ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

নৃশংস না হলে বিএনপি-জামায়াত করা সম্ভব নয়

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নৃশংস না হলে বিএনপি-জামায়াত করা সম্ভব নয়

কাকতালীয়ভাবে একই দিন দুটি ঘটনা ঘটল, যার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন অপেক্ষা করছিলেন। শুধু অপেক্ষা কেন, সত্য কথা বলতে কী বিরক্তও হচ্ছিলেন। আদালত সমালোচিত হচ্ছিল। একটি ঘটনায় বিরক্ত হয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক সভায় বলেছিলেন, তিনি এতে পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছেন। আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রীমকোর্টে মানবতাবিরোধী দুই অপরাধীর রায়ের কথা বলছি। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা দরকার। ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা আশা করেছি, ঘটাঘট মামলা হবে আর ঝটপট রায় বেরিয়ে যাবে। এর একটা কারণ, বিচারের আশা করা হচ্ছে ৪০ বছর ধরে। ৪০ বছর অনেকে বাঁচেনও না। সুতরাং বিচার যদি চলে কয়েক বছর, তাহলে তো আশা পূরণ হবে না। আর আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য ধৈর্য হারানোর ব্যাপার তো আছেই। যেমনÑ অপরাধী সেলিব্রেটি বা স্টার অপরাধী বা তারকা অপরাধীদের মধ্যে সুবহান একজন। বাকি তারকা অপরাধীদের রায় হয়ে গেছে, তারটাই বাকি ছিল। এ রায় নিয়ে কেউ কেউ ধৈর্য হারাচ্ছিলেন। কিন্তু রায় হয়ে গেছে, তারকা অপরাধী ১৭ জনের বিচার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। আমাদের অধৈর্য হওয়ার কোন কারণ নেই। পৃথিবীর বেশ ক’টি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে গত এক দশক ধরে এবং কোন বিচারালয়ই দু’তিনটির বেশি রায় দিতে পারেনি। এমনকি হেগের আদালতও খুব সম্ভব এক যুগে দু’টি রায় দিয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে আদালত ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করেছে এবং নানা রকম বাধা-বিপত্তির মুখে গত ৫ বছরে এতগুলো রায় দিয়েছে। সেজন্য অবশ্যই তারা অভিনন্দনযোগ্য। অন্যদিকে, তুলনা করলে সুপ্রীমকোর্ট বেশি সময় নিচ্ছে। কোর্ট যুক্তি দিয়েছে তাদের রুটিন অনুযায়ী কাজ করবে। আমাদের কাছে এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ কোন রুটিন-ব্যাপার ছিল না এবং এ সংক্রান্ত কোন বিষয় রুটিন-বিষয়ে ফেলা যায় না। মুক্তিযুদ্ধকে রুটিন করে ফেলার মনোভাবটা হয়েছে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। আজকের যারা বিচারক ১৯৭৫ সালের সময় ছিলেন তারা তরুণ। তারা বিকশিত হয়েছেন হিজাবী শাসনের অধীনে যে সময় হাইকোর্ট জংলি সামরিক আইনকেও গণতান্ত্রিক মনে করেছে। আজ তারা বিচারক হলেও সচেতন-অচেতনভাবে এ মনোভাবটিও কাজ করে। অনেকে রায় লিখতেও অযথা বিলম্ব করেন। মানুষ এসবে ক্ষুব্ধ হয়। সুপ্রীমকোর্টে ছুটি সবচেয়ে বেশি। আদালত সবাই মান্য করে সভ্যতার খাতিরে, কিন্তু রাষ্ট্রের অন্য দু’টি প্রতিষ্ঠান থেকে বিচার বিভাগ বড় নয়। রাষ্ট্রে সবার যেমন দায়বদ্ধতা আছে বিচার বিভাগেরও আছে এবং সেটি আমাদের কাছে। আরেকটি বিষয় আমরা ভুলে যাই, এই রাষ্ট্রের উৎস মুক্তিযুদ্ধ, আইনেরও। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন প্রশ্ন, বিতর্ক করা যাবে না এবং মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত বিষয়াদি অগ্রাধিকার পাবে। সেটি না হলে মানুষের ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক। সাঈদীর পূর্ণাঙ্গ রায় কি প্রকাশিত হয়েছে? তারকাদের মামলাগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার পর নানা জায়গা থেকে গুঞ্জন উঠছেÑ আর কত, অনেক তো হলো। ছোটখাটো রাজাকারের বিচার করে লাভ কী? এই প্রশ্ন ১৯৭৫-এর জেনারেশনের বেশি, সেটি স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধের জেনারেশনেরও অনেকে যে এ প্রশ্ন করেন না তা বলি কী করে? তারাও এটি করেন এবং এতে বিভ্রান্তি বাড়ে। যে ১৭ জনের রায় হয়েছে তাদের একটি অংশ ১৯৭১ সালে নীতিনির্ধারক ছিলেন। আরেকটি অংশ জিয়া পাকিস্তানীর মদদে রাজনীতি ক্ষেত্রে তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন যেমন সাকাচৌ। কিন্তু এরাই শুধু গণহত্যায় জড়িত ছিলেন তা তো নয়। জেলা মহকুমা থানা পর্যায়েও অনেকে ছিলেন যারা নৃশংসতায় নীতিনির্ধারকদের মতোই ছিলেন এবং মহকুমা বা থানা পর্যায়ে যে নৃশংসতা দেখানো হয়েছে সেটি অগোচরে রয়ে গেছে। যেমন বাগেরহাটের রজ্জব আলী ফকিরের কথা বলা যায়। রাজাকার কমান্ডার হিসেবে রজ্জবের নৃশংসতার খবর সারাদেশে ছড়িয়ে যায়। রাজাকার এ কে এম ইউসুফ খুশি হয়ে তাকে উপাধি দেন ‘রাজাকার মেজর’। রজ্জব প্রতিদিন সকালে প্রাতঃরাশের আগে কমপক্ষে ১০ জনকে হত্যা করতেন। