ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মেধাসম্পদের ডিজিটাল জনসেবা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

মেধাসম্পদের ডিজিটাল জনসেবা

॥ ক ॥ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতর জনগণের জন্য ডিজিটাল সেবা প্রদানের কাজ শুরু করেছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ঢাকার একটি হোটেলে এই সেবা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। অনুষ্ঠানে শিল্প সচিব ও ডিপিডিটির রেজিস্ট্রার বক্তব্য রাখেন। সেই সভাতেই আমি আলোচনা করেছিলাম ডিপিডিটির ডিজিটাল সেবার প্রসঙ্গ নিয়ে। আগামী ২৬ এপ্রিল যখন বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস পালিত হবে তখনও এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হবে। তবে ’৯২ সাল থেকে এই মেধাসম্পদ নিয়ে আলোচনা করতে করতে এটি বুঝেছি যে, বাস্তব অবস্থার কথা বস্তুত বলাই হয় না। আলোচনা বা পর্যালোচনার সময় কেবল অর্জনের কথা বলা হয়, মূল সমস্যার দিকে কেউ তাকায় না। সবাই কেবল প্রশংসা শুনতে চায়, সমালোচনা শুনতে চায় না। ফলে এমনকি ডিজিটাল রূপান্তরের কাজগুলোও সঠিক পথে সঠিকভাবে সামনে চলে না। আমরা সচরাচর চামড়ার ওপরে মলম লাগাতে পছন্দ করি, কিন্তু ঘায়ের চিকিৎসা করি না। আমার কাছে মেধাসম্পদ বিষয়টি রাষ্ট্রের আরও অনেক কিছুর চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি যেহেতু মনে করি যে, আমরা ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করব এবং সেই সমাজের মূল ভিত্তি হবে জ্ঞান, সেহেতু মেধাসম্পদের সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে কোনভাবেই আমরা সেই সভ্যতায় পৌঁছাতে পারব না। বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত এই বিষয়টিকে যদি এখনই অগ্রাধিকারের জায়গায় না আনা যায় তবে শিল্পযুগের ট্রেন মিস করার মতো আমরাও ডিজিটাল যুগের ট্রেনটা মিস করব। জাতি হিসেবে এটি আমাদের কাম্য হতে পারে না। ॥ খ ॥ পটভূমি : আমরা যখন বাংলাদেশ সরকারের ডিজাইন প্যাটেন্ট ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর থেকে জনগণকে উন্নততর সেবা প্রদানের কথা বলছি তখন পুরো দুনিয়াটা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেবার পর এবার জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। আমরা যদি খুব সহজে সরকারের এই লক্ষ্যের কথা বলি তবে এটি বলতে হবে যে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ হচ্ছে মানব সভ্যতার তৃতীয় যুগ বা ডিজিটাল যুগের প্রতিপাদ্য বিষয়। এর প্রেক্ষিতটিও আমাদের জানা দরকার। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০-১২ তারিখে জেনেভায় অনুষ্ঠিত তথ্যপ্রযুক্তি সম্মেলনে বিশ্ববাসীর পক্ষে ঘোষণা করা হয়, We, the representatives of the peoples of the world, assembled in Geneva from 10-12 December 2003 for the first phase of the World Summit on the Information Society, declare our common desire and commitment to build a people-centred, inclusive and development-oriented Information Society, where everyone can create, access, utilize and share information and knowledge, enabling individuals, communities and peoples to achieve their full potential in promoting their sustainable development and improving their quality of life, premised on the purposes and principles of the Charter of the United Nations and respecting fully and upholding the Universal Declaration of Human Rights. এই ঘোষণার পর ২০০৫ সালে তিউনিসে এবং এরপরও অব্যাহতভাবে সারা দুনিয়া একটি তথ্য সমাজ বা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার অঙ্গীকারের কথা বলে আসছে। দুনিয়ার বহু দেশ এই অঙ্গীকার পূরণের জন্য কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশও প্রথমে ডিজিটাল বাংলাদেশ ও পরে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সামনে