছি এবং এখন যাদের কথা বললাম এরা সবাই জামায়াত-বিএনপির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থক। আরেকটি বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছা যায়- এসব ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে বেলাজ নির্দয় নিষ্ঠুর নৃশংস না হলে বিএনপি-জামায়াত করা যায় না এবং গত ৩৫ বছর সমাজের রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে তারা জায়গা করে নিয়েছে দেখে গণতন্ত্রের লড়াইটা এখন সমস্যাসঙ্কুল। এরকম কেন হলো? এর একটি কারণ মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য বিস্তার করতে না পারা। এর জন্য শিক্ষা-সংস্কৃতি-মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের দায় বেশি। মুক্তিযুদ্ধের সনদ জালিয়াতি হয়, সচিবরা জড়িত থাকেন সোনা চুরিতে আর সরকার বিষয়টি উপেক্ষা করেন। পদাধিকারবলে আমরা যারা বুদ্ধিজীবী, তাদের একাংশও এর জন্য দায়ী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করলেন তখন থেকে কিন্তু বর্তমান সংঘাতের শুরু। আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা ছাড়া এ বিচার করত কিনা সন্দেহ। ইতিহাস বলে, তাজউদ্দীন আহমদকে আওয়ামী লীগের একটি প্রভাবশালী অংশ বাদ দিতে চেয়েছিল, আরেকটি অংশ কনফেডারেশন করতে প্রস্তুত ছিল। সেই সব অংশের ‘ছুপা রুস্তম’রা আবার বঙ্গবন্ধু হত্যা সমর্থন করেছিল। স্পীকার মালেক উকিল কি বলেননি, ফেরাউনের হাত থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে। শেখ হাসিনাকে যে আমরা সোচ্চার সমর্থন করি তার প্রধান কারণ, মানবতাবিরোধী বিচার শুরু ও চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখানোর জন্য। তাঁর সাথীরা ঠোঁটের ব্যবহারে [লিপ সার্ভিসে] দক্ষ। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, খাজা কায়সারের বিচারের সময়ও প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপির কাছ থেকে বাধা এসেছে বলে শুনেছি। শেখ হাসিনা অটল থাকায় বিচার কাজটা এখনও চলছে এবং এখনও দেখবেন, মানবতাবিরোধী বিচার নিয়ে তিনি যতটা সোচ্চার, তাঁর পছন্দের মন্ত্রীরা উপদেষ্টারা তত সোচ্চার নয়। কারণ, তারা আকাক্সক্ষী। আকাক্সক্ষী মানুষরা সাহসী হতে পারে না। বিরোধী পক্ষ জানে, এই বিচার প্রক্রিয়া ১৯৭১ আবার ফিরিয়ে আনবে এবং তা যদি সংরক্ষিত হয়, তা হলে পাকিস্তানী মানস প্রভাব হারাবে। পাকিস্তানী মানস না থাকলে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি থাকে না। সুতরাং সুশীল বাটপাড় কথিত নির্বাচন নিয়ে এ সংঘাত নয় যে সংলাপ প্রয়োজনীয়। এটি পাকিস্তান-বাংলাদেশ সংলাপ, যে কারণে সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ লড়াইটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, রক্তক্ষয়ও হবে। ১৯৭১ সালেও তা হয়েছিল। আমাদের উচিত একটু ধৈর্য ধরা এবং যে বিচার ১৯৭১ ফিরিয়ে আনছে সে বিচারের পথ মসৃণ করা এবং যে-ই বাধা দেবে, তিনি যত উচ্চপদেই থাকুন তাকে প্রতিরোধ করা। মুক্তিযুদ্ধ সৃষ্ট রাষ্ট্র এভাবেই রক্ষা করতে হয়, করতে হবে এবং মানুষের মানসে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্যই বিস্তার করতে হবে। সেটি সম্ভব হতে পারে এখন বিএনপি-জামায়াতী বা বাঙালী পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যে লড়াইটা চলছে তাতে জয়ী হলে এবং জয়ী হতেই হবে। এ ছাড়া কোন বিকল্প নেই। (সমাপ্ত)
×