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে খুঁজতে যেয়ে তার লাশ পায়। রজ্জব বাংলাদেশ দেখবে না বলে আত্মহত্যা করেছিল বলে ধরে নেয়া হয়। বাগেরহাটের মানুষ তার ওপর এতই ক্রুদ্ধ ছিলেন যে, তারা তার লাশ বাঁশের ডগায় রেখে হাতে ভাঙ্গা হারিকেন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। হারিকেন ছিল মুসলিম লীগের প্রতীক। এখন যাদের বিচার হচ্ছে মহকুমা পর্যায়ে তাদের অত্যাচার ছিল বহুমাত্রিক। তাদের বিচার না হলে, স্থানীয় পর্যায়ে তারা ঘুরে বেড়াবে সেটি খুব অপমানজনক হয়ে যায়। আসলে সেই অপমান থেকে মুক্তির জন্যই তো এই বিচার। তৃণমূলের মানুষেরও বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সুতরাং স্থানীয় পর্যায়ের খুনীদেরও বিচার হওয়া বিধেয়। খুনী খুনীই, সেই খুনী তারকাখ্যাতি অর্জন করতে পারেন, নাও পারেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিম্নপর্যায়ের ব্যক্তিও যিনি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে কর্মরত ছিলেন এখনও তাদের ধরতে পারলে বিচার হচ্ছে। সুতরাং প্রসিকিউশন ও বিচারকÑ সবার প্রতিই আমাদের অনুরোধ থাকবে, প্রতিটি মামলাই যেন গোলাম আযমের মামলার মতো গুরুত্ব পায়। সুবহানের মামলার রায়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচিত হয়েছে। প্রথমটি হলো, ব্যক্তি সুবহানের নৃশংসতা। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে, সুবহানের যখন জন্ম তখন কি তার পিতামাতা বা পাড়াপড়শি ভেবেছিলেন শিশুটি একটি নৃশংস খুনী হবে। নিশ্চয় ভাবেননি। তাহলে শিশু সুবহান যৌবনে খুনী হলেন কেন? কারণ তার সংসর্গ। জামায়াতের রাজনীতি দিয়েই তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। পাবনার নায়েবে আমীর ছিলেন তিনি। জামায়াতের রাজনীতির মূল বিষয়টি তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। তাহলোÑ খুনখারাবি করে আধিপত্য বিস্তার করতে হবে। তাই তিনি করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ৯টি চার্জ আনা হয়েছিল, তার মধ্যে ৩টি চার্জ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। ৩টি অভিযোগে মৃত্যুদ-, ২টি অভিযোগে যাবজ্জীবন ও ১টি অভিযোগে ৫ বছরের জেল দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের মে মাসের ১২ তারিখে সুবহান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে নিয়ে পাবনার সুজানগরের সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামে ৪০০-এর বেশি লোককে হত্যা করেন। অভিযোগ ছিল এই ইউনিয়নের মানুষজন স্বাধীনতা চায়। গ্রামগুলো হলোÑ কুড়িপাড়া, তারাবাড়িয়া, সাতবাড়িয়া, কান্দারপুর, সিন্দুরপুর, নিশ্চিন্তপুর, হরিরামপুর, শ্যামনগর, নারুহাটি, সিংহনগর, ভাটপাড়া এবং গুপিনপুর। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। এখানে একটি বিষয় বলা দরকার। এটি একটি নির্দিষ্ট ঘটনা মাত্র। সুবহান ৯ মাসই কোথাও না কোথাও হত্যা চালিয়েছেন, প্ররোচনা দিয়েছেন বা হত্যার ষড়যন্ত্র করেছেন। [ঈশ্বরদী] এপ্রিলের মাঝামাঝি ১৯ জনকে ঈশ্বরদীতে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়ও তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। মে মাসের ২ তারিখে ঈশ্বরদীর সাহাপুরে ছয়জনকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের জন্যও তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। সবচেয়ে নৃশংস হলো মসজিদ থেকে মুসল্লি নিয়ে হত্যা। ঈশ্বরদীর জামে মসজিদে ঢুকে সুবহান ১২ থেকে ১৯ জুন মুসল্লিকে বাছাই করে এনে কয়লার ডিপোতে তলোয়ার দিয়ে জবাই করতেন। আশপাশের এলাকা থেকে মানুষজন এলেও হত্যা করা হতো। এ রকম ১৯ জন শহীদকে শনাক্ত করা গেছে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান মন্তব্য করেছেন- কী নিষ্ঠুরতা! বিশ্বাস করা যায় যে অভিযুক্তের মাঝে মানবিকতা ও দয়া সামান্যটুকু আছে? ’What a brutality! It is hard to believe indeed that the accused was a man of Slightest humanity and kindness‘ তিনি আরও মন্তব্য করেছেন- আমরা বুঝতে অক্ষম একজন বাঙালী মুসলমান হয়ে সুবহান কিভাবে ‘তার এলাকার মানুষজনের বিরুদ্ধে এরকম নিষ্ঠুর নির্দয় অপরাধ করতে সহায়তা করেছিলেন? এটি কি মানবতা? (বাকি অংশ আগামীকাল)
×