ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাকে নৌকা উপহার দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, পানি যেন পর্যাপ্ত থাকে নৌকা যাতে চলে;###;জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত

বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যার পানি পাবে ॥ শেখ হাসিনাকে মমতা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যার পানি পাবে ॥ শেখ হাসিনাকে মমতা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশা দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী পানি পাবে। এছাড়া আগামী লোকসভা অধিবেশনে সীমান্ত চুক্তির অনুমোদন হবে। শনিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এসব জানান। দু’জনের দীর্ঘ বৈঠকে দুই বাংলার মধ্যকার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ঢাকায় তিনদিন সফরের বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সীমান্ত চুক্তিকে সমর্থন করায় মমতাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর তিস্তার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা জানিয়েছেন, কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে তিস্তা চুক্তি করা হবে। এছাড়া জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দুই দেশের নেত্রী তাঁদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মমতাকে নৌকা উপহার দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের যেন পর্যাপ্ত পানি থাকে, এ নৌকা যেন চলতে পারে। জবাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়ে তাঁর ইতিবাচক ভূমিকা থাকবে বলে প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতার সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এসব কথা জানান প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব একেএম শামীম চৌধুরী। দুই নেত্রীর মধ্যে বৈঠকের বিষয়ে ইকবাল সোবহান চৌধুরী জানান, অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ আলোচনা হয় শেখ হাসিনা ও মমতা ব্যানার্জীর মধ্যে। প্রতিনিধি দল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর দুজন একান্তে কথা বলেন প্রায় আধাঘণ্টা। সেখানে কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা জানা না গেলেও প্রথম আলোচনায় অমর একুশে পালনের জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোয় মমতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমি আপ্লুত, আমি ধন্য। মহান একুশের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই আমন্ত্রণ আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া লোকসভা অধিবেশনে সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়ে যাবে। একইসঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে তিনি সবসময় ইতিবাচক ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবেন বলে প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দেন। মমতা বলেন, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে অন্যতম অমীমাংসিত বিষয় হলো সীমান্ত চুক্তি। আমাদের পক্ষ থেকে এ সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি। আশা করি আগামী ২৩ তারিখ থেকে শুরু হতে যাওয়া লোকসভার অধিবেশনেই এর সমাধান হয়ে যাবে। বিলটি লোকসভায় উত্থাপিত আছে, এখন পাস হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। তাঁর এই আশ্বাস ও ভূমিকায় ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পর্কে মমতা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আমি বাংলাদেশকে ভালবাসি। বাংলাদেশ আমারও দেশ। বাংলাদেশের স্বার্থকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। দু’দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখব। শেখ হাসিনার উদ্দেশে মমতা বলেন, অনেক দিন কলকাতা যান না। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে পশ্চিমবঙ্গ সফরের আমন্ত্রণ জানান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে কলকাতায় যে চেয়ার উদ্বোধন এবং কলকাতায় প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ভবন নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষেই এ সফর হতে পারে বলে মত দেন মমতা ব্যানার্জী। প্রধানমন্ত্রী এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে বলেন, সুবিধামতো সময়ে তিনি অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ সফর করবেন। ইকবাল সোবহান চৌধুরী জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিটমহলে বাংলাদেশীদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরলে মমতা বলেন, তিনি নিজেও ওই এলাকা ঘুরে দেখেছেন, দুর্ভোগ দেখেছেন। এই বিবেচনা থেকেই যত দ্রুত সম্ভব সীমান্ত চুক্তি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মত দেন দুই নেত্রী। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ ভবন তৈরির জন্য জমি দেয়া হবে এমন সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নিয়ে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে বলে আলোচনায় জানান মমতা। এছাড়া কাজী নজরুল ইসলামের নামে পশ্চিমবঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথাও বলেন তিনি। এই সফরের মধ্য দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হবে বলেই মনে করেন দুই নেত্রী। তাদের মতে, এই সম্পর্ক হবে দীর্ঘস্থায়ী। আলোচনা ছাড়াও ছিল উপহার দেয়া-নেয়ার পালা। মমতা ব্যানার্জীকে একটি নৌকা উপহার দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে নৌকা হাতে তুলে দিয়ে তিনি বলেন, এই নৌকা চলার পানি যেন পাই। উত্তরে মমতা বলেন, বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী পানি পাবে। দুই দেশের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখেই পানি বণ্টন হবে। এ বিষয়ে তার ইতিবাচক ভূমিকা থাকবে। মমতা বলেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন পানির ব্যবস্থা হবে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার ঢাকা সফর নিয়ে শনিবার ভারতীয় হাইকমিশনের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত ও তিস্তা চুক্তি সম্পন্নের বিষয়ে আশা প্রকাশ করেছেন। সীমান্ত চুক্তির ক্ষেত্রে মমতা সমর্থন দেয়ায় তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া তিস্তা চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি সম্পন্নের জন্য কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা রয়েছে। সেটা সমাধানের মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে এই চুক্তি সম্পন্ন করা হবে। শনিবার ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শুক্রবার হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত বৈঠকী বাংলা অনুষ্ঠানে মমতা ব্যানার্জী দুই দেশের সম্পর্ক জোরদারে সাত দফা ঘোষণা দিয়েছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে, কলকাতায় বঙ্গবন্ধু ভবন স্থাপন। সেখানে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রোগীদের বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হবে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বার্ষিক চলচ্চিত্র উৎসব হবে। দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক সংস্কৃতি ও ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করা হবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার স্থাপন করা হবে। যৌথ সংস্কৃতি কমিটি গঠন করা হবে। ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ৫০০ বই দেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কলকাতার অরিবিন্দ ভবনে মুজিবনগর সরকারের স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের সঙ্গে মমতা বৈঠক করেন। বৈঠকে দুই দেশের জনগণ থেকে জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, পর্যটন, কানেকটিভিটি ও আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে মমতা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার, আন্তঃসীমান্ত ইস্যু, বাণিজ্য, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। এর আগে শুক্রবার তিস্তার বিষয়ে মমতা তাঁর প্রতি আস্থা রাখতে বলেন। তবে তিনি আস্থা রাখতে বললেও তাঁর বিরোধিতার কারণেই ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তি হতে হতেও আটকে যায়। ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে সফরে আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নেন মমতা। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ‘স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে’ এই চুক্তিকে তিনি সমর্থন করতে পারেন না। মনমোহনের সেই সফরে স্থল সীমান্ত একটি চুক্তির প্রটোকল সই হয়, যার মধ্য দিয়ে ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের পথ খোলে। কিন্তু এই প্রটোকল কার্যকর করতে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হওয়ায় বিষয়টি ঝুলে থাকে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতার কারণেই। ভারতের নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি বিষয় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করলে জট খোলার আশা তৈরি হয়। তার উদ্যোগে সম্প্রতি স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকরে মমতার সরকারের সায় পাওয়া যায়। বিষয়টি এখন ভারতের পার্লামেন্টে অনুমোদনের অপেক্ষায়। গতবছর শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে তিস্তা চুক্তি সইয়ের বিষয়েও জোর চেষ্টা চালানোর আশা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার রাতে তিনদিনের সফরে ঢাকায় এসে পৌঁছেন মমতা ব্যানার্জী। বিমানবন্দরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাকে স্বাগত জানান। এ সময় ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরন উপস্থিত ছিলেন। শুক্রবার রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ ও শনিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন মমতা ব্যানার্জী। শনিবার রাতে কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন মমতা ও তাঁর সফরসঙ্গীরা।
×