ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অমর একুশে

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অমর একুশে

পেট্রোলবোমায় যখন মানুষ হত্যা করছে অবরোধ ও হরতালকারীরা তখনও সাহস জাগায় একুশ। একুশ মানে মাথানত না করা। কথাটির যথার্থতা বার বার প্রমাণিত এ দেশে। একুশ শিখিয়েছে অন্যায়-অবিচার ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, প্রতিরোধী হওয়ার। তাই আমার প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন, জ্বলে দ্বিগুণ দারুণ। বাহান্নর সেই ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি ৬২ বছর পেরিয়ে ৬৩ বছরে পদার্পণ করেছে। অমর একুশের চেতনা আজও অমলিন। সেদিন মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলার তরুণরা মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়ে স্বাজাত্যবোধের যেই মশাল প্রজ্ব¡লিত করেছিলেন সেই আলো দেশের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও। এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের এমন নজির পৃথিবীতে নেই। রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে একুশের প্রভাব এতটাই সর্বব্যাপী যে, ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। আত্মপরিচয় বিস্মৃত জাতিকে স্বরূপের সন্ধান দিয়েছে। জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ করেছে যেমন একুশে, তেমনি যুগিয়েছে অপরিমেয় শক্তি ও সাহস। অদম্য আত্মবিশ্বাসে করেছে বলীয়ান। একুশ বাঙালীর আবহমানকালের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিবিধ রতœভা-ারের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দিয়েছে সঠিক পথের সন্ধান। একুশের পথ ধরে তাই গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন দেশ পেয়েছে বাঙালী। বাঙালী ও বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলা ভাষা ও একুশে ততদিন থাকবে অমলিন। কারণ একুশের শিকড় বাঙালীর চেতনার গভীরে প্রোথিত। একুশ বাঙালীকে অন্যায়-অবিচার ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। তাই এ দেশের মানুষ কখনই সামরিক ও স্বৈরশাসনের কাছে মাথানত করেনি। আপোস করেনি গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে। আর এসব কিছুরই প্রেরণা হয়ে আছে একুশে। একুশ ভালবাসার অনন্য প্রতীক হয়ে আছে বাঙালীর জীবনজুড়ে, সে ভালবাসা শুধু মাতৃভাষাপ্রীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাঙালীর ঐতিহ্য-সংস্কৃতি হতে শুরু করে যা কিছু মহত ও মানবিক সর্বত্রই বিস্তৃত তার মমতাময়ী ডানা। ১৯৫২ সালের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ আলোকের ঝর্ণাধারা হয়ে ধুইয়ে দেয় সব কালিমা। কিন্তু সেই ভাষাকে ভালবেসে প্রতিষ্ঠা করার কাজটি আজ চলছে শ্লথগতিতে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা যায়নি। বরং তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে বাংলা ভাষা তার কৌলীন্য হারানোর সম্ভাবনায় আতঙ্কিত। যেহেতু বাংলা ভাষার আর্থিক মূল্য দাঁড়াচ্ছে না, তাই বিশ্বমানবের কাছে এর অবস্থান পোক্ত হয়ে উঠতে পারছে না। উচ্চ আদালতসহ দাফতরিক কাজে স্বাধীনতার পর বাংলা চালু হলেও পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ইংরেজীর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। সরকার বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি তুললেও এ খাতে ব্যাপক অর্থ সংস্থানের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন সম্ভব হয়নি উচ্চশিক্ষার প্রতিটি স্তরে বাংলা ভাষাকে অপরিহার্য করে তোলা। একুশ আসে বাঙালীর প্রাণের আহ্বানে, সাহসের বরাভয়ে। এবারের একুশ এসেছে ভিন্নভাবে। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদী এবং পাকিস্তানী চেতনায় পরিপুষ্ট হয়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে শুধু নয়, গত দেড় মাসের বেশি দেশজুড়ে অবরোধ ও হরতাল পালনের মাধ্যমে জনজীবনকে বিপর্যস্ত শুধু নয়, পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করছে। একুশ শক্তি ও সাহস যোগাবে এদের প্রতিরোধে। অবরোধের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালীকে আবার একাত্তরের মতো প্রতিরোধী সাহসে শত্রুকে পর্যুদস্ত করার প্রেরণাই দেবে। একুশ- জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে আপোসহীনতার লড়াইয়ের মন্ত্র ও প্রেরণা হয়ে এবার এসেছে। বাঙালী এই দিনে আবার জেগে উঠছে জয়ের মন্ত্রে।
×