যাচ্ছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ সম্পর্কে ধারণাটি আরও স্পষ্ট করা যায় ছোট আরেকটি সংজ্ঞা দিয়ে, A knowledge society generates, processes, shares and makes available to all members of the knowledge that may be used to improve the human condition. (http://en.wikipedia.org/wiki/Knowledge_society) আমরা খুব ছোট এই সংজ্ঞাটিতেও অনুভব করতে পারব যে, এই সমাজের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে জ্ঞান। মেধাসম্পদ : প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা বলাটি ধান বানতে শিবের গীত গাওয়া মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতার্থে তা নয়। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে দুনিয়া যদি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলে তবে সেই সমাজের ভিত্তি হবে জ্ঞান যা একটি মেধাজাত সম্পদ। আমরা যখন প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কের কথা বলি তখন সেই মেধাসম্পদের কথাই বলি। মেধাসম্পদ বলতে প্রকৃতপক্ষে এই তিনটি বিষয়ের পাশাপাশি কপিরাইট নামক আরও একটি বিষয়কে বোঝানো হয়ে থাকে। ১৪৫০ সালে দুনিয়ার প্রথম প্যাটেন্ট প্রদান করা হয়। ১২৬৬ সালের ইংল্যান্ডে প্রথম ট্রেডমার্ক আইন পাস হয়। ১৬৬২ সালে কপিরাইট বিষয়ক আইনের সূচনা হয়। আমরা বাংলাদেশেও এক-দুই শতক যাবত চারটি বিষয়েই আইন প্রণয়ন করেছি। আমরা এখন আইনগুলো আপডেট করছি ও বাস্তবায়ন করছি এবং সরকারের দুটি মন্ত্রণালয় যথাক্রমে শিল্প ও সংস্কৃতি এই চারটি বিষয়ের দেখাশোনা করছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই চারটি প্রধান খাতের বাইরেও সময়ের প্রেক্ষিতে আরও নতুন মেধাসম্পদের খাত তৈরি হচ্ছে। জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন তেমন আরেকটি খাত। ॥ গ ॥ মেধাসম্পদ বিষয়ক জনসেবা : মানুষের বস্তুগত সম্পদের স্বত্ব¡ যেমন করে আইন ও বিধিমালার মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিশ্চিত করতে হয় তেমনি মেধাসম্পদের জন্যও সেই কাজটি করতে হয়। আমরা জমিজমা-বাড়িঘর ইত্যাদির মালিকানা বিষয়ক আইন অনুসরণ করি ও একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মালিকানার ব্যবস্থাপনা করি। মেধাসম্পদের ক্ষেত্রেও সেই কাজটি করতে হয়। এই ক্ষেত্রে আইন-বিধিবিধান ও ফিস প্রদানের বিষয় রয়েছে। সরকারী অফিসগুলো এইসব ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে। প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক এবং জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বিষয়গুলো শিল্প মন্ত্রণালয়ের ডিপিডিটি ব্যবস্থাপনা করে থাকে। কপিরাইট অফিস কপিরাইটের বিষয়গুলো দেখাশোনা করে থাকে। খুব সঙ্গত কারণেই এইসব সংস্থাকে জনগণকে সেবা দিতে হয়। মেধাসম্পদের প্রধানতম বিষয়টি হচ্ছে এর মালিকানা বা অধিকার নির্ধারণ বা নিশ্চিত করা। যেহেতু আইনের আওতায় এর সার্বিক দিকগুলোর বিচারাদি হয়ে থাকে সেহেতু এই বিষয়টি একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। অন্য সকল খাতের মতোই কাগজভিত্তিক শিল্পযুগে এসব কাজ করার জন্য কাগজে আবেদন করতে হয়, কাগজপত্র দেখে যাচাই বাছাই করতে হয় এবং কাগজের ম্যাধমে এইসব কাজের নিষ্পত্তিও করতে হয়। জনগণকে এসব কাজের জন্য ডিপিডিটিতে আসতে হয়, যোগাযোগ করতে হয়, লেনদেন করতে হয় এবং সেবা গ্রহণ করতে হয়। আমরা এই সংস্থাটির সেবা গ্রহণকারী হিসেবে যেসব বিষয় মোকাবিলা করি সেগুলো নিয়ে কথা বলতে পারি এবং জনগণকে কতটা উন্নত সেবা প্রদান করা যায় ও কিভাবে সেটি করা যায় সেই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি। প্রথমেই আমি এই অধিদফতরের সেবা দেবার সক্ষমতা বিষয়ে একটি দৃষ্টান্তের কথা উল্লেখ করতে পারি। ১৯৮৮ সালে বিজয় বাংলা কীবোর্ড ও সফটওয়্যার আবিষ্কারের পর ৮৯ সালে এর কীবোর্ড অংশটির কপিরাইট গ্রহণ করি। ১৯৯২ সালে আমি এর প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করি। তখন ডিপিডিটি থেকে আমাকে বলা হয়, আমার প্যাটেন্ট আবেদনের পরিক্ষা করার মতো মানুষ তাদের নেই। হতাশ হয়ে আমি আবেদনই পেশ করিনি। ২০০৪ সালে আমি আবার আবেদন করি। সেবার এনামুল হক সাহেব বলেন, তিনি এর পরীক্ষা করবেন। তিনি সেটি করেনও। এর ফলে ৪ বছরে আমি বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল আবিষ্কারের প্যাটেন্ট পাই। এভাবে কি কোন দেশ তার মেধাসম্পদ রক্ষা করতে পারে? এমন একটি দৃষ্টান্তকে মাথায় রেখে আমি প্রাসঙ্গিক সেবাগুলোর একটি ধারাবাহিক বিবর্তনের প্রতি নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। জনগণকে ডিজিটাল যুগের সেবা দিতে হলে এই অধিদপতরকে দুটি ধারায় নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। ক) এই অধিদফতরের অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম, যোগাযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে করতে হবে। এটিকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ নেটওয়ার্কের আওতায় রাখতে হবে এবং এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা যাতে সার্বক্ষণিকভাবে একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রধান কাজটি হচ্ছে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান সকল তথ্য-উপাত্তকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করা। বর্তমান ও ভবিষ্যতেও যাতে সকল তথ্য ও উপাত্ত ডিজিটাল পদ্ধতিতেই গ্রহণ করা হয় তার ব্যবস্থাও নিশ্চিতভাবেই করতে হবে। খ) জনগণকে ওয়েবভিত্তিক সেবা প্রদান করাটি হচ্ছে এই সংস্থার দ্বিতীয় প্রধান কাজ। এই কারণে জনগণ যাতে এই সংস্থায় ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত না হয়ে তার সকল কাজ সম্পন্ন করতে পারে তার ব্যবস্থা করাটা খুবই জরুরী। এই দুটি কাজ করার জন্য ডিপিডিটিকে যেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে সেগুলোকে আমি নিচের দুটি প্রধান খাতে বিন্যস্ত করছি। ১) ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তোলা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করা, তথ্য সংরক্ষণ, যোগাযোগ ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পুরো অবকাঠামোটিকে একটি সমন্বিত ব্যবস্থায় গড়তে হবে যাতে একটি অপরটির পরিপূরক হয় এবং এই সংস্থার সকল কাজ যাতে সকলে সমন্বিতভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। এতে খুচরা বা টুকুরো টুকরোভাবে কাজ করার কোন উপায় নেই। ২) এই ব্যবস্থায় কাজ করতে সক্ষম জনসম্পদ তৈরি করতে হবে। এই কাজগুলোর প্রথম দুটি সম্পন্ন করতে গেলে একটি সুন্দর পরিকল্পনাও বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। কিন্তু চ্যালেঞ্জের কাজটি হচ্ছে তৃতীয়টি। আমি যতটা জানি, এই প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় সঙ্কটের নাম মানবসম্পদ। এর নিজস্ব জনবল কেবল অপ্রতুল নয়, নতুন ব্যবস্থায় কাজ করার জন্য কতটা দক্ষ সেটি বিচার বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বাইরে থেকে ধার করে এমন একটি সংস্থা কখনও চলতে পারে না। সবচেযে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এই অধিদফতরের সেবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষায় প্রদান করা। যে আইপাস সফটওয়্যার দিয়ে ডিপিডিটি তার ডিজিটাল সেবার সূচনা করেছে তাকে বাংলা ভাষায় ব্যবহার করার যোগ্য করতে হবে এবং এই অধিদফতরের সকল সেবা বাংলা ভাষাতেই দিতে হবে। আমাদের সাম্প্রতিক প্রবণতা হচ্ছে ডিজিটাল করার নামে বাংলা ভাষাকে বিদায় করা। এই নির্মম কাজটি থেকে সকলকে বিরত থাকতে হবে। শেষ কথা: আরেকটি বিষয়ে আমি নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মেধাসম্পদ বিষয়টির জন্য একীভূত অফিস এবং এক জায়গায় সকল সেবা প্রদান করা আবশ্যক। সংস্কৃতি বা শিল্প বা অন্য কোন মন্ত্রণালয় কিংবা প্রধানমন্ত্রীর দফতর যেখানেই হোক না কেন ডিপিডিটি ও কপিরাইট অফিসকে একীভূত করা হোক এবং অফিস কোথায় থাকবে তার ঠিকানাটা আমাদের মতো ব্যবহারকারীদের প্রদান না করে একটি ওয়ান স্টপ সেবা কেন্দ্র চালু করা হোক।